ভারতের নদনদীর আলোচনায় পথিকৃৎ কপিল ভট্টাচার্য
বাংলা ভাষায় প্রথম নদীবিষয়ক আলোচনার বই 'বাংলার নদনদী ও পরিকল্পনা'। আর তাঁর রচয়িতা কপিল ভট্টাচার্য। শুধু বাংলা বললে ভুল হয়, গোটা ভারতে সেই আমলে নদী-বিশেষজ্ঞ খুব বেশি ছিলেন না। কপিলবাবু ছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি শুধু বিশেষজ্ঞ বা প্রকৌশলী ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ পরিবেশবিদ। দূরদৃষ্টি, পরিবেশপ্রীতি ও প্রতিবাদী সত্তা তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল।
কপিল ভট্টাচার্য ১২ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ এ পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রকৌশল বিদ্যা শেষ করেন ১৯২৮-এ। তিরিশের দশকে ফ্রান্সে উচ্চতর শিক্ষা শেষে স্বদেশে সরকারি কাজে যোগ দেন। এরপরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছেন। তাঁর কাজের অংশ হিসেবেই বাংলার নদ-নদীর গতি-প্রকৃতির ওপর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ফারাক্কা বাঁধসহ অনেকগুলো প্রকল্প নিয়ে কপিল ভট্টাচার্য নিজস্ব মতামত সরকারি নদী কমিশন ও অন্যান্য সরকারি দফতর ও সংস্থায় পাঠাতেন, বিকল্প সুপারিশ হাজিরও করতেন। ১৯৫৪ সালে 'বাংলার নদনদী পরিকল্পনা' বইটি প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা কাল থেকে আমৃত্যু গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির (এপিডিআর) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
নদী বিষয়ে তাঁর আরেকটি গ্রন্থের নাম ‘স্বাধীন ভারতে নদ-নদী ও পরিকল্পনা (১৯৮৪)। বিজ্ঞান ও নদী গবেষণার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যেও আগ্রহ ছিল। তিনি ‘কল্লোল’ ও ‘কালি কলম’ পত্রিকা-গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর দুটি ছোটগল্প সংগ্রহ ‘ঘসেটি মলের তাঁবেদারী’ ও ‘তিন পেগ হুইস্কি’।
নদনদী নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাহীনতার চাঁচাছোলা সমালোচনাই শুধু করেননি, সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলে কপিলবাবু। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণেই তিনি ঘোষণা করেন, সরকারি পরিকল্পনার ভ্রান্তি ও ভাওতা সাধারণ জনগণকে বোঝানোই তাঁর এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য। তথাকথিত নদী উন্নয়নের নানা পরিকল্পনা যে জনগণের জন্য সমূহ বিপদই বয়ে নিয়ে আসছে, এবং সে বিষয়ে তাদের সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তোলাই যে বাঁচার একমাত্র পথ; সেটাই তিনি বারবার বলে যেতে চেয়েছেন। ১৯৮৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নির্ভীকভাবে নিজের মত প্রকাশের জন্য সমকালে তাঁকে কম হেনস্থার শিকার হতে হয়নি। কিন্তু বিগত এক দশক ধরে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করেছে, বিহার ও উত্তর প্রদেশের একটা বড় অংশ বন্যার বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশ হচ্ছে ভাঙনের শিকার। ফলে আজ কপিল ভট্টাচার্যের নাম আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
............