<b>বলিউডের বায়োস্কোপে কলকাতা</b>
(প্রথম পর্বের পর) এই কল্লোলিনী যতটা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির, প্রাচীন নবীনের পাঁচমেশালী শিল্পের, ততটাই বিপ্লবের, সংগ্রামের আর রাজনীতির। পোস্টার ফেস্টুনে পরিবৃত যে শহর সদা জাগ্রত তার দেওয়াল-লিখনে বা স্বাধীনতাযুদ্ধ আর একাত্তরের উত্তাল দিনগুলির স্মৃতিচারণে, ‘য়ুভা’ (২০০৪)-র মতো ছাত্ররাজনীতি- কেন্দ্রিক ছবির জন্য মণিরত্নম স্বাভাবিকভাবে তাকেই বেছে নিয়েছেন। গুন্ডা-মাস্তানের পরম্পরা কলকাতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভোটের আগে তাদের দিয়ে গন্ডগোলের বাতাবরণ তৈরি করতে নেতারা সিদ্ধহস্ত। সেই ঘৃণ্য দলবাজির পরিবর্তে নতুন প্রজন্ম কেমনভাবে দিনবদলের ডাক দিচ্ছে, তাকেই উপজীব্য করে মণিরত্নম দুর্দান্ত নন -লিনিয়ার ন্যারেটিভ পরিবেশন করেন।
"দিলকা বাজার হ্যায়, থোরা বিজার হ্যায়
কলকাতা খোয়াইশো আরমানো কা আচার হ্যায়
...অ্যায়সে শ্যাহর হ্যায় জিসকা ডাবল রোল হ্যায়।"
এই ত্রিশতাব্দীপ্রাচীন তিলোত্তমার শিরায় ধমনীতে সর্পিল গতিতে বয়ে যাচ্ছে আরেকটা কলকাতার চোরাস্রোত। অপরাধ, নৃশংস হত্যা, বেশ্যাপল্লী, আর প্রতিশোধের ভেদবমিতে ভরা অন্ধকার এক কলকাতা। এই কলকাতাবাসীর কাছে খুন-হত্যা- রাহাজানির খবর অতীব উপাদেয়। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজগুলি কোথাও গিয়ে নিস্তরঙ্গ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালীর মনে আলাদা উত্তেজনা সঞ্চার করে। তাই তো ব্যোমকেশ, পরাশর বর্মা, কিরীটি, ফেলুদা, কাকাবাবুরা এতটা জনপ্রিয়। সেখানে কলকাতার বুকে থ্রিলারধর্মী প্লট এনে ফেলা অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে পড়বে সুজয় ঘোষের ‘কাহানি’ (২০১২)-র কথা। বিদ্যা বালন অভিনীত এই ছবিতে টানটান সাসপেন্স, জটিল রহস্যের পরতে পরতে চিত্রনাট্যকার বুনে দিয়েছেন বঙ্গীয় ঐতিহ্য ও বর্ণাঢ্য উৎসবমুখর দুর্গাপুজো। এমনভাবে আজ পর্যন্ত কোনও ছবি শারদীয়া কলকাতাকে তুলে ধরেছে কিনা সন্দেহ। আর ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে বিসর্জনের প্রেক্ষাপটে যেভাবে রহস্যের যবনিকা উঠেছে তা অসাধারণ। দিবাকর ব্যানার্জি সত্যাণ্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে ভারতীয় দর্শকের সামনে নিয়ে এলেন তার ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ (২০১৫) ছবিতে। যে সুললিত রোম্যান্টিক কলকাতাকে দেখে আমরা অভ্যস্ত, তাকে ভেঙে চুরমার করে দিবাকর টেনে বের করে আনলেন লালসা-অভীপ্সা-অভিসম্পাতে মাখামাখি ১৯৪৩ এর কলকাতাকে। দর্শককে টাইম মেশিনে চড়াতে তাঁকে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এ শহরে ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। কলোনিয়াল স্থাপত্যরীতিতে ভাস্বর প্রেসিডেন্সি, ডালহৌসি স্কোয়ার, লালবাজার আর উত্তর কলকাতার ঐতিহ্যমাখা শহরকে আরও অতীতের করে দেখাতে দিবাকর ‘লিপটন টী’, ‘হেমকান্তি সুগন্ধি কেশ তৈল’, ‘সাধনা ঔষধালয়’ এর মতো বিজ্ঞাপন সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করেন। রিভু দাশগুপ্তের রিভেঞ্জ ড্রামা ‘তিন’ (২০১৬)-এ গল্পের সাথে পরিবেশিত হয় কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়, মুসলিম জনগোষ্ঠী আর হিন্দুসমাজের ত্রিবিধ সম্প্রীতির ‘কসমোপলিটান’ কলকাতা।
আরও পড়ুন
বলিউডের বায়োস্কোপে কলকাতা (প্রথম পর্ব)
কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক অলৌকিক গল্প। গারস্টিন প্লেস, পার্কস্ট্রিট সেমেট্রি, হেস্টিংস হাউস, পুতুলবাড়ি, এমনকি রবীন্দ্রসরোবর মেট্রোস্টেশন এর মতো অনেক জায়গারই নিজস্ব ভৌতিক জনশ্রুতি বা বিশ্বাস রয়েছে। সেই শহরেই প্রসিত রায় এনে ফেললেন হরর ঘরানার ছবি ‘পরি’ (২০১৮)। ইফরিত আর অলাদচক্র নামক শয়্তানসিদ্ধ তন্ত্রসাধনার আড়ালে নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন আর পুরুষতান্ত্রিক নিষ্পেষণের বাস্তবতা তুলে ধরা হল। কলকাতার ছায়াছবির ঝুলিতে এ এক ব্যতিক্রমী সংযোজন।
"শুনো শুনো মিস চ্যাটার্জি
মেরে দিলকা ম্যাটার জি,
কলকত্তে বালি রুঠ গয়ি কিউ
বাত নহি ইয়ে বেটার জি।"
একথা সকলে জানে যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে মিউজিয়ামের তুলনায় গার্ডেনের টিকিটের বিক্রি বেশি। একথাও সুবিদিত যে আগেকার সমস্ত সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলির লাস্ট রো অতিরিক্ত ঘুষের বিনিময়ে সংরক্ষিত থাকত ‘কাপল’দের জন্য। প্রিন্সেপ ঘাটের থাম বা নন্দন চত্বর, ময়দানের বেঞ্চে নিঝুম দুপুর বা প্রতিদিনের ভিড় বাসস্টপ - প্রণয়ের ব্যর্থতা বা পরিপূর্ণতায় কলকাতা চিরকাল মৌনমুখর। তাই তো গুরু দত্তের মতো অবাঙালিও তার পেয়াসা (১৯৫৭), সাহেব বিবি অর গুলাম
(১৯৬২), বাহারে ফির ভি আয়েঙ্গি (১৯৬৬)-র মতো ছবির জন্য নোঙর ফেলেছেন এই কলকাতাতেই। কখনো উর্দূ শায়েরির জোয়ারে ভাসিয়েছেন, কখনও বলেছেন ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের শেষের গল্প, কখনও নির্ভীক সাংবাদিকতার বিড়ম্বনার কাহিনির সঙ্গে বুনে দিয়েছেন অচরিতার্থ প্রেম বা ত্রিকোণ সম্পর্কের টানাপোড়েন। অবশ্য এখানে কলকাতা চালচিত্র মাত্র। তার চরিত্র এখানে অনুপস্থিত।
অনুরাগ বসুর ‘বরফি’
(২০১২) এক নির্ভেজাল ভালোবাসার রূপকথা। মূক বধির বরফি (রণবীর কাপুর) ও অটিস্টিক ঝিলমিল (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) এর মতো মানুষ, যাদেরকে ব্রাত্য করে রাখে সংসার এবং সমাজ, তারা লাল নীল সংসারের স্বপ্ন দেখে, মাথা গোঁজার একচিলতে আশ্রয় খুঁজে পায় এই মধ্যবিত্ত কলকাতার বুকেই। অক্ষয় রায় পরিচালিত ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’ (২০১৭) সেই ধুলোঝারা কিশোর বয়সের প্রেমের নস্টালজিয়া। গলির ফুটবল, টানারিক্সার ঝুমঝুমির শব্দ আর পুরনো কলকাতার গন্ধ ছেড়ে একদিন প্রবাসী হতে হলেও স্মৃতি-বিস্মৃতির আড়ালে সেই হঠাৎ শোনা সুরটার মতো কলকাতা মনের মণিকোঠায় সারাজীবনের মতো থেকে যায়।
ওনির আবার ফিরে আসেন কলকাতায়, এবার ‘কুছ ভিগে আলফাজ’ (২০১৮) নিয়ে। আর্চি (গীতাঞ্জলি থাপা) ভুলে থাকতে চায় তার বর্তমানকে, অন্যদিকে আলফাজ (সাইন খান দুরানি) গুমরে মরে তার দুঃস্বপ্নময় অতীতের জন্য। তাদের এই একবুক শূন্যতা পূরণ করে বেতারের কলকাতা। এখনও যে শহরে চায়ের দোকানের প্রথম জল ফোটে রেডিওর প্রভাতী সম্প্রচারে, দেবীপক্ষ শুরু হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠে, সেই কলকাতা।
স্থানাধিকরণ-কেন্দ্রিক ফিল্মে সেই প্রেক্ষাপট একটা আলাদা চরিত্র হয়ে ন্যারেটিভের অভিমুখ অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সে কারণেই ‘অরিজিনালিটি’-তে ভরপুর কলকাতা পরিচালকদের কাছে বরাবর গুরুত্ব পেয়েছে। তবে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ত্রিবেণীসঙ্গমস্থল কলকাতার জীবনচর্যায় চড়া দাগের মশলা বলিউডি স্ক্রিপ্ট বেমানান হবে মনে করেই কি সত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত হিন্দি ছবিতে কলকাতা প্রায় অনুপস্থিত? কারণ সেই সময় বাস্তবধর্মী ছবির সংখ্যাও নগণ্য।
