বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে ম্যাকগাফিন
‘শেয়াল-দেবতা রহস্য’-র বদলে যদি সত্যজিৎ লিখতেন ‘ঈগল-দেবতা রহস্য’, তফাত ঠিক কতটা দাঁড়াত? মৃত্যুর বা পাতালের দেবতা আনুবিসের জায়গায় যদি নীলমণি সান্যালের নজর পড়ত আকাশের দেবতা হোরাসের ওপর, ঠিক কতটা তফাত হত? ইতরবিশেষ না আকাশপাতাল? সচেতন পাঠক এখনই হাঁ-হাঁ করে উঠবেন, বলবেন হোরাসের মাথা মোটেই ঈগলের নয়, বরং বাজপাখির। ঠিক কথা, তবে ‘বাজ-দেবতা’ শব্দবন্ধটি শিরোনামকে জমজমাট করে তুলছে না বলেই ঈগল লিখলাম। রহস্যকাহিনির শিরোনাম থেকে শুরু করে সঙ্গের অলংকরণ– পাঠকের মুডকে উত্তুঙ্গে নিয়ে যেতে প্রতিটি আঙ্গিকই গুরুত্বপূর্ণ। সন্দেশের খুদে পাঠকদের জন্য সত্যজিৎ যখন শেয়াল-দেবতার গল্প লিখছেন, নিশ্চিতভাবেই এই প্রতিটি আঙ্গিক নিয়ে তাঁর মাথায় চিন্তাভাবনা চলছিল। ঠাসবুনোট শিরোনামই হোক বা মৃত্যুর কালোত্তীর্ণ রহস্যময়তা, শেয়াল-দেবতাকে বেছে নেওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি আনুবিসের বদলে হোরাসকে নিয়ে আসি সে গল্পে, পাঠকের আবেগ বা অনুভূতি খুব যে ধাক্কা খাবে এরকমটি মনে করার বিশেষ কোনও কারণ নেই। সত্যজিৎ-এর গল্পে আনুবিস যে একটি ধ্রুবসত্য হয়ে দেখা দিয়েছেন তা তো নয়– গল্পটি অন্য যে-কোনো মিশরীয় দেবমূর্তিকে নিয়েও ঠিক একইভাবে লিখে ফেলা যেত।
আনুবিস নেহাতই একটি সাহিত্যিক তূণ, গল্পটিকে তরতরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সত্যজিৎ এ অস্ত্রের ওপর বিশেষ ভরসা রেখেছেন। পাশ্চাত্য গোয়েন্দাসাহিত্যে যে অস্ত্র তিনের দশক থেকেই বারবার ব্যবহৃত হবে খোদ আলফ্রেড হিচককের হাতে। এই সাহিত্যিক কারিকুরির একটি নামও রেখেছিলেন হিচকক– ম্যাকগাফিন। কেন ম্যাকগাফিন? কোনও কারণ নেই! নেহাতই হিচককীয় রসিকতা। ম্যাকগাফিন না হয়ে ম্যাকলাস্টার, ম্যাকলাকহান, হিচকক বা রায়-ও হতে পারত। কারণ হিচককের মতে ম্যাকগাফিনের কোনও মানেই নেই । আদতে শব্দটি একটি স্কটিশ পদবিকে বোঝায় কিন্তু তার সঙ্গে সাহিত্যের কোনও যোগসূত্রই নেই। ঠিক যেরকমভাবে নিবিড় কোনও যোগ নেই ম্যাকগাফিনের সঙ্গে গল্পের প্লটের- এক নম্বর ম্যাকগাফিনকে বাদ দিয়ে দু নম্বর ম্যাকগাফিনকে নিয়ে এলেও সে প্লট বদলায় না।
শুনে মনে পারে যে কোনও দুর্মূল্য বস্তু মাত্রই গোয়েন্দাগল্পের ম্যাকগাফিন। আর-একটু খতিয়ে দেখা যাক তাহলে। শরদিন্দুর ‘রক্তমুখী নীলা’ কি ম্যাকগাফিন? অন্য যে-কোনো জহরত কি রক্তমুখী নীলার জায়গা নিতে পারে? গল্পে ব্যোমকেশের ভাষ্যেই আমরা শুনি ‘’নীলা হচ্ছে শনিগ্রহর পাথর… নীলার প্রভাব কখনও শুভ কখনও বা ঘোর অশুভ’’। যারা গল্পটি পড়েছেন তাঁদের নিশ্চয় মনে পড়বে নীলার এই অতিলৌকিক প্রভাবের সূত্র ধরেই ব্যোমকেশ অপরাধীর মনে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে রত্নটি উদ্ধার করবে। এই শুভাশুভ কারণেই নীলাটির বদলে অন্য যে-কোনো জহরত লেখকের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। রক্তমুখী নীলা যে শুধু গল্পের কার্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাই নয়, পাঠকের মনস্তত্ত্বেও একটি নিশ্চিত দাগ রেখে যাচ্ছে। তবে শরদিন্দুরই আর-এক রত্ন ‘সীমন্ত-হীরা’ নিশ্চিতভাবেই ম্যাকগাফিন। হীরার বদলে মুক্তো থাকলেও গল্পের মূল ভাবটির বিন্দুমাত্র হেরফের হত না। হেরফের হত না ব্যোমকেশের ডিডাকশনে, হেরফের হত না স্যার দিগিন্দ্রনারায়ণের অপরাধপ্রবণতায়।
বাঙালির সবথেকে আপন দুই গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে বসলে সম্ভবত দেখা যাবে ব্যোমকেশের থেকে ফেলুদার গল্পে ম্যাকগাফিনের উপস্থিতি অনেক বেশি। কৈলাস চৌধুরীর পাথর থেকে শুরু করে রবার্টসনের রুবি, প্রদোষ মিত্রের কেরিয়ারের শুরু থেকে শেষ অবধি সত্যজিৎ ম্যাকগাফিনকে অবলম্বন করে পাঠকের মন জয় করতে চেয়েছেন। এবং ফেলুদার দেশকালজয়ী জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে দেয় ম্যাকগাফিনের বহুল ব্যবহারেও পাঠককুল রোমাঞ্চরস থেকে বঞ্চিত নাই হতে পারেন। প্রশ্ন হল তাহলে ম্যাকগাফিন নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারটাই বা কী? দরকার তখনই পড়ে, যখন উৎসুক পাঠক নির্দিষ্ট কোনও লেখকের লেখনীবৈচিত্র্য বা লেখার ধারাকে খুঁটিয়ে বুঝতে চান। ফেলুদার যে কালোত্তীর্ণ অ্যাপিল, তার চাবিকাঠির হদিশ পেতে গেলে সত্যজিৎ-এর লেখার স্টাইলটিকে বিশ্লেষণ করা আবশ্যিক। কিছু এক্স-ফ্যাক্টর, কিছু লেখকনির্দিষ্ট ব্ল্যাক-বক্স নিশ্চয় থাকবে যাকে অনুকরণ করা অসম্ভব। কিন্তু তার পরেও কিছু সুলুকসন্ধান হয়তো পাওয়া সম্ভব। ফেলুদার গল্প নির্মেদ, অনেকাংশে সিনেম্যাটিক, সম্পূর্ণভাবে নারীচরিত্র বর্জিত হওয়ায় একাধিক আবেগের টানাপোড়েনকে সযত্নে পাশ কাটাতে পেরেছে– এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলিকে হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর ঠিক একই কারণে সত্যজিৎ-এর গল্পে ম্যাকগাফিনের বহুল উপস্থিতি নিয়েও চর্চা হওয়া উচিত।
যে রহস্যকাহিনিতে সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রাধান্য পায় না, সেখানে ম্যাকগাফিনের উপস্থিতির সম্ভাবনা অনেক জোরালো। ব্যোমকেশের তুলনায় ফেলুদার গল্পে যে ম্যাকগাফিনের সংখ্যা বেশি, তার পেছনে কিছুটা কার্যকারণ সম্পর্ক নিশ্চয় আছে। নারীচরিত্র বর্জিত, কিশোরপাঠ্য গল্পের লেখককে যে এহেন সাহিত্যিক কারিকুরির শরণাপন্ন হতে তাতে আর আর্শ্চয কী? পুরোদস্তুর অ্যাডাল্ট গল্পে লেখকের স্বাধীনতা অনেক বেশি। কিন্তু তারপরেও ভাবার বিষয় আছে– ম্যাকগাফিন কি শুধুই জড় পদার্থ? নাকি রক্তমাংসের চরিত্রও ম্যাকগাফিন হয়ে উঠতে পারে? সাহেবি ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘স্টিরিওটিপিক্যাল’, সেরকম বাঁধাধরা চরিত্ররা যদি একটি সিরিজে প্রাধান্য পায় তারও সূত্রপাত কি ম্যাকগাফিনের হাত ধরেই?
