কাইফি আজমি : এক অবিনশ্বর স্বপ্ন
বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। উর্দুভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সেখানে গড়ে উঠছে মুক্তিকামী মানুষের ঐক্য। পাকিস্তানি শাসকের বুলেটে ঢাকার ড্রেনে বইছে রক্তমাখা লাশ। সেই বেদনা থেকে উঠে এল শব্দ। শব্দ থেকে পংক্তি। এভাবেই জন্ম হয়েছিল ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটির। ভারতবর্ষের যে উর্দু কবির কলমে ভাষা পেয়েছিল বেদনার এই মর্মন্তুদ সুর, তিনিই হলেন কাইফি আজমি। এ কবিতায় সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান-পরিচয়কে নস্যাৎ করে তাঁর অন্তরাত্মা যেন মিশে গিয়েছিল ঢাকার ড্রেনে শুয়ে থাকা নিস্তব্ধতার সঙ্গে।
১৯১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের এক জমিদারবংশে জন্ম হয় কাইফি আজমির। তাঁর আসল নাম ছিল সৈয়দ আতাহার হুসেন রিজভি। শোনা যায়, মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি প্রথম গজল লিখেছিলেন।
মাত্র উনিশ বছর বয়েসে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির কাগজ ‘কউমি জং’-এ নিয়মিত লিখতেন তিনি। প্রগতিশীল লেখক সংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় কাইফি আজমির প্রথম কাব্যসংকলন ‘ঝংকার’। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো— ‘আখিরে-শব’(১৯৪৭), ‘আওয়ারা সাজদে’(১৯৭৩), ‘মেরি আওয়াজ শুনো’(১৯৭৪), ‘ইবলিস কি মজলিস-এ শোরি’(১৯৮৩) প্রভৃতি। নারীর অধিকারের পক্ষে, ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে বারংবার গর্জে উঠেছে তাঁর কলম। তিনি কবিতাকে সমাজ পরিবর্তনের অংশরূপে গণ্য করতেন। বিপ্লব ও কবিতা একাকার হয়েছিল তাঁর মননে। ‘আওয়ারা সাজদে’-এর জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ‘ম্যায় ঔর মেরি শায়েরি’ প্রবন্ধে তিনি উন্মোচন করেছেন তাঁর জীবন ও ভাবনার নানা দিগন্ত।
শুধু কবিতাই নয়, তৎকালীন বম্বের একজন সফল গীতিকার এবং চিত্রনাট্যকার হিসেবেও তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ১৯৫১ সালে শহীদ লতিফের সিনেমার মাধ্যমে পা রাখেন চলচ্চিত্র জগতের আঙিনায়। ‘কাগজ কে ফুল’(১৯৫৯), ‘আখরি খত’(১৯৬৭), ‘হকিকত’(১৯৬৪), ‘কোহরা’(১৯৬৪), ‘সাত হিন্দুস্তানি’(১৯৬৯), ‘পাকিজা’(১৯৭২) প্রভৃতি সিনেমায় গীতিকারের কাজ করেছেন। ‘কাগজ কে ফুল’-এর “ওয়াক্ত নে কিয়া” কিংবা “দেখি জমানে কি ইয়ারি”-র মতো গান বোধহয় একমাত্র তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব ছিল। চেতন আনন্দ পরিচালিত ‘হীর রঞ্জা’(১৯৭০) সিনেমার সমস্ত সংলাপ কবিতায় লিখে গড়েছিলেন অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এম. এস. সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’(১৯৭৩) ছবির সংলাপ ও চিত্রনাট্যের জন্য পেয়েছিলেন ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার। ‘সাত হিন্দুস্তানি’-তে গীতিকার হিসেবে সম্মানিত হন ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে। এছাড়া পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ পেয়েছেন আরও নানা সম্মাননা। ১৯৪৭ সালে বিয়ে করেন থিয়েটার অভিনেতা শওকত কাইফিকে। তাঁদের দুই সন্তান হলেন বিখ্যাত অভিনেতা শাবানা আজমি ও চিত্রগ্রাহক বাবা আজমি। ২০০২ সালের ১০ জুলাই মুম্বাইতে মৃত্যু হয় কাইফি আজমির।
আমৃত্যু মার্কসীয় দশর্নে বিশ্বাসী ছিলেন কাইফি আজমি। বিশ্বাস রাখতেন যে তাঁর জীবদ্দশায় ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র আসবে। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতে বুনে রাখতেন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বীজ। তিনি একবার বলেছিলেন— “জন্মেছি পরাধীন ভারতে, বড়ো হলাম স্বাধীন ভারতে, মরতে চাই সমাজতান্ত্রিক ভারতে।”
বাংলাদেশে কাইফি আজমি পেয়েছিলেন ‘মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা’। অথচ তাঁর নিজের দেশে তিনি যেন বিস্মৃত এক মহীরুহ। বর্তমান প্রজন্মের বামপন্থীদের মুখে সচরাচর তাঁর নাম শোনা যায় না। মিছিলে উচ্চারিত হয় না তাঁর কবিতা। অবশ্য কাইফি আজমি বিশ্বাস করতেন না রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখাকে। তিনি বলেছিলেন সাধারণ মানুষের ইতিহাস আছে, ভূগোল নেই। সাধারণ মানুষের উপর তাঁর আস্থা সারাজীবন অটুট ছিল।
[ পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#ফিচার