লক্ষ করার বিষয়, কলকাতায় নির্মিত অধিকাংশ ছবিরই পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার বঙ্গসন্তান বা প্রবাসী বাঙ্গালী পরিবারের। বাঙালির ‘কালচারাল আইডেন্টিটি’ বা ‘হ্যাংওভার’ বরাবরই খুবই প্রকট, যা শিকড়ে ফেরার আর্তি জাগিয়ে রাখে। এই প্রসঙ্গেই বরেণ্য বিমল রায় সম্পর্কে চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলেন, "when
Bimal Ray, went from New Theatres to Bombay, he took a large slice of Calcutta
with him.” কিন্তু বলিউডি অবাঙালী প্রযোজকেরা কেন এমন ছবিতে টাকা ঢালবেন? তাদের কী স্বার্থ? বলিউড তো শেষপর্যন্ত মুনাফামুখি। শৈল্পিক উৎকর্ষের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সপ্তাহান্তের হিসেব।
টেকনিক্যাল দিক থেকে বললে কলকাতায় শুটিং অনেক সহজ ও সস্তা। আর এতটাই আইকনিক ইমেজারিতে পরিপূর্ণ যে তা ছবিতে স্থান পেলে আলাদা মাত্রা সংযোজন করে, যা দর্শক টানতে সহায়ক। কলকাতা কতটা আকর্ষণীয় গন্তব্য সেটা একটা সহজ উদাহরণে বোঝানো যেতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয় ছবিতে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নাচ-গানের দৃশ্য রাখতে হয়। অনেকসময় কড়ি ফেলে ঝকঝকে বিদেশি লোকেশন বাছতে হয় শুধু নাচগানের জন্যই। কিন্তু কলকাতাও গানের দৃশ্যের এক্সটিক লোকেশন হিসেবে কিছু কম যায় না। যেমন জাগির (১৯৮৪) ছবির ‘শ্যাহরো মে সে’, অমর প্রেম (১৯৭২) ছবির ‘চিঙ্গারি কোই ভরকে’, বুলেট রাজা (২০১৩) ছবির ‘সামনে হ্যায় সভেরা’, লভ আজ কাল(২০০৯) ছবির ‘আজ দিন ছড্ডেয়া’, তামাশা (২০১৫) ছবির ‘হির তু বড়ি স্যাড’। এইসব ছবি শুধু একটি গানের জন্য বেছে নিয়েছে কলকাতাকে।
তবে মহৎ শিল্প সবসময়ই আর্থিক পরিপ্রেক্ষিত ও প্রতর্ক পেরিয়ে যায়। আলোচিত বেশিরভাগ ছবিতেই পপুলার বলিউডি তারকারা অভিনয় করেছেন, মূলধারার ছবির মতো করে রিলিজ হয়েছে সেগুলি, কিন্তু তাও কোথাও গিয়ে অনেকগুলি ছবিই ট্রিটমেন্টে অভিনব। তারা মুছে দিয়েছে কমার্শিয়াল- আর্ট ঘরানার প্রভেদ। সে-ও কি কলকাতার চরিত্রগুণে? মনে পড়ে, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো বলেছিলেন “a film is a film is a film.”
যে শহর একলহমায় মুছে ফেলতে পারে কলকাতা আর মুম্বাইয়ের মধ্যেকার দু’হাজার মাইলের দূরত্ব, যে শহরে এসপ্লানেডের মণিরুদ্দিনের পানের দোকান চল্লিশ বছর ধরে অক্লান্ত ভাবে পেশ করে চলেছে মহম্মদ রফির গানের গুলদস্তা, সেই শহরই একমাত্র পারে বলিউডের বিছরা হুয়া জমানাকে বাঁচিয়ে রাখতে, সাথে আরও আরও নতুন সৃষ্টির খোয়াব দেখতে। আজও, প্রতিদিন, গঙ্গার পাড়ে যখন সন্ধ্যে নামে, বলিউডের বায়োস্কোপ তখনও স্বপ্ন ফেরি করে এই শশব্যস্ত নাগরিক প্রান্তরে। আর রফির কন্ঠের সুরবাহারে বেজে চলে,
"ইতকি দুক্কি পান কা ইক্কা
কহি জোকার কহি সত্তা হ্যায়,
শুনো জি ইয়ে কলকত্তা হ্যায়…।"
তিনশো ছাড়িয়ে গেছে। তবু যুবতী এই শহরকে সায়োনারা জানানো সহজ নয়।
ব্যবহৃত গান প্রসঙ্গে:
৪. ‘দিলকা বাজার হ্যায়’
২. সিনেমার শতবর্ষে ভারতীয় সিনেমা, নন্দন
৩. সময়চিত্রকথা, হেমেন্দ্রকুমার রায়, তালপাতা
৪. “Encyclopaedia of Indian Cinema”, Ashish Rajadhyaksha and Paul Willemen, Oxford.
[ পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#নিবন্ধ #কলকাতা #বলিউডের বায়োস্কোপে কলকাতা #সাম্যদীপ সাহা