পুঁটিরাম, জংলি, শ্রীনাথ– নামগুলি চেনা চেনা ঠেকছে নিশ্চয়? ব্যোমকেশ, কিরীটী, ফেলুদার গল্পে এঁদের ভূমিকা গৃহসহায়কের। এবং এঁরা কেউই পিজি উডহাউসের বিখ্যাত ভ্যালে (valet) জিভস নন, প্রায় প্রতিটি গল্পেই চরিত্রগুলি চা বা চানাচুর আনা ছাড়া আর বিশেষ কোনও কাজ করেন না। কেউ বলতেই পারেন জিভসের সঙ্গে পুঁটিরামদের তুলনা করাটা অন্যায়, কারণ উডহাউসের গল্পে জিভস কেন্দ্রীয় চরিত্র। সংগত কথা, এবং সেহেন তুলনা আমি করছিও না। কিন্তু বাকি বক্তব্য রাখার আগে জংলিদের গল্প থেকে আমি কয়েকখানা লাইন আপনাদের শোনাতে চাই।
‘ ‘’চায়ের কথা ও আগেই বলেছে’’… বলতে বলতে জংলি চায়ের ট্রে হাতে ঘরে প্রবেশ করল।‘ (ঘুম ভাঙার রাত, নীহাররঞ্জন গুপ্ত)
‘ভৃত্য পুঁটিরাম তাড়াতাড়ি স্টোভ জ্বালিয়া চা তৈয়ার করিয়া আনিল। গরম পেয়ালায় চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ বলিল…’ (সত্যান্বেষী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)
‘চারটের সময় যখন শ্রীনাথ চা আনল, তখনও ফেলুদা ঘর থেকে বেরোল না।‘ (সমাদ্দারের চাবি, সত্যজিৎ রায়)
সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটের ওপর বাক্যগুলির গঠনশৈলী একইরকম, বিশেষত যে জায়গাগুলিতে গৃহসহায়ক চরিত্রগুলি নির্দিষ্ট কোনও কাজ সম্পন্ন করছে। কিন্তু শুধু তাই নয়, জংলি বা পুঁটিরামরা এই বাক্যগুলিতে নিছকই filler, তাদের কাজের অব্যবহিত আগে বা পরে গল্পগুলির কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ কিরীটী বা ব্যোমকেশ বা ফেলুদারাই প্রাধান্য পাচ্ছে। অধিকাংশ সময়ে গোয়েন্দাদের বাক্যালাপের মাঝখানে, কখনো-সখনো তাদের সহকারীদের (যেমন সুব্রত, অজিত বা তোপসে) কথকতার মাঝে শ্রীনাথদের আবির্ভাব। অর্থাৎ বাক্যশৈলী হোক বা গল্পের খেই– গৃহসহায়ক চরিত্রগুলি লেখকদের একটি নির্দিষ্ট অভিপ্রায় পূরণ করছে মাত্র। পাঠকদের অনুভূতি বা মনস্তত্ত্বে এদের কার্যকলাপের কোনও অভিঘাতই নেই।
তাঁর সিনেমায় ম্যাকগাফিন কীভাবে এসেছে বোঝাতে গিয়ে হিচকক জানিয়েছিলেন এ এমন এক বস্তু যে নিয়ে সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি বিশেষ মাথা ঘামালেও, দর্শক আদপেই ভাবিত নন। অর্থাৎ, দর্শক বা পাঠকের নজর মূলত থাকবে ফেলুদা লখনউতে কী করে বেড়াচ্ছে তার ওপর, শেষমেশ বাদশাহী আংটি উদ্ধার হল না বাদশাহী মোহর সে নিয়ে আমরা চিন্তাকুল হয়ে পড়ি না। এখন ফেলুদা বাদশাহী আংটি নিয়ে যতটা মাথা ঘামাবে, ঘড়ির কাঁটা ধরে শ্রীনাথ চা নিয়ে এল কি না সে নিয়ে সম্ভবত অতটাও গ্রে-ম্যাটার খরচ করবে না। পাঠকদের মতন কেন্দ্রীয় চরিত্ররাও গৃহসহায়কদের নিয়ে মোটের ওপর নির্বিকার- এই একটিমাত্র কারণেই শ্রীনাথদের চরিত্রগুলিকে ম্যাকগাফিন বলা যাবে না। হিমানীশ গোস্বামীর ‘বাঘাকাকা’-র মতন চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বিরল- যিনি গেরস্থালির কাজকর্ম সামলেও নিছক গৃহসহায়ক নন, যাঁর বিশ্লেষণী ক্ষমতা হোক বা রসিকতা, পাঠককে মজলিশি রসে জারিয়ে রাখে। সেই বাঘাকাকাও কিন্তু ম্যাকগাফিন নন, কারণ গল্প বাঘাকাকার জন্য এগোয় না, বরং গল্প এগোলে বাঘাকাকা আসেন (তিনি মূলত গোয়েন্দার সহকারী, কখনো-সখনো নিজেও গোয়েন্দা)।
