মঙ্গলে মহারণ
টারজানকে ঘিরে বিপুল উন্মাদনার আড়ালে হামেশাই চাপা পড়ে যায় এডগার রাইস বারোজের প্রথম সৃষ্টি জন কার্টার, ইংরেজি ভাষায় মঙ্গলগ্রহ বিষয়ক কল্পবিজ্ঞান কাহিনিগুচ্ছের প্রথম জনপ্রিয় নায়ক। ইংরেজি কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে মঙ্গলগ্রহের প্রথম উল্লেখযোগ্য আবির্ভাব ব্রিটিশ সাহিত্যিক হার্বার্ট জর্জ ওয়েলসের হাত ধরে, দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস (১৮৯৮) উপন্যাসে। ক্রমহ্রাসমান তাপমাত্রার ফলে মঙ্গলগ্রহ তার বাসযোগ্যতা হারানোর ফলে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ভিনগ্রহীদের দল নতুন বাসস্থানের খোঁজে আক্রমণ করে পৃথিবী, তছনছ করে দিতে থাকে ইংল্যান্ডের জনজীবন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষীয়মান আত্মবিশ্বাসেরই প্রমাণ পাওয়া যায় এ কাহিনীতে। কিন্তু মার্কিন কলমচি বারোজের গল্পগুলি লেখা যে সময়ে, গ্রেট ডিপ্রেশনের সঙ্গে টক্কর নিয়ে আমেরিকা তখন তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট রাষ্ট্রকে গৌরবান্বিত করে তোলবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন মার্কিন পুরুষদের। বারোজ নিজেও ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা, গৃহযুদ্ধের পরেও যেখানে শ্বেতাঙ্গবাদী ও কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী কার্যকলাপ ছিল যথেষ্ট প্রবল। গৃহযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে লড়াই করা দীর্ঘদেহী কার্টার যেন শ্বেতাঙ্গবাদের মূর্ত প্রতীক, গৃহযুদ্ধে পরাজয়ের পর যে আরিজোনায় গোল্ড প্রসপেক্টিংয়ের কাজ শুরু করে। কার্টারকে নিয়ে প্রথম গল্পটি বারোজ লেখেন ১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে, এবং অল স্টোরি ম্যাগাজিন এ সেটি আন্ডার দ্য মুনস অফ মার্স নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বারোজের টারজান অফ দি এপস উপন্যাসটির সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে এ সি ম্যাকক্লুর্গ অ্যান্ড কোং কার্টারের গল্পটি আ প্রিন্সেস অফ মার্স নাম দিয়ে উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করে। আমেরিকান আদিবাসীদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে একটি গুহায় আশ্রয় নেবার সময় রহস্যময় একটি জ্যোতিঃপুঞ্জের দ্বারা মঙ্গলগ্রহে স্থানান্তরিত হয় কার্টার, এবং আবিষ্কার করে মঙ্গলগ্রহের অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাধ্যাকর্ষণ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অসামান্য শক্তি ও সাবলীলতা সঞ্চার করেছে। কার্টারের শারীরিক সক্ষমতা তাকে মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দাদের মধ্যে বিরাট সম্মান অর্জনে সাহায্য করে, তার নতুন উপাধি হয় ‘ডোটার সোজাত’ বা বীরশ্রেষ্ঠ। বারোজের মঙ্গলগ্রহ যেন আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের প্রতীক- রুক্ষ, লাল বালুতে ভরা মঙ্গলগ্রহে হামেশাই চলতে থাকে জলের জন্য কাড়াকাড়ি ও প্রাণঘাতী যুদ্ধ। মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীরা মোটামুটি দুই শ্রেণিতে বিভক্ত- উন্নত লাল মানুষের দল ও হিংস্র সবুজ রঙের পনেরো ফিট লম্বা চার হাত ও বিরাট দাঁতওয়ালা আদিবাসী, বারোজের জাতিগত বৈষম্যমূলক চিন্তাভাবনা পুরোমাত্রায় উপস্থিত মঙ্গলগ্রহের চিত্রায়ণে। প্রত্যাশিতভাবেই বিকটদর্শন আদিবাসীদের পরাস্ত করে মঙ্গলগ্রহে লাল মানুষের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে কার্টার, পৌরুষের বলিষ্ঠ আবেদনে জিতে নেয় তাদের রাজকন্যা দেজা থোরিসের ভালোবাসা। কার্টারের গল্প প্রকৃতপক্ষে উদীয়মান আমেরিকার বিশ্বজয়ের গল্প, যেখানে এক শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিজয়গাথা রচিত হয় মহাশূন্য পেরিয়ে সুদূর মঙ্গলগ্রহে। বারোজের এই গল্পকে বলা যায় ‘স্পেস ওয়েস্টার্ন’, আপামর আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের মনে তা উসকে দেয় পৃথিবী অতিক্রম করে মহাশূন্যের অন্তিম সীমানা জয় করবার স্বপ্ন। বারোজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে আমেরিকায় বেরোতে থাকে একের পর এক স্পেস অ্যাডভেঞ্চারের উপাখ্যান, বাক রজার্স বা ফ্ল্যাশ গর্ডনরা আত্মপ্রকাশ করে খবরের কাগজের পাতায় ছাপা কমিক স্ট্রিপে। জনপ্রিয় আ সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার সিরিজের (গেম অফ থ্রোনস টিভি সিরিজের উৎস) স্রষ্টা জর্জ আর আর মার্টিনের মত একাধিক লেখক ছেলেবেলা থেকে তাঁর মনে এ ধরনের রচনাগুলির প্রভাবের কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন।
গ্রহান্তরের অভিযান কাহিনি পরবর্তীকালে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে নানা দেশে, এই বাংলাতেই তা স্থান পেয়েছে প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ একাধিক লেখকের কল্পবিজ্ঞান-ধর্মী রচনায়। ষাটের দশকে মার্কিন মুলুকে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে গ্রহান্তরের অভিযানমূলক সিরিজ স্টার ট্রেক, যার নির্মাতা জাঁ রডেনবেরির মূল লক্ষ্য ছিল বৈচিত্র্যময় সমাজ ও সংস্কৃতির পক্ষে সওয়াল করা। একই বার্তা পাওয়া যায় মার্ভেল কমিকসের অধুনা জনপ্রিয় স্পেস অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ গার্ডিয়ানস অফ দ্য গ্যালাক্সিতেও। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের এক শ্বেতাঙ্গবাদীর সঙ্কীর্ণ বৈষম্যমূলক দর্শনের হাত ধরে শুরু হয়েছিল যে রচনাধারার, শিল্পের অমোঘ নিয়মে সময়ের সাথে সাথে তার এই পরিবর্তন সত্যিই আগ্রহ জাগায় বইকী!
*[কভার ছবি - জন কার্টার ও দেজা থোরিস।] *[ছবি ২ - জন কার্টারের পরে : 'স্টার ট্রেক' সিরিজে ক্যাপ্টেন জেমস কার্ক ও 'গার্ডিয়ানস অফ দ্য গ্যালাক্সি' সিরিজে পিটার ক্যুইল ওরফে স্টার-লর্ড।]
#