শরীর ও মন

জোহারির জানলা : মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যার এক চমকপ্রদ প্রয়াস

ইমানুর রাহমান Oct 7, 2020 at 7:19 am শরীর ও মন

‘আমার মধ্যে দু’জন মানুষ আছে
তুমি কাকে চাও?
তাকে, না আমাকে?’

সদ্যপ্রয়াত নবনীতা দেবসেন একটি কবিতায় লিখেছিলেন। জোসেফ লুফত আর হ্যারি ইংহ্যাম নামে দুই মনোবিদ তাঁদের ‘জোহারির জানলা’ (Zohari Window) নামক থিওরিতে বলেছেন, দুজন নয়। চারজন। তবে ‘জন’ ঠিক বলছেন না তাঁরা। তাঁদের মতে, মানবমনের চারটি খণ্ড। চারটি সত্তা। আর এই সত্তাগুলিকে চিহ্নিত করা যায় তখনই, যখন মানুষ অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

আদতে সেলফ-হেল্প প্রজেক্ট হিসেবে শুরু হওয়া এই ধারণাটি অতি দ্রুত কর্পোরেট জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে এবং আধুনিক সমাজ-মনোবিজ্ঞানের আলোচনায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে উঠেছে। সমাজ- মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন। ‘জোহারির জানলা’ ধারণাটি আলোকপাত করতে চেয়েছে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগের বিষয়টিতে। জোসেফ লুফত আর হ্যারি ইংহ্যাম তাঁদের দুজনের নামের প্রথমাংশ যোগ করে ‘জোহারি’ শব্দটি তৈরি করেছেন। তাঁরা বলছেন, একজন মানুষ যখন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন বা যোগাযোগ করছেন, সেই মুহূর্তে তিনি আসলে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে তাঁর মনের জানলা খুলে দিচ্ছেন। মনকে যদি জানলার মতো ভাবা যায়, তাহলে সেই জানলার চারটি অংশ। প্রথম খণ্ডটি নিজের কাছেও জানা, অন্যের কাছেও সুপরিচিত। এর নাম Open Space। দ্বিতীয় খণ্ডের নাম Hidden Area। এই অংশটি শুধুমাত্র নিজের কাছে জ্ঞাত, অন্যের কাছে গোপন। তৃতীয় ভাগটি বেশ কৌতূহলপ্রদ। এই অংশটি নিজের কাছে অস্ফুট, কিন্তু অন্যের কাছে জানা। নাম Unknown Area। অর্থাৎ আমাদের সচেতন মনের কাছে গোপন, কিন্তু অন্যের কাছে উন্মোচিত। আর চতুর্থ খণ্ডটি হল Blind Spot। যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেও জানেন না, অন্যেও জানে না। এই অংশটি অজ্ঞাত শুধু নয়, কার্যত অজ্ঞেয়।

নিজেকে জানা, নিজের ব্যক্তিত্বকে বোঝা, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের ধরন এবং মাধ্যম কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে অবগত হওয়া - এইসব জরুরি বিষয়ে পৌঁছতে সাহায্য করাই এই থিওরির উদ্দেশ্য। সাধারণ সমাজজীবন হোক বা কর্মক্ষেত্র, সব দিক থেকেই এই ধারণাটি মানুষকে আত্মসচেতন হতে সাহায্য করে। কারণ জীবন মানেই যোগাযোগ - কানেকশন এবং কমিউনিকেশন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন মানে সুস্থ স্বাভাবিক কানেকশন এবং কমিউনিকেশন। আজকের কর্মচঞ্চল দুনিয়ায় এই ধারণাটি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আশা করি পাঠক বুঝতে পারছেন। পুঁজির সাম্রাজ্যবাদ যেদিন থেকে একান্তভাবেই মনোজগতে জমি খুঁজতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই এই মনস্তাত্ত্বিক কৌশল বা ধারণাগুলির স্বর্ণযুগ। ফলে কর্পোরেট জগৎ এই ‘জোহারির জানলা’-র থিওরিকে কাছে টেনে নিতে দেরি করেনি। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি সফট স্কিল জাতীয় জিনিস (মূলত কমিউনিকেশন স্কিলেরই বিভিন্ন দিক) অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘ম্যানেজমেন্ট’ শব্দের পরিধি বিস্তৃত হতে হতে সমস্ত ক্ষেত্রকে স্পর্শ করে ফেলছে। বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আলাদা করে যত্নশীল হতে শুরু করেছে এইসব অফবিট কোর্সের দিকে। লিডারশিপ, ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্রিটিকাল থিংকিং, স্টোরি টেলিং (পারসুয়েশন এবিলিটি), সোশ্যাল ক্যাপিটাল ইত্যাদি নানারকম ধারণা আচমকা শিক্ষণীয় বিষয়ের অন্তর্গত হয়ে উঠছে। আমাদের চারপাশের দুনিয়ায় ‘নেগোসিয়েশন’ বা ‘ডিল মেকিং’-এর মতো শব্দগুলো যত বেশি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে, ‘জোহারির জানলা’র মতো থিওরিগুলি তত গুরুত্ব পাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, ব্যক্তিজীবনেও এই দৃষ্টিভঙ্গি কাজে দেবে। নিজেকে বুঝতে, অন্যকে বুঝতেও। আর এই বোঝার রাস্তা যত সুগম হবে, পারস্পরিক সম্পর্ক ততই সুস্থ স্বাভাবিক হবে। তাই ‘জোহারির জানলা’ দিয়ে ঠিকঠাক উঁকি মারতে পারলে, যে কোনও দিক থেকেই হোক, লাভ আপনারই।    




#johari window #self-awareness #Psychology #mutual understanding #relationship #communication #মনস্তত্ত্ব #আত্ম-সচেতনতা #পারস্পরিক বোঝাপড়া #পারস্পরিক সম্পর্ক #মনস্তাত্ত্বিক কৌশল #Joseph Luft #Harry Ingham #সিলি পয়েন্ট #ইমানুর রাহমান

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

53

Unique Visitors

217960