বিনোদন

বলিউডের বায়োস্কোপে কলকাতা

সাম্যদীপ সাহা Aug 18, 2020 at 10:18 am বিনোদন

"ইয়ে বস্তি হ্যায় আগ কা দরিয়া
ইসমে হাওড়া পুল হ্যায়
আপনি জান বাঁচালো বাবু
ওয়রনা ডাব্বা গুল হ্যায়
...শুনো জি ইয়ে কলকত্তা হ্যায়…।"

ও.পি. নাইয়ারের সুরে গাইছেন মহম্মদ রফি, আর সেই গানের একই স্তবকে ‘হাওড়া পুল’ এবং ‘কলকত্তা’ একসাথে - যেন একে অপরের সমার্থক। গানটি যে ফিল্মের, তারও নাম ‘হাওড়া ব্রিজ’ (১৯৫৮)। শক্তি সামন্তের পরিচালনায় এ এক টানটান রহস্যের ছবি, যেখানে প্রেম কুমার (অশোককুমার) রেঙ্গুন থেকে কলকাতা আসছেন তার ভাইয়ের খুনের কিনারা করতে। সেই কলকাতাকে প্রতি রাতে মোহময়ী আবেদনে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মধুবালা ও গীতা দত্তের ‘মেরা নাম চিন চিন চু’। প্রচলিত মতানুসারে তিনশো বছরেরও বেশি আগে, সেই ১৬৯০ সনে জোব চার্ণক নামে এক ইংরেজ কলিকাতা, গোবিন্দপুর আর সুতানুটি নামক তিনটি গ্রাম একত্র করে কলকাতার পত্তন করলেন আর তাকেই রাজধানী করে ইংরেজরা প্রায় দুশো বছর রাজত্ব করে গেল। নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পাঁচমেশালী লোকাচার আর বাঙালিয়ানায় ভরপুর এই শহরে এতকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দুম করে ১৯৪২ সালে তৈরি হাওড়া ব্রিজ এতটা কৌলিন্য পেল কি করে? গুরুতর কোনও ঐতিহাসিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণ তো কিছু নেই। উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এর পেছনে রয়েছে বলিউডি হিন্দি ছবি। আজ পর্যন্ত কলকাতায় নির্মিত হিন্দি ছবির সংখ্যা মন্দ নয় এবং প্রত্যেকটিতে সগৌরবে পর্দায় উপস্থিত থেকেছে গঙ্গাবক্ষের উপর নির্মিত এই কংক্রিটের কাঠামো।

আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী প্রতিদিন সকালে উঠে কী নিয়ে চর্চা শুরু করবে তার অনেকখানি নির্ধারণ করে মূলধারার বাণিজ্যিক হিন্দি ছবি ও তার সাথে যুক্ত স্টারেরা। ব্রিজের সাথে ট্রাম, হলুদ ট্যাক্সি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা আধা হিন্দি উচ্চারণে ‘রসগুল্লে’ বা ‘মিষ্টি দই’ প্রায়শই জায়গা করে নেয় পেজ ফোরে। কিন্তু মুম্বাই বারবার কেন কলকাতাকেই বেছে নেয়? ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মানেই কোটি কোটি টাকার গল্প। বিশাল এক বাজার। সমালোচক মিরিয়াম হ্যানসেন বলেছেন “From it’s inception in 1895-96, cinema was defined as the projection of films upon a film screen before a paying public” । যথার্থই চলচ্চিত্রের মূলেই ব্যাবসা বা অর্থোপার্জনের বিনিময়ে বিনোদন। শৈল্পিক বা বৌদ্ধিক উৎকর্ষতা আসছে অন্তত জন্মলগ্নের পঞ্চাশ বছর পরে। সেখানে বলিউডি চিত্রনাট্যে কলকাতা এতবার স্থান পেল, নামজাদা প্রযোজকেরা টাকা ঢাললেন, ভারত বা ভারতের বাইরেও মানুষ সাদরে তাকে গ্রহণ করল - এই বিষয়টিকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।

"বম্বে পুরানি, কলকত্তা পুরানা
জ্যায়সে মেরি নানিজি,
ব্যায়সে মেরা নানা।"

১৮৯৪ তে ল্যুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় Cinematographe আর প্রজেক্টর আবিষ্কারের পর ৭ই জুলাই, ১৮৯৬ সালে তাঁদেরই এক প্রতিনিধি বম্বের ওয়েস্টন হোটেলে ‘Living Photographic Pictures in Life-Sized Reproduction’ নামে ছবিটি দেখান টিকিটের বিনিময়ে। সেই বছরই ডিসেম্বর মাসে স্টিফেনস নামে এক ব্যাক্তি ‘The Magic of Moving Pictures of Running Horses’ এবং ‘Train To Calcutta’ নিয়ে হাজির হলেন কলকাতায়। অতএব, ভারতে চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন ঘটেছে দুটি শহরে - বোম্বে এবং কলকাতা। কলকাতার হীরালাল সেনকে যদি ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক বলা হয় তবে বোম্বাইয়া দাদাসাহেব ফালকে হলেন পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির প্রথম নির্মাতা। সুতরাং সেই শুরুর দিন থেকেই এই দুটি শহরই ভারতীয় ছবির ইতিহাসে ফ্রন্টিয়ার।

এই দুই ধারার প্রথম সমাপতন ঘটছে কলকাতার বুকে বি.এন.সরকার প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ থিয়েটার্স’ এর হাত ধরে। ততদিনে নির্বাক ছবির মুখে বুলি ফুটেছে। ১৯৩৪ সালে বঙ্গতনয় হিমাংশু রায় বোম্বেতে স্থাপন করছেন ‘বম্বে টকিজ’, যেখান থেকে আমেরিকান হলিউডের অনুকরণে ‘বলিউড’ নামকরণটি হয়েছে বলে মনে করা হয়। দর্শকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সামাজিক- রাজনৈতিক কারণে হিন্দিই তখন হয়ে উঠছে সর্বভারতীয় ছবির ভাষা। ‘নিউ থিয়েটার্স’ বাংলা ও হিন্দি ভাষায় প্রচুর ডাবল ভার্সনের ছবি প্রযোজনা শুরু করে এবং সারা ভারতে সেগুলি প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। বম্বের পাশাপাশি সর্বভারতীয় ছবি নির্মাণের এই বিরল কৃতিত্ব একশো বছরের চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাসে একমাত্র কলকাতারই। তখন থেকেই বলিউডের প্রিয় শহর হিসেবে বম্বের পরেই এই শহরের নাম পাকা হয়ে গেছে, যে ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত।

"শ্যাহরো মে সে শ্যাহর শুনা
শ্যাহর কলকত্তা,
গলি গলি ভুলভুলাইয়া,
হাম খো গয়ে...।"

তৎকালীন হিন্দি ছবি প্রচন্ডভাবে স্টুডিও- কেন্দ্রিক ছিল বলে শহর, তার মানুষ, তার নাগরিক দৃশ্যকল্প কাহিনী হিসেবে উঠে আসেনি বহুদিন। ফ্লপের ভয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহস ছিল না। সঙ্গে প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। হঠাৎ এক বাঙালি ভদ্রলোক পুরো ফিল্ম ইউনিটসহ হাজির হলেন কলকাতার রাজপথের একেবারে মধ্যিখানে। জলজ্যান্ত নগরজীবন, ডাবলডেকার বাস, ভিড়ে ঠাসা ফুটপাথ, ট্রামের মন্থর গতি, সুবিন্যস্ত ময়দান আর দূরে কবিতার মতো ভিক্টোরিয়া - এসবই তথ্যচিত্রের ধাঁচে তুলে ধরলেন তিনি। সঙ্গে দেখালেন কলকাতার বস্তি, শিশুশ্রম, ফুটপাথবাসীর জীবনযাত্রা, পরিযায়ী উদ্বাস্তুদের স্বপ্নভঙ্গের মর্মস্পর্শী কাহিনী। বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩) ছবিতে প্রথম রক্তমাংসের কলকাতাকে দেখল ভারতীয় দর্শক। ইতালিয় নিও- রিয়েলিজমে উদ্দীপ্ত এই ছবি ভারতীয় প্যারালাল সিনেমারও পথিকৃৎ। সত্যজিৎ বললেন “…best Indian film produced till then”।

আবার বলিউডের সুপরিচিত ফর্মুলা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’-এর মর্যাদাও অক্ষুণ্ন রেখেছে কলকাতা। প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘গুন্ডে’ (২০১৪)। দিওয়ার, কালা পাথ্থর বা শোলের আদলে মারপিট, মেলোড্রামা, আইটেম নাম্বার, প্রথম সারির বলিউড অভিনেতা অভিনেত্রী সম্বলিত এই ছায়াছবি কলকাতার কয়লা মাফিয়া এবং ১৯৭১ এর বাংলাদেশী রিফিউজি আখ্যানকে এনে হাজির করল। যে শহরের সিঙ্গল স্ক্রিনগুলিতে কলকাতাবাসী ব্ল্যাকে টিকিট কেটে হল ভরিয়ে কলকাতার জামাই অমিতাভ বচ্চনের গরম ডায়ালগে সমস্বরে সিটি বাজিয়েছে, এমন জঁরের ছবি ধুলো ঝেড়ে সেই কলকাতাকেই টেনে বের করে আনে। অনিল কাপুর অভিনীত ‘ক্যালকাটা মেল’ (২০০৩) ছবিতে ট্রাম, মেট্রো আর শিয়ালদা স্টেশন জুড়ে চেজিং সিকোয়েন্স ভোলার নয়। আবার ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের পরিচয় ভাঁড়ানো একদল দুর্বৃত্তের কীর্তিকলাপের গল্প বলতে গিয়ে অক্ষয়কুমার অভিনীত ‘স্পেশাল ২৬’ (২০১৩) ছবিতে পরিচালক তাদের অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই এনে ফেলেন বৌবাজারের স্বর্ণব্যাবসায়ী শেঠদের লুকোনো গুদামে।

আদ্যন্ত কমার্শিয়াল এই ছবিগুলির পাশাপাশি বলিউডের মূলধারার বাইরে গিয়ে কিছু ভিন্নধারার ছবিও নির্মিত হয়েছে এই কলকাতায়। ওনির নির্দেশিত ‘আই অ্যাম’ (২০১০) নামক অ্যান্থোলজি ছবির প্রথম কাহিনি ‘আফিয়া’, যেখানে আফিয়া সিঙ্গল মাদার হিসেবে গর্ভধারণের আগে ব্যাক্তিগতভাবে চিনতে চায় শুক্রাণুদাতাকে। সুজিত সরকার নির্দেশিত ‘পিকু’ (২০১৫), যেখানে বাঙালীর চিরসঙ্গী কোষ্ঠকাঠিন্যের নিয়ে কৌতুকের সঙ্গেই উপস্থাপিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ, পৈতৃক ভিটের প্রতি টানের মতো আবেগ। সাথে বোনাস হিসেবে সাইকেলে প্যাডেল করে ভাস্কর (অমিতাভ বচ্চন) রাইটার্স বিল্ডিং, ময়দান থেকে শ্যামবাজারের তস্য সরু গলি অবধি ঘুরিয়ে দেখান। মানে একই টিকিটে সিনেমার সাথে বাঙালিয়ানা, সঙ্গে ঝাঁকিদর্শনে কলকাতার হেরিটেজ ট্যুর।

[আগামীকাল সমাপ্য।]


ব্যবহৃত গান প্রসঙ্গে:
১."শুনো জি ইয়ে কলকত্তা হ্যায়"
ছবি: হাওড়া ব্রিজ (১৯৫৮), সুর: ওপি নাইয়ার, শিল্পী: মহম্মদ রফি
২.’বম্বে পুরানি’
ছবি: উমর কয়েদ (১৯৬১), সুর: ইকবাল কুরেশি, শিল্পী: মহম্মদ রফি, সুমন কল্যাণপুর
৩. ‘শ্যাহরো মে সে’
ছবি: জাগির (১৯৮৪), সুর: রাহুল দেববর্মন, শিল্পী: কিশোরকুমার



[পোস্টার : অর্পণ দাস।]

#ফিল্ম #সিনেমা #বলিউড #কলকাতা #সাম্যদীপ সাহা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

65

Unique Visitors

215852