অন্ধকার পথে একলা হাঁটার স্বাধীনতা চেয়ে…
চারিদিকের পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, কর্মজীবনের দশ বছর পার করে ফেলেও যে অফিসে নিরাপত্তা নিয়ে কখনও কোনোরকম আশঙ্কার মুখোমুখি হতে হল না, সেটা এ পোড়া দেশে এক সৌভাগ্য বটে। অথচ যা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। যা একান্তই মৌলিক অধিকার। অথচ যে-কোনো কর্মক্ষেত্রে সেই স্বাভাবিক অধিকারটুকু পেলেই নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়।
কর্পোরেট সেক্টরের সব ক্ষেত্রে কী হয় জানি না, তবে আমাদের অফিসগুলোতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রত্যেকের কাছে খোঁজ নেওয়া হয় তারা অফিসে কোনোরকম বৈষম্যের শিকার কি না। ম্যানেজারেরা রীতিমতো চাপে থাকেন এ বিষয়ে। কোভিডের পর থেকে রাত করে অফিস থেকে ফেরার পাট নেই। যেদিন রাত পর্যন্ত কাজ থাকে, সেদিন হয় বাড়ি থেকেই কাজ করি, না হলে অফিসে যেতে হলেও বিকেল বিকেল ফিরে আসি। পূর্ব অভিজ্ঞতায় অবশ্য রাতের অফিসে কাজ করাও রয়েছে। এর আগে যে সংস্থায় ছিলাম, সেখানে রাত ন'টার পর অফিস থেকে বেরোলে প্রত্যেক লেডি অ্যাসোসিয়েটকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। লাস্ট ড্রপ কোনও মহিলা অ্যাসোসিয়েটের হলে ক্যাবে একজন করে সিকিউরিটির লোক থাকাই ছিল নিয়ম। কারও বাড়ি গলির মধ্যে হলে সেই সিকিউরিটির ভদ্রলোকের দায়িত্ব ছিল হেঁটে বাড়ির দরজা অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসা।
মোটামুটি প্রথম সারির সমস্ত আইটি কোম্পানিতে ছবিটা এক। তবে এই ঝকঝকে এমএনসি কালচারের ছায়া সবটা ঢাকতে পারত না। পারেনি।
তখন আমি সদ্য পুনে থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়েছি। বয়স আরও খানিক কম, চোখে আরও অনেক বেশি স্বপ্ন। তার উপরে অন্য একটা শহরে সম্পূর্ণ একা থাকার অভিজ্ঞতা সদ্য জমা হয়েছে ঝুলিতে। কলকাতার অফিসটা ছিল আমার নৈহাটির বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগত। গোটা সপ্তাহ তাই পিসির বাড়ি থেকে যাতায়াত করে একেবারে শুক্রবারে বাড়ি ফিরতাম। অফিস থেকে যত তাড়াতাড়িই ফিরি, নৈহাটি স্টেশনে ঢুকতে ঢুকতে রাত দশটা বেজে যেত। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, ঝকঝকে তকতকে, আর পাঁচজনের হিংসে জাগানোর মতো সুসজ্জিত অফিসের ডেস্কে বসে সারাদিন দেশবিদেশের ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং করে কাজ বুঝে এবং বুঝিয়ে, ঝাঁপ বন্ধ করে যখন বাড়ির পথে হাঁটা দিতাম, আমার আকাশচুম্বী কনফিডেন্স তখন থেকেই টাল খেতে শুরু করত। স্টেশনে নামতে নামতে তো মফস্সলে রাত, তখন একা একা ফিরতে হবে যে! একটা শহরে একা থাকার সময় কখনও যা হয়নি, সেই মুহূর্তে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে ব্যাগ গুছিয়ে একা যেতে হলে যেটা হত না, সেই অদ্ভুত ভয়টা আমার তখন বাড়ি ফেরার সময় হত। কী আশ্চর্য না?! ভীষণ লজ্জা হত, তাও ট্রেন ব্যারাকপুর পেরোনোর পর মাকে ফোন করে দিতাম। মা স্টেশনে এলে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে ফিরতাম।
একদিন হয়তো আলোয় চলা মেয়েদের অন্ধকার রাস্তায় চলার জন্য সঙ্গী খুঁজতে হবে না বা দল বাঁধতে হবে না। তদ্দিন অন্তত এই অক্ষমতার লজ্জাটা সবার হোক। শুধু চলাটুকু যেন বন্ধ না হয়।
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান
যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ
অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী
আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত
চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী