লকডাউন ও মানসিক স্বাস্থ্য
প্রতি একশো বছরে একবার যে মহামারী আসে আমরা সকলে তার কবলে পড়েছি। আশার কথা এই যে আমাদের পৃথিবী যুদ্ধ, মহামারী, মন্বন্তর, দেশভাগ সবটাই দেখেছে এর আগে। তবে আমাদের প্রজন্ম এমন সরাসরি এগুলোর প্রভাব এত তীব্রভাবে আগে বুঝতে পারেনি।
এখন এমন পরিস্থিতি, কারুর পাশে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকার উপায় নেই। নিশ্চিন্তে কাঁধে মাথা রাখবার পর্যন্ত জো নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ। স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। বহু মানুষের চাকরি নেই। কারুর বেতন অর্ধেক করা হয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য রেল পরিষেবা বন্ধ। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে বহু মানুষ কর্মস্থলে থেকেই কাজ করছেন। সরকারি-বেসরকারী ক্ষেত্র থেকে শুরু করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীরা সবাই নিজের মতো করে বিভিন্ন অসুবিধায় ভুগছেন। এমন ভয়াবহ সময় কোনোদিন আসবে, যেখানে পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পোকাও মানুষের থেকে বেশী শক্তিশালী প্রতিপন্ন হবে, কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি আমরা।
১০ফুট বাই ১০ ফুটের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে আমাদের দিন কাটছে। সারাদিন অভ্যেসের বশে শুধু খাওয়া, ঘুম, টিভি বা মোবাইলের নিউজ অ্যাপ খুলে বসে থাকা, হোয়াটস অ্যাপ - ফেসবুক স্ক্রলিং। অনিদ্রা, দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তাহীনতা এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী। শারীরীক-মানসিক-অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই আমরা ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই এই পরিস্থিতির মাশুল গুনছে।
তবে আমি বলব পাঁচ থেকে তিরিশ বছর বয়স্ক মানুষ-জনের কথা। কলেজে অধ্যাপনার সূত্রে অনেকক্ষেত্রেই ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিং করতে হয় । সেই অভিজ্ঞতা থেকে, ভালো থাকার কিছু উপায় বলবার চেষ্টা করছি ।
এই বয়সসীমা বেছে নেওয়ার কারণ, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ যে পৃথিবী নামক এক পেল্লায় দুনিয়ায় পদার্পণ করেছে তা বুঝেই উঠতে পারেনা। গড়পড়তা বিচারে, মোটামুটি তিরিশের পর নিরানব্বই শতাংশ মানুষ তার রুটি-রুজির পথ খুঁজে নেয়। সময়সীমাটা অনেক বড় । তাই এই সময়সীমাকে আমি দুটো ভাগে ভাগ করে নিচ্ছি | পাঁচ বছর থেকে পনেরো বছর, আর পনেরো থেকে তিরিশ বছর।
এই লকডাউনে পাঁচ থেকে পনেরো বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশী বিপন্ন বলে আমার মনে হয়েছে। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা বলব। কারণ যাদের বাড়ি নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, অথবা যিনি উচ্চবিত্ত বাড়ির একমাত্র সন্তান, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এই বয়সসীমার বাচ্চারা স্কুলকেন্দ্রিক জীবন ভুলে যেতে বসেছে। তাদের না আছে খেলার মাঠ , না আছে টিউশন, না আঁকার ক্লাস, না নাটকের রিহার্সাল। কিচ্ছু নেই। সন্ধ্যে হলে ডাকনাম ধরে ডাকাডাকিও বন্ধ এখন। এর মধ্যে স্বয়ং ঈশ্বরই বা ভালো থাকার কী উপায় বাতলাবেন আমার জানা নেই। তবু এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে বলা হয়েছে বলে, আমি বলব বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে অবশ্যই সময় কাটান। ক্যারাম, লুডো, তাস, দাবা যা হোক। ওদের নিয়ে ছাদে বসেই একদিন না হয় ডিনার সারলেন। হালকা আলোয়, ওডোমস মেখে রাতের রুটি দুটো সাবাড় করলেন। টবে গাছের চারা লাগিয়ে দিন। তাদের যত্ন করতে শেখান। সার বানাতে শেখান। রঙীন মাছের জার কিনে দিতে পারেন। অবলা প্রাণীগুলোর দায়িত্ব নিতে শেখান।
একটু বড় বাচ্চাদের মাইক্রোওভেনে চা বা স্ন্যাকস গোছের কিছু রান্না করা শেখাতে পারেন। তার জন্যে হিটপ্রুফ গ্লাভস কিনে দিলেন। বয়স বছর দশেক হলে যথাযথ প্রোটেকশন দিয়ে টুকটাক বাজারে পাঠাতে পারেন । তবে তার আগে ব্যস্ত-রাস্তা পার হওয়া শেখাতে হবে। নিজের জামা-কাপড়ের মধ্যে যেগুলো ওর প্রিয় তারই কয়েকটা যত্ন করে কেচে ইস্ত্রি করতে শেখাতে পারেন। ওর নিজের বইয়ের তাকের ধুলো ঝেড়ে রাখতে বলুন। একটা রুটিন বানিয়ে দিন। সেখানেও নিয়ম-ভাঙার একটা সময় থাকুক। তা না হলে দম আটকে আসবে। ওই সময়টায় যা প্রাণ চায় করুক ।
হাতে হাতে শিখুক ঘরের কাজও । গল্পের বই পড়া, গান, আবৃত্তি, পিয়ানো শেখানো ইত্যাদি আলাদা করে আর বললাম না। ওগুলো সবাই জানে আর অভ্যেসও করে। অ্যাবাকাসের অঙ্ক, স্পোকেন ইংলিশ এইসবের চক্করে জীবন কি করে গোছাতে হয়, তা শেখানো হয় না। তাই অনেকসময় আমরা বাড়িতে বসে রীতিমত দায়িত্ব নিয়ে অসম্ভব গুণী , অ্যাকাডেমিকালি সাউন্ড এক-একটি কিম্ভূত মানুষ তৈরি করে ফেলি।
শেষে এই বয়ঃসীমার জন্য খুব দরকারি একটা কথা। রাতের আকাশ দেখতে শেখান। বিশ্বাস করুন, এটা খুব কাজের। এই চার দেয়ালের বন্দীদশার মাঝে লোকজনের নীচতা, কাছের মানুষজনের অসহযোগিতা; পার্টি,গ্রুপিং, সংসার,বন্ধু, স্কুল, এসবের ঊর্ধেও যে অসীম আকাশ আছে এবং এমনি তার বিরাটত্ব যে সেখান থেকে হাজার উঁকি মেরেও মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় না, সেটুকু অন্তত প্রতিদিন উপলব্ধি করুক। নিয়ম করে ইউটিউবে গ্রহ-নক্ষত্রের ভিডিও দেখাতে পারেন। নিয়মিত অভ্যেসে মানসিকতা বদলে যেতে বাধ্য।
আমরা ছোটবেলায় অকাজে অনেক সময় নষ্ট করেছি।এখন বাচ্চা-বুড়ো সব্বাই শুধু কাজের সময় কাটাই । তাই কি এতো ক্রাইসিস আমাদের? পনেরো থেকে তিরিশ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স, তাদের অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না যে কি করবেন, কি করবেন না। এই প্রজন্মের মানুষজনকে কি বলা যেতে পারে ! তাদের মনের জোরের কাছে তো পুরো দুনিয়া হারে।
আমি বলব নিজেকে বাড়িতে বসে তৈরি করুন। এ ছাড়া কোনো বিকল্পই যে নেই। যেক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান বলে ভেবে রেখেছেন, তার সমস্ত তথ্য -খুঁটিনাটি বিষয় , অনলাইন কোর্স সবটুকু নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকুন। গ্লোবাল মার্কেট এর ভাবনা আপাতত স্থগিত রেখে স্থানীয় কাজের খোঁজখবর করা জরুরি। আমার মতে এই মুহূর্তে চাকরির কৌলিন্য নিয়ে ভাবা বিলাসিতার সমান। তাই সর্বস্তরের পরীক্ষা দিতে চেষ্টা করবেন। সবরকম কাজ করতে হতে পারে, এমন মানসিকতা বজায় রাখা জরুরি। এরপর সময়ই একদিন আপনার হয়ে কথা বলবে। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবেন। বড় মানুষদের মোটিভেশনাল ভিডিও দেখবেন। কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলোয় মিনিমাম এলিজিবিলিটি থাকলে তবেই একটি পোস্ট লড়ে নেওয়া সম্ভব।জি.কে, জেনারাল সাইন্স ,জেনারাল ইংলিশ এই বিষয়গুলো সবসময় কাজে লাগে। তাই এই পড়াশুনা কখনো বিফলে যায় না। নিজের বিষয়ে গভীরে পড়ার পাশাপাশি এই বিষয়গুলো নিয়েও চর্চা করা যেতে পারে।
পৃথিবী নিজের মতো করে সব সামলে নেবার ২-৩ বছর পর, সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর কখনও সুযোগ এলে যেন আফসোস করতে না হয়। এই ভেবে, যে এই সময়টাকে কাজে লাগানো হয়নি কেন? নিজেকে জ্বালিয়ে রাখা উচিত ছিল।
সূর্যের মতো আলো দিতে চাইলে, সূর্যের মতো পুড়তে হবে যে।
কভার সৌজন্য : www.businessinsider.com
#শরীর ও মন