গল্পে ম্যাকগাফিনের গুরুত্বটুকু বোঝানোর জন্যই গৃহসহায়কদের নিয়ে আলোচনাটা জরুরি ছিল। পাঠকরা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে ম্যাকগাফিন, সে বস্তুই হোক বা ব্যক্তি, অবশ্যই গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ, ম্যাকগাফিনকে কেন্দ্র করে গল্পটি আবর্তিত হবে আবার একইসঙ্গে নির্দিষ্ট ম্যাকগাফিনকে বদলে অন্য আরেকটি ম্যাকগাফিন নিয়ে এলেও গল্পের মূল রসটি অক্ষুণ্ণই থাকবে।
ব্যক্তি ম্যাকগাফিনদের চট করে নজরে পড়ে অন্তর্ধান রহস্যগুলিতে, যেখানে গোয়েন্দার সঙ্গে তাদের ম্যাকগাফিনদের দেখা হয় একেবারে গল্পের শেষে। তাদের খুঁজে পাওয়ার রহস্যযাত্রাতেই পাঠকের মন মজে থাকে, সে যাত্রার শেষে ঠিক কে আবির্ভূত হলেন সেটি বড়ো কথা নয়। ফেলুদার গল্পগুলির মধ্যে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাকগাফিন হলেন ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’-র সেই সন্ন্যাসী ভবানী উপাধ্যায়। ভবানী উপাধ্যায়ের সঙ্গে ক্লাইম্যাক্সীয় সাক্ষাৎ-এ জানা যায় তিনি আসলে লালমোহনবাবুর ছোটকাকা দুর্গাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্তু গল্পে তাঁকে ফেলুদার হারিয়ে যাওয়া বড়োমামা বানালেও আদৌ কোনো সমস্যা হত না। সময়বিশেষে অবশ্য ব্যক্তি ম্যাকগাফিনকে খুঁজে পাওয়া অত সোজাসাপটা কাজও নয়। অপরাধীর মোটিভটি উন্মোচিত হলে তবেই বোঝা যায় ম্যাকগাফিন আছে না নেই। যেমন ধরুন ‘শজারুর কাঁটা’ গল্পের অন্যতম মুখ্য চরিত্র দেবাশিস, যিনি আততায়ীর হাত থেকে বেঁচে গেছিলেন তাঁর হার্ট বাঁদিকের বদলে ডানদিকে ছিল বলে। গল্পের একেবারে শেষে গিয়ে জানা যায় দেবাশিসকে খুন করতে চেয়েছিল তাঁর স্ত্রী দীপার প্রাক্তন প্রেমিক। ব্যোমকেশ জানায় বিত্তশালী দেবাশিসকে খুন করে তার বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করাই ছিল আততায়ীর মূল উদ্দেশ্য। গল্পে এও দেখা যায় যে দেবাশিসের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই তাঁর সঙ্গে দীপার প্রাক্তন প্রেমিকের আলাপ হয়, অর্থাৎ এই দুই চরিত্রের মধ্যে কোনও পূর্বতন সম্পর্ক (বন্ধুত্বর বা শত্রুতার) ছিল না। সবদিক খতিয়ে দেখলে মনে হতেই পারে দেবাশিসের জায়গায় অন্য কোনও সুপাত্র এলেও দীপার প্রেমিকের মোটিভটি অক্ষুণ্ণ থেকে যেত। সেই হিসাবে দেবাশিস চরিত্রটিও ম্যাকগাফিন হয়ে ওঠার যোগ্য দাবিদার!
মোটিভ এবং ম্যাকগাফিনের সম্পর্ক সত্যিই গভীর। ‘শজারুর কাঁটা’ গল্পেই ফেরা যাক। গল্পের শেষে ব্যোমকেশের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি ছোরাছুরি ছেড়ে শজারুর কাঁটা বেছে নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হল আততায়ী জানাতে চেয়েছিল সবকটি খুন একটিমাত্র লোকই করছে। কিন্তু শুধু সেই মোটিভ ধরলে শজারুর কাঁটা বদলে গ্রামোফোনের পিনও ব্যবহার করাই যায়, যেমনটি করেছিল শরদিন্দুর আর-এক বিখ্যাত গল্প ‘পথের কাঁটা’র খলনায়ক প্রফুল্ল রায়। বাস্তবেও তথাকথিত ‘স্টোনম্যান’ পাথর ব্যবহার করে একাধিক খুন করেছে, সে যে সিরিয়াল কিলার সেই পরিচয়টি আমজনতাকে জানানোর জন্য। এই আলোচনা থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে খোদ ‘শজারুর কাঁটা’-ই একটি ম্যাকগাফিন কি না? এবং এক্ষেত্রে উত্তর ‘না’ হওয়ার কোনও যুক্তিসংগত কারণ দেখা যাচ্ছে না।
সত্যি বলতে কী, হিচকক নিজে হয়তো ‘শজারুর কাঁটা’কে যথার্থ ম্যাকগাফিন বলেই অভিহিত করতেন। কারণ হিচককের মতানুসারে যে ম্যাকগাফিন যত বেশি অর্থহীন বা যত বেশি অবাস্তব, সে ম্যাকগাফিনের প্রয়োগ তত বেশি প্রশংসনীয়। তবে শরদিন্দু হত্যা-হাতিয়ারের এই চমকটিকে গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন, যে কারণে গল্পের শিরোনামটিও ‘শজারুর কাঁটা’। হিচকক নিজে এ গল্প লিখলে সম্ভবত এই প্রায় অবাস্তব হাতিয়ারটির ওপর পাঠককে খুব বেশি মনঃসংযোগ করতে দিতেন না, কারণ হিচককের দুনিয়ায় ম্যাকগাফিনরা কাজ করে নীরবে, নিভৃতে। কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’ থেকে ‘সাইকো’-র মতন একাধিক চলচ্চিত্রে হিচকক ম্যাকগাফিন নামক আইডিয়াটি ব্যবহার করেছেন ইচ্ছাকৃত ভাবে, যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে। ম্যাকগাফিন বিষয়টির সঙ্গে শরদিন্দুর সম্যক পরিচয় ছিল কি না সে নিয়ে বিশেষ সন্দেহ থেকে যায়, এবং সে কারণে বলা যেতেই পারে শরদিন্দুর গল্পে ম্যাকগাফিনের ব্যবহার মূলত অনিচ্ছাকৃত। তাই শজারুর কাঁটাকে হাতিয়ার হিসাবে দেখার যথেষ্ট জোরালো মোটিভ থাকা না সত্ত্বেও শরদিন্দু স্রেফ আইডিয়ার নতুনত্বের কারণে একে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছেন। আবার সত্যজিৎ-এর মতন চলচ্চিত্রবোদ্ধা সম্ভবত ম্যাকগাফিনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তার পরেও একাধিক গল্পে তাঁর ম্যাকগাফিনগুলি যেভাবে গল্পের শিরোনামে ঠাঁই পেয়েছে তা হিচককীয় ফিল্মদর্শনের পরিপন্থী। দুটি সম্ভাবনা উঠে আসে– চমকদার শিরোনাম সত্যজিৎ-এর প্রায়োরিটি লিস্টে বেশ ওপরে আসে অথবা শরদিন্দুর মতন সত্যজিৎ-এর গল্পেও ম্যাকগাফিনের ব্যবহার অনিচ্ছাকৃত।
ম্যাকগাফিনের অনিচ্ছাকৃত ব্যবহার পৌনঃপুনিক হয়ে পড়লে কিছুটা অনিচ্ছাকৃত হাস্যরসেরও উদ্রেক ঘটে, চরিত্রগুলিও খানিক স্টিরিওটিপিক্যাল হয়ে পড়ে। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে একটি যথাযথ উদাহরণ হতে পারে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’দের অভিযানগুলি। একাধিক প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়ে এনিড ব্লাইটনের ফেমাস ফাইভের এই বঙ্গীয় সংস্করণটি গোগ্রাসে পড়েছে। রসিক পাঠকরা তাঁদের কৈশোরের সুখস্মৃতির দিকে ফিরে তাকালে বুঝতে পারবেন হাওড়ার এঁদো গলির ছেঁদো মস্তানই হোক অথবা ভিন রাজ্যের দুর্দান্ত সব ডাকাত, পাণ্ডব গোয়েন্দাদের দুর্ধর্ষ দুশমনদের অধিকাংশই ম্যাকগাফিন বিশেষ। যে কারণে শুরুর দিকের পাণ্ডব গোয়েন্দাদের গল্পে বেশ কিছু খলনায়ক বেনামি। তবে হিচককের যে ফিল্মদর্শনের কথা একটু আগে বলছিলাম, সেই দর্শনের প্রেক্ষিতেই ষষ্ঠীপদবাবুর ম্যাকগাফিনরা কিছু কাজ অন্তত সুচারুভাবে করে। লেখক বা চলচ্চিত্র-পরিচালকরা বহু সময়েই ম্যাকগাফিন নিয়ে আসেন পাঠক বা দর্শকের মনোযোগ একটি বৃহত্তর সমস্যার ওপর নিবদ্ধ রাখতে। পাণ্ডব গোয়েন্দা তো বটেই, ষষ্ঠীপদবাবুর অন্য কিশোর উপন্যাসগুলি (যেমন কাকাহিগড় অভিযান বা দুরন্ত তপাই) যে পাঠকরা পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় দেখেছেন যে সত্তর-আশির দশকের মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মাদের চিরন্তন দুশ্চিন্তাগুলি এসব লেখার বারেবারে উঠে এসেছে। অপদার্থ পুলিস-প্রশাসন, ক্রমবর্ধমান কর্মহীনতা এবং তজ্জনিত অপরাধ, সামাজিক অবক্ষয় এহেন হাজারখানা সমস্যায় জর্জরিত বাঙালির দৈনন্দিন আতঙ্কগুলিকে তাঁর পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে ষষ্ঠীপদবাবুর ম্যাকগাফিনরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। তারা বেনামি এবং পরিহার্য বলেই পাঠক তাদের ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আতঙ্কের রেশটুকু ঠিক থেকে যায়।
শেষ করি দুটি বিশেষ গল্পের প্রসঙ্গ ধরে। শরদিন্দুর ‘অচিন পাখি’ কি মনে আছে আপনাদের? রিটায়ার্ড পুলিস অফিসার নীলমণি মজুমদারের কাছে শুধু গল্প শুনেই যেখানে ব্যোমকেশ অপরাধীকে ধরে ফেলবে। অকুস্থলে না থেকেও, সন্দেহভাজনদের না দেখেও ব্যোমকেশের সে রহস্যভেদে অসুবিধা হয়নি। ন্যারেটিভ স্টাইল অর্থাৎ আখ্যানশৈলীর দিক থেকে খানিক একই গোত্রে পড়ে সত্যজিৎ এর ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’, সে গল্পে ফেলুদাও সন্দেহভাজনদের সঙ্গে মুখোমুখি বসার সুযোগ পায়নি। জটায়ু ও তোপসের মৌখিক রিপোর্ট থেকেই ফেলুদার হাতে ধরা পড়েছে অপরাধী। কিন্তু ‘অচিন পাখি’তে অপরাধী শাস্তি পায় না, কারণ গল্পকার নীলমণি মজুমদার নিজেই সেখানে অপরাধী। ব্যোমকেশ যে তাঁকে ধরে ফেলেছে সে কথা বোঝামাত্র তাঁকে উঠে পড়তে হয়। গোয়েন্দা গল্পের চিরাচরিত আখ্যানশৈলীতে এ গল্প রচিত হলে কিন্তু নীলমণিবাবুর হাজতবাস বা আরও কোনও কঠোর শাস্তি ছিল অনিবার্য। ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’ গল্পের পরিণতি কিন্তু আদৌ আখ্যানশৈলীনির্ভর নয়- ফেলুদা স্বয়ং সন্দেহভাজনদের মুখোমুখি হলেও ডিডাকশন পদ্ধতিটি একই থাকত। অপরাধীর মশলা নেওয়ার অভ্যাসটি ফেলুদা নিজের চোখে দেখলেও যা ঘটত, বাস্তবেও তাই ঘটেছে। দেখা আর শোনার আক্ষরিক তফাত এ গল্পের পাঠকের অনুভূতি বা মনস্তত্ত্বে আদৌ কোনও প্রভাব ফেলে যায় না। কেন তুললাম এই দুটি গল্পের প্রসঙ্গ? কারণ শুধু বস্তু বা ব্যক্তি নয়, আখ্যানশৈলীর মতন বিমূর্ত একটি বিষয়ও যে ম্যাকগাফিন হয়েই উঠতে পারে!
......................
#ফেলুদা #সত্যজিৎ রায় #গোয়েন্দা #প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়