জয়ং দেহি : পুরনো গেলাস, পানীয় নতুন
..................
ছবি : জয়ং দেহি
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : আবীর রায়
প্রযোজনা : ড্রিমসিটি আর্টিস্টস
অভিনয় : সায়নী চক্রবর্তী, সাগরদীপ রায়, শুভঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ
কোথায় দেখবেন : ইউটিউব
..................
বাইনারি ব্যাপারটা খুব সহজলভ্য, একইসঙ্গে স্লো পয়জনের মতোও বটে। দুইয়ের মাঝে লম্বা দাগ কেটে তুলনা করার বাইরে তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম মতামতকে জায়গা দেবার কষ্ট করতে চায় না কিছুতেই। অসুর আর দেবতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ নিয়ে 'মহালয়া'-র ঘূর্ণাবর্তটাও ঠিক একই রকম। একটা সময় অব্দি দেবতাদের নির্দ্বিধায় পুজো করা হত। আজকাল কিছু মানুষ মোহ ভেঙে অসুরকে গ্লোরিফাই করেন পুরাণ ঘেঁটে। কিন্তু কোনো পক্ষ না নিয়ে দু-পক্ষের অন্তর্নিহিত রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা না করে দীর্ঘকাল 'মহালয়া'-কে শুধুই এক নস্টালজিক আবর্তে ফেলে টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট সমস্ত মিডিয়াতেই আমাদের গেলানো হয়েছে। এবং আমরাও চাইনি তার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য কিছু জানতে বা ভাবতে।
'জয়ং দেহি' নামক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মটিতে সেই অনুসন্ধান রয়েছে। স্বর্গলোক যাতে বেহাত না হয়, সেজন্য দেবরাজ ইন্দ্র রম্ভাসুরকে বারবার তার একনিষ্ঠ ধ্যান থেকে বিরত করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা অসফল হয় অগ্নিদেবের বদান্যতায়। রম্ভাসুর তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায় স্বর্গ আক্রমণ করে। ইন্দ্র তার ভাইকে ধ্যানভঙ্গ করে হত্যা করতে সফল হয়েছিলেন। রম্ভাসুরের ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হন। কিন্তু রম্ভাসুরকে বধ হতে হয় মহিষীর পিতার হাতে, অসুর হয়েও মহিষকুলের অপ্সরা এবং তার স্ত্রী মহিষীকে ভোগ করার ক্রোধে। রম্ভাসুর মহাদেবের থেকে ত্রিলোকবিজয়ী পুত্রের বর পাওয়ায় তার স্ত্রী শোকাহত মহিষী সহমরণের উদ্দেশ্যে চিতায় আরোহণ করে। সেই পরিস্থিতিতেই তার গর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয় তার ও রম্ভের মিলনজাত সন্তান, অর্ধেক মহিষ- অর্ধেক মানব মহিষাসুর। রম্ভ নিজেও পুত্রস্নেহবশত চিতা থেকে উত্থিত হয় এবং থেকে যায় রক্তবীজ হয়ে।
পুরাণের এত বিশ্বস্ত রেফারেন্স অধিকাংশ 'মহালয়া'-তেই থাকে না। শুধু স্পেশাল এফেক্ট, রূপসজ্জা, আবহসঙ্গীত দিয়ে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করলেও বছর-বছর এই অনুষ্ঠানগুলো একই একঘেয়ে বৃত্তে ঘুরপাক খেয়ে আসছে। বিভিন্ন চ্যানেলের 'মহালয়া' থেকে দর্শক আজকাল হাসিঠাট্টার খোরাকই বেশি পান। 'জয়ং দেহি' কিন্তু দর্শককে অন্যরকম ভাবনার খোরাক দেবে। এই ছবির সবচেয়ে ইতিবাচক জায়গা নিঃসন্দেহে নিবিড় গবেষণা। ইতিহাস-বিস্মৃত হয়ে আদতে আধুনিক হওয়া যায় না। কোনো পক্ষকেই ওভারগ্লোরিফাই করার ছক ভেঙে তাই এই সিনেমা বহুমাত্রিক সম্ভাবনা জাগায়। ক্লাইম্যাক্সে দুর্গার অসুরকে শত্রুনিধনের মধ্যে দিয়ে শুধুই শুভ-অশুভের দ্বৈততা থেকে বেরিয়ে অসুরকে যোগ্য যোদ্ধা হিসেবে বীরের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টা একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বক্তব্য। অসুরের পরাক্রমশালী লড়াই চিরকাল একইভাবে পূজিত হবার বার্তা যে-কাউকে জীবনযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করবে। এই রেফারেন্সগুলো পুরাণকে শুধুই এক অলীক কাল্পনিক ঘটনাক্রমের বাইরে গিয়ে দর্শককে জীবনের সাথে সম্পর্কসূত্র খুঁজে পাবার অনেক রসদ দেয়। আজও তো সাঁওতালরা মহিষাসুরকে 'হুদুড় দুর্গা' নামে পুজো করে থাকে।
যে-কোনো পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সমসময়ের সঙ্গে তার যোগসূত্র স্থাপন করতে পারা-না পারার বিষয়টি। বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে, একমাত্রিক অপব্যাখ্যা করে পুরাণকে শুধুই রাজনৈতিক স্বার্থের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করা হয়। পুরাণের ঘটনাবলীর মেটাফোর থেকে বর্তমান জীবন বা সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে রিলেট করার বদলে তাকে অন্ধ অনুকরণ করা হয় অথবা তাকে সