কামাল করলেন কিট্টু লাহিড়ি: হিমানীশ গোস্বামীর মজার গোয়েন্দা
ডাকসাইটে গোয়েন্দার অভাব নেই বাংলা সাহিত্যে। বিখ্যাত হয়ে যাওয়া গোয়েন্দা চরিত্রদের গল্প উপন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সময়ে মাঝেমধ্যেই বাংলা গোয়েন্দা গল্পে উঁকি দিয়ে গেছে স্বল্পখ্যাত কিছু গোয়েন্দাও। গোয়েন্দাগিরিতে তাদের হাতযশ কম না থাকলেও কোনও না কোনও কারণে খুব একটা বিখ্যাত হয়ে ওঠা হয়নি তাঁদের। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটী, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, অর্জুন, পাণ্ডব গোয়েন্দা বা গোগোলের মতো বিখ্যাত তো তাঁরা ননই, এমনকি জয়ন্ত-মানিক, কিকিরা, গন্ডালু বা আধুনিক প্রজন্মের দীপকাকু, মিতিনমাসির মতো পরিচিতিও তাঁদের জোটেনি। কোথায় যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের মন থেকে হারিয়ে গিয়েছেন ইন্দ্রনাথ রুদ্র, একেনবাবু, পুল্লা রেড্ডি বা কিট্টু লাহিড়িরা। একেনবাবু বহু বছর বাদে নব কলেবরে ফিরে এসে হঠাৎই ‘হইচই’ ফেলে দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাকিদের ভাগ্যে সেরকম কোনও শিকে এখনও ছেঁড়েনি। তাহলেও যখন তাঁদের কাহিনিগুলো প্রকাশ পেত, সেই সময় বুভুক্ষু গোয়েন্দাগল্প পাঠকদের একটা অংশ কিন্তু গল্পগুলোর অপেক্ষাতে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতেন। অল্প সংখ্যক কাহিনি প্রকাশিত হলেও সেই কটি গল্পেই তাঁরা সেইসব পাঠক মনে এমন দাগ রেখে যেতে পেরেছিলেন যে আজ পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরেও তাঁদের কথা মনে থেকে গেছে অনেকের। এরকমই একজন ছিলেন হিমানীশ গোস্বামীর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র কিট্টু লাহিড়ি।
গোয়েন্দাকাহিনি হলেও হিমানীশ গোস্বামীর লেখা যখন তখন তাঁর অসামান্য হিউমার, নির্মল মজার সূক্ষ্ম রসিকতা তো থাকবেই। তার ফলে শিবরাম চক্রবর্তীর কল্কেকাশি বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বরদাচরণের মতো না হলেও কিট্টু লাহিড়িকেও অনেকাংশেই কমিক গোয়েন্দা বলা যায়। ১৯৮৮ সালে প্রথম আনন্দমেলার পাতায় তার আত্মপ্রকাশ। খুব কম সংখ্যক কাহিনিতেই তাকে পেয়েছি আমরা। কিন্তু তার মধ্যেও চরিত্রটার বিশেষত্ব চোখ টেনেছিল অনেকেরই। তার আসল নাম কীর্তি লাহিড়ি। ‘কিট্টুর গুরুলাভ’ গল্পে বলা হচ্ছে তার বয়স পঁচিশ। কিন্তু সে এমন দাড়ি রেখেছে যাতে মনে হয় বয়স অন্তত ছত্রিশ। তার উপর কেবল বয়স্ক দেখানোর জন্যই একটা মোটা ফ্রেমের চশমাও পরে। কারণ তার মতে বয়স কম হলে গোয়েন্দা বলে কেউ পাত্তা দিতে চায় না। অথচ ওই বয়সেই সে তার ইতিহাসের অধ্যাপক ব্যোমকেশবাবুর আত্মীয়ের রুপোর ঘড়ি উদ্ধার করে দিয়েছে, শিশুচুরির একটা কেস সমাধান করেছে এবং একদল ব্যাঙ্কডাকাতকে ধরে ফেলেছে।
আরও পড়ুন
রহস্যের দুনিয়ায় হাসির জোগান দেন গোয়েন্দা বরদাচরণ
সে সময়কার তুলনায় কিট্টু বেশ ধনী পরিবারেরই সন্তান বলা চলে। পার্ক সার্কাসের কাছেই তাদের বড়ো দোতলা বাড়ি। বাবা-মা কর্মসূত্রে বিদেশে। ফলে কিট্টু একাই থাকে সে বাড়িতে। এখানেই হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে কিট্টু দেখবে ভেতরে কে যেন রয়েছে। বেল বাজাতে এক বিনয়ী ভদ্রলোক দরজা খুলে জানাবেন জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কাগজে কিট্টুর দেওয়া সর্বক্ষণের কাজের ও রান্নার লোকের বিজ্ঞাপনটি দেখে সোজা চলে এসেছেন এবং কিট্টু নেই দেখে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে ঘরদোর, রান্নাঘর ঝকঝকে তকতকে করে তার অপেক্ষা করছেন। এইরকম বিচিত্রভাবেই আবির্ভাব ঘটে বাঘাকাকার, যিনি এরপর থেকে শুধু রাঁধুনি বা সর্বক্ষণের কাজের লোক নয়, হয়ে উঠবেন কিট্টুর সহকারী। অবশ্য সহকারী না বলে গুরু বলাই ঠিক হবে বোধহয়। কারণ এরপর বাঘাকাকার সাহায্য ছাড়া কিট্টু একটাও রহস্য ভেদ করতে পারেনি। বরং বলা যায় বাঘাকাকাই সব রহস্য তার আগে ভেদ করেছেন। কিট্টু আর তার খুড়তুতো ভাই প্রকৃতিপ্রসাদ কেসগুলো নিয়ে বিস্তর খাটাখাটনি করেও শেষমেষ বাঘাকাকার বানানো মাংসের সিঙারা বা সিরাজি পোলাও খেতে খেতে সে রহস্যভেদের কাহিনি শুনেছে কেবল হাঁ করে। হ্যাঁ, কিট্টু লাহিড়ির গল্পে খাওয়াদাওয়ার ভূমিকা বেশ বড়। কখনো বাঘাকাকা কখনো সুপ্রিয়াপিসির বাড়ি এলাহি খাওয়াদাওয়া চলতেই থেকেছে সব গল্পে।
আরও পড়ুন
'কিট্টুর গুরুলাভ’ গল্পে ঝাড়গ্রামের কাছে বিজ্ঞানী শান্তশিব সমাদ্দারের অ্যাসিস্ট্যান্ট তাঁর রিসার্চের সব কাগজপত্র এবং টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যান। সেই রিসার্চের ফর্মুলা কিনতে আমেরিকার একটি ওষুধ কোম্পানি কোটি কোটি টাকা খরচ করতে রাজি। কিট্টু তদন্তে নামে এবং ঝাড়গ্রামে গিয়ে সব ঘুরে দেখে, সকলের সাথে কথা বলে। সেখান থেকে পাওয়া চিঠির সূত্র ধরে কলকাতাতেও তদন্ত চালায়। এর মধ্যে খুন হয় বিজ্ঞানী শান্তশিববাবুর ড্রাইভার। কিছুতেই সমাধান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাঘাকাকার শরণাপন্ন হয় কিট্টু। বাঘাকাকা কাবুলিওয়ালা সেজে সেখানে পৌঁছন এবং একটু একটু করে রহস্যের পর্দা উন্মোচন করেন। অর্থাৎ বাঘাকাকাকে ঠিক মাইক্রফট হোমসের মতো আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ বলা যায় না। কিট্টু আর প্রকৃতির ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট শুনেই যে তিনি রহস্যের সমাধান করে দেন তা নয়। নিজেও মাঠে নেমে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করেই সিদ্ধান্তে আসেন। এবং অমলেট করতে গিয়ে হিমানীশ গোস্বামীর গোয়েন্দা কিট্টু লাহিড়ি যখন পকেট থেকে ডিম ফেলে ফাটিয়ে ফ্যালে আর সসপ্যান পুড়িয়ে ঝামা করে ফ্যালে, তখন তার গুরু বাঘাকাকা যে কাবুলিওয়ালা সেজে নকল দাড়ি চুলকোতে গিয়ে ধরা পড়ে পিটুনি খাবেন সে আর আশ্চর্য কী!
আরও পড়ুন
কাস্ত্রোকে ভালোবেসে হত্যা করতে চেয়েছিলেন যে গুপ্তচর
‘বিচিত্র পাথর রহস্য’ গল্পেও সুপ্রিয়াপিসির বাড়ির পার্টিতে মূল্যবান পাথরচুরির তদন্তে নেমে অনেকে জেরা করে, অনেক মাথা খাটিয়েও কিট্টুকে সেই শেষপর্যন্ত বাঘাকাকার শরণাপন্ন হতেই হয়। এই সুপ্রিয়াপিসিও একজন ভারী মজার মানুষ। তিনি অজস্র কথা বলেন, দারুণ রাঁধেন এবং এই গভীর ষড়যন্ত্রে তাঁর নিরীহ স্বামী, কবিপুত্র মিহির থেকে চিনে গুণ্ডা অবধি সবাইকে সন্দেহ করেন। মিহির আবার ভয়ানক বিচ্ছিরি সব কবিতা লেখে। এইসব মজার চরিত্র নিয়েই কিট্টু লাহিড়ির গোয়েন্দা গল্প এগিয়ে চলে।
'পুরনো বইয়ের রহস্য' গল্পে আমরা দেখি এক প্রাচীন বইয়ের মলাটের ভিতর থেকে পাওয়া উইলে গুপ্তধনের সন্ধান, সেই বই ফেরত দেওয়ার জন্য হুমকি চিঠি, চোরের হানা এবং রহস্যভেদে কিট্টু লাহিড়ির বারাসাত থেকে খড়দা হয়ে টালিগঞ্জ অবধি চষে বেড়ানো। এ গল্পের কিট্টু অনেকটা পরিণত। প্রকৃতিপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষ গোয়েন্দার মতই একের পর এক সূত্র ধরে ধরে জট ছাড়িয়ে রহস্যের কিনারা করার দিকে অনেকটা এগিয়ে যায়। কিন্তু বাদ সাধেন সেই বাঘাকাকা। তাঁর চ্যালাচামুন্ডা জালিয়াত জুলু শিকদার, পকেটমার সুরপ্রসাদ ইত্যাদিদের সাহায্য নিয়ে আসল রহস্য ভেদ করেন সেই তিনিই।
কিট্টু লাহিড়ির গোয়েন্দাকাহিনির স্বাতন্ত্র্য এখানেই। আর কোনও গোয়েন্দা গল্পেই সহকারী স্বয়ং গোয়েন্দাকে টেক্কা দিয়ে একের পর এক রহস্য সমাধান করছেন - এমনটা দেখা যায়নি বোধহয়। আবার সেই সহকারী বা প্রকৃতপক্ষে আসল গোয়েন্দা নিজেই সদ্য জেল খেটে বেরিয়েছেন এরকম উদাহরণও ভূভারতে আছে কিনা সন্দেহ! আর আছে গোয়েন্দা গল্পের মোড়কে অফুরন্ত হাস্যরস। গাড়ি নিয়ে স্টেশনে কাউকে রিসিভ করতে গিয়ে ট্রেন লেট করায় অপেক্ষারত তৃষ্ণার্ত ড্রাইভার পটাসিয়াম সায়ানাইড মেশানো জল খেয়ে মারা যায় এবং পুলিশ সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইলে উদাস বাঘাকাকা ঘোষণা করেন- ‘ট্রেন লেট করার জন্য বোধহয় পৃথিবীতে এটাই প্রথম আত্মহত্যা।’ আর একটি গল্পে কোটিপতি আমেরিকান মিস্টার সিটওয়েলের সাথে দেখা করতে গিয়ে কালো কুচকুচে লুঙ্গিপরিহিত ভদ্রলোককে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা কিট্টু জানতে পারে খাস কলকাতার শীতল কুণ্ডু বস্টনে গিয়ে সিটওয়েল হয়েছেন। কোথাও আবার সুপ্রিয়াপিসি গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন –‘তোর পিসে বলে, অত পুরনো কার্পেট রেখে কী লাভ! বেচে দাও। আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু তোর পিসেরও একই মত বলে আমি অমত করেছি।’ এই সব টুকরো টুকরো রম্য রসিকতার মধ্যে দিয়েই গোয়েন্দা কিট্টু লাহিড়ির রহস্য গল্পকেও সরস জাদুকাঠির ছোঁয়া দিয়ে নিজস্ব স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিলেন হিমানীশ গোস্বামী।