খালাসিটোলা
জীবনানন্দের জন্মদিন পালিত হয়েছিল এইখানে। এইখানে মানে কোনও সভাগৃহ নয়। নয় কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কবিতা পড়ার আসর। অথচ একটা সময় এই জায়গাই হয়ে উঠেছিল এক আশ্চর্য সিম্পোজিয়াম। আদিম দেবতাদের লীলাক্ষেত্র। বাস্তবের বৃন্ত থেকে চ্যুত। আবার বাস্তবতার সঙ্গে গভীর ভাবে লগ্ন। জায়গাটা নিতান্তই এক বাংলা মদের ঠেক।
সময়টা ১৯৬৮। হাংরি জেনারেশনের কিছু যুবক হাজির হয়েছিলেন সেইখানে। যেমনটা তাঁরা হাজির হতেন প্রায়ই। কিন্তু সেইদিনটা ছিল জীবনানন্দের জন্মদিন। হাংরি ছোটো গল্পকার অবনী ধর উঠে পড়েছিলেন টেবিলে। যে গানটা গাইতে শুরু করেছিলেন তা নাকি জাহাজের খালাসিদের গান। জাহাজে কাজ করার সময় শেখা। উপস্থিত কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি যে এটা আদৌ কোনও গান। কারণ এই গানের কথা আমাদের পরিচিত শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে মেলে না। সুরটা নাকি মোৎজার্টের কোনও সৃষ্টির অনুকরণ। অন্তত এমনটা জানিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরী। তাঁর The Cultural Outsider নামের লেখায়।
খালাসিদের গান গেয়ে যেখানে জীবনানন্দের জন্মদিন পালিত হয়েছিল, পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন, জায়গাটার নাম খালাসিটোলা। কোনও গুগুল ম্যাপ নিয়ে যাবে না সেইখানে। অন্তত কদিন আগে পর্যন্ত নিয়ে যেত না। জায়গাটা এস. এন. ব্যানার্জি রোড আর রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের সংযোগস্থলে। কয়েকটা কাটা ফলের দোকান পেরোতেই চোখে পড়বে, লাল বোর্ডে সাদা দিয়ে ইংরেজিতে লেখা, খালাসিটোলা সি.এস. শপ। সি. এস. মানে কান্টি লিকার। বোর্ডটা নতুন। দেখলেই বোঝা যায়। সঙ্গে হালফিলের এক বিয়ারের বিজ্ঞাপন।
এককালে এসব ছিল না। কিন্তু ছিল এক আদরের ডাকনাম। শ ব্রাদার্স যেমন ছোটা ব্রিস্টল, খালাসিটোলা তেমনই কেটি।
তা এই কেটি নিয়ে গল্প কম নেই। বহু বিখ্যাত মানুষের পছন্দের জায়গা ছিল কেটি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ঋত্বিক ঘটক থেকে কমলকুমার মজুমদার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, সুবিমল বসাক, ভাস্কর চক্রবর্তী, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়... আরও কত নামজাদা কবি-সাহিত্যিক, চিত্র পরিচালকের প্রিয় রঁদেভু ছিল খালাসিটোলা। এমনকি কমলকুমারের খোঁজে নাকি এইখানে আসতেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। অন্তত কৌরব ৯২-এ উদয়ন ঘোষের লেখা “খালাসিটোলায় আমি এক প্রডিগ্যাল খালাসি” এমনই সাক্ষী দেয়।
কমলকুমার মজুমদার এইখানে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মদ খেতেন। তাও যে-কোনও মদ নয়। এক নম্বরের অতি কড়া বাংলা মদ। একবিন্দু সোডা বা জল না মিশিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিতেন পুরোটা। এক গেলাস শেষ করে আরেক গেলাসে যাওয়ার আগে একটা কলে খুব ভালো করে কুলকুচো করে নিতেন। এতে নাকি দাঁত ভালো থাকে। ‘অর্ধেক জীবনে’ এই কথা লিখে সুনীলের বেদনাময় কৌতুক, “লিভারের কী হবে, তার চিন্তা নেই, দাঁতের জন্য চিন্তা”।
কমলকুমার বসতেন না কখনোই। যদি কোনও বিখ্যাত ফরাসি শিল্প সমালোচক বা ইংরেজ কবি কমলকুমারের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করতেন, তাঁদের আসতে হোত খালাসিটোলাতেই। গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন এই ডানাছাঁটা দেবদূত। সঙ্গে থাকত সদ্য প্রকাশিত কোনও ফরাসি বই। আর টাকা থাকত সেই বইয়ের ভাঁজে। রুমাল দিয়ে একদম নিজস্ব পদ্ধতিতে পরিশুদ্ধ করে নিতেন তরল আগুন। আঙুলের রামকৃষ্ণ লেখা আংটি সেখানে ছুঁইয়েই মুক্তি। কমলকুমারের অবাক জলপান।
এককালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উদাত্ত গলায় গান শোনা যেত এইখানে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অকাতরে সই বিলোতেন। সুনীল গাঙ্গুলির ‘একা এবং কয়েকজন’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দে’র অনেক কবিতাই নাকি খালাসিটোলার কবিমেলাতেই প্রথম পঠিত হয়। এই খালাসিটোলায় প্রকাশিত হয়েছিল শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার বই। পঞ্চাশের উদ্দাম কবিদের থেকে শুরু করে হাংরি জেনারেশন। বাংলা সাহিত্যের যুগ পরিবর্তনের সাক্ষী কেটি।
শরৎকুমার মজুমদারের লেখা থেকে জানা যায়, একসময় এই খালাসিটোলার ম্যানেজার ছিলেন কালীবাবু নামের এক ভদ্রলোক। খড়ম পরে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। খালাসিটোলার সময় সকাল দশটা থেকে রাত ন’টা। ন’টার পরও যারা এই মাতাল তরণী ছাড়তে চাইত না খড়ম দিয়ে তাদের পা মারিয়ে দিতেন কালীবাবু।
এহেন বাংলার ঠেকের শুরুটা হয়েছিল অনেক আগেই। সেই উনিশ শতকে। লালবাজারের পেছনে ব্রিটিশ সাহেবদের জন্য ছিল ট্যাভার্ন হাউস। আর তালতলা অঞ্চলের খালাসিরা আসর জমাতেন এইখানে। ১৯১৮ সালে মোহিত সাহা নামের এক ইঞ্জিনিয়ার এটি নতুন উদ্যমে গড়ে তোলেন। খালাসিটোলা হয়ে ওঠে লাইসেন্সপ্রান্ত বাংলা শুঁড়িখানা। কলকাতা ডকইয়ার্ডের খালাসিরা ক্লান্ত দিনের শেষে এইখানে আড্ডা জমাতেন বলেই হয়ত এর নাম হয় খালাসিতলা। সেইখান থেকে খালাসিটোলা। এখন এর মালিক সমর সাহা আর দীপংকর সাহা। তাঁরাই আঁকড়ে আছেন এই নিভন্ত প্রদীপের আলো আর অন্ধকার।
বাংলা মদের বিবর্তন দেখেছে খালাসিটোলা। দেখিয়েওছে। আগে সার দেওয়া থাকত ড্রাম, ব্যারেল। বোতলে আলকাতরার সিলওয়ালা পিতলের ছিপি। তারপর এল কর্কের ছিপি দেওয়া বোতল। ঘনত্ব অনুযায়ী তিন শ্রেণির বাংলা মদ ছিল তখন। এক নম্বর, দুনম্বর আর তিননম্বর। তারপর এল ১৫০ বা ২০০ এম.এল. এর ফাইল, ৩০০ এম.এল. এর পাঁইট আর ৬০০ এম.এল. এর বোতল। তখন অবশ্য কোল্ড ড্রিংক্সের মত ছিপি। আস্তে আস্তে ফাইল বিলুপ্ত হয়েছে। যেমন বিলুপ্ত হয়েছে কালচে কাঁচের বোতলও। যার গায়ে লাগানো থাকত আবছা লাল রঙের মা কালীর ছবি দেওয়া লেবেল। তার থেকেই এই বোতলের নাম হয় কালীমার্কা। এখন অবশ্য বাংলা প্লাস্টিকময়। প্লাস্টিকের সাদা বোতল। প্লাস্টিকের ছিপি। একসময় খালাসিটোলায় বোতলের জন্য জমা রাখতে হত পয়সা। বোতল ফিরিয়ে দিলে তবেই সেই পয়সা ফেরত মিলত। এখন সবই ইউজ এন্ড থ্রো।
কিন্তু একটা বাংলা মদের ঠেক কেন হয়ে উঠেছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক পীঠস্থান? কোন প্রণোদনায় সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ মনীষারা ভিড় জমাতেন খালাসিটোলায়! সেটা বুঝে নিতে গেলে জেনে নিতে হবে ঠিক কোন সময় জুড়ে খালাসিটোলা নির্মাণ করেছিল এক অনির্বচনীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য। আধিপত্যই। কারণ একটা সময় এর আধিপত্য সহ্য করতে না পেরে, জয়দেব বসু প্রমুখ খালাসিটোলা ছেড়ে আড্ডা জমান আরেকটা বাংলা মদের ঠেকে। নাম বারদুয়ারী।
খালাসিটোলার সাংস্কৃতিক জনপ্রিয়তা শুরু হয় মূলত পঞ্চাশের দশক থেকে। কৃত্তিবাসী কবিদের অনিকেত উচ্ছৃঙ্খলতা দুহাতে লালন করেছে এই বাংলা বার। জন্ম দিয়েছে এক স্পর্ধিত দার্ঢ্যের। চিৎকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার। সময়টা ছিল আশাভঙ্গের। বেদনার। স্বাধীনতা এসেছিল বটে, কিন্তু স্বাধীনতা কোনও কল্পিত স্বর্গলোক নিয়ে আসেনি। খিদে, দারিদ্র, মারী। একের পর এক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ব্যর্থতা। বেকারত্ব। হতাশা যেন সেই সময়ের স্বর। সেই হতাশা থেকেই জন্মায় শ্রেণিচ্যুতির তীব্র আবেগ। কয়েকটা প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ মাথাগুলো এসে জড়ো হয় এক বাংলা মদের ঠেকে। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে আমরা দেখেছি, যক্ষপুরীতে যখন প্রাণের সহজ মদের বরাদ্দ বন্ধ হল, তখনই মানুষ হাটের মদ নিয়ে মাতামাতি শুরু করল। হয়ত একটা সময়কে সইয়ে নিতে তখনকার সবচেয়ে সস্তা বাংলা মদের ঠেকে এসে জুড়ে যাচ্ছিলেন তখনবার সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষগুলো। এঁরাই কেউ লিখবেন ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। কেউ বা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। কেউ বানাবেন ‘সুবর্ণরেখা’। ক্ষয়াটে প্রজন্মের কলমে, তুলিতে, ক্যামেরায় উঠে আসবে সময়ের চোখের জল।
শুধু মদের নেশা দিয়ে তাই খালাসিটোলাকে পড়ে ফেলা যাবে না। বোঝা যাবে না কেন বেশ কিছু ম্যাগাজিন এখনও খালাসিটোলা বিশেষ সংখ্যা বের করে। কেন এই গত বছরের দুর্গাপুজোতেও দমদম পার্ক তরুণ দলের থিম সং-এ দীপময় দাস গেয়ে ওঠেন, “এ জীবন আজীবন দেখা হয় রাস্তায়/ টলমল কবিতারা খালাসিটোলায় যায়”। খালাসিটোলা আসলে বাঙালির সাংস্কৃতিক অবচেতনে ঢুকে গেছে।
ঢুকে তো গেছে। কিন্তু এখন কেমন আছে খালাসিটোলা? নিভু নিভু অন্ধকারে সেইখানে কি এখনও তর্ক জমে ওঠে? প্রকাশিত হয় কোনও নতুন কবিতার বই? নাকি অন্ধকার আরও ঘনিয়ে উঠেছে! বমি আর পেচ্ছাপের গন্ধের ওপর শুয়ে আছে ক্লান্ত মজদুর। সুনীল, শক্তি, কমলকুমারের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে খালাসিটোলার থেকে।
আরও পড়ুন : কলকাতার পানশালা / বিবস্বান দত্ত
আসলে যে সময়, খালাসিটোলা তৈরি করে তুলতে পারে, শেষ হয়ে গেছে সেই সময়টাই। এখন চারদিকে বিশ্বায়ন। মুক্ত অর্থনীতি, ভোগবাদকে নিয়ে এল যে হাতের মুঠোয়, সেইখানে কি আর খালাসিটোলা আঁটে? এখন তো চারিদিকে “ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না”। প্লেইন লিভিং হাই থিঙ্কিং এর মন্ত্র বাঙালি ভুলে গেছে কবে! লিটিল ম্যাগাজিনের চরিত্র বদলেছে। শহর থেকে হারিয়ে গেছে সেইসব রাগী যুবকের দল। গাছে গাছে কবিতা টাঙানোর পাগলামো। এখনকার উৎসবময়, পুরস্কারময় কবিতাযাপন কি ছুঁয়ে দেখবে সেই ক্লেদ ও কুসুম? সেই কবিখালাসিদের অলৌকিক রঁদেভু!
“Changes in drinking customs may offer clues to fundamental social changes.”
“Alcohol and Culture” প্রবন্ধে David G. Mandelbaum লিখেছিলেন এই কথা। অন্য প্রসঙ্গে অবশ্যই। তবে কোনও মূলগত সামাজিক পরিবর্তন খালাসিটোলাকে ম্লান করে দিল কিনা, তা ভেবে দেখবার সময় এসেছে। বলা বাহুল্য, এইখানে খালাসিটোলা ৫/২ রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে নয়। কোনও ভৌগোলিক স্থানাঙ্কে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের চিহ্নায়ক। যার কথা শুধু বইয়ে পড়া যাবে। কবিতায় পড়া যাবে। কিন্তু যার কাছে আর যাওয়া যাবে না কখনই। কলকাতার বুক থেকে খালাসিটোলা হারিয়ে গেছে।
..................
কৃতজ্ঞতা :
অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
The Cultural Outsider, Malay Roychoudhury, গুরুচণ্ডাল৯
কৌরব ৯২ (নভেম্বর ২০০২)
মাসিক কৃত্তিবাস (মার্চ ২০১৮)
Current Anthropology, Jun., 1965, Vol. 6, No. 3.
কবীর সুমন
ব্রতেশ
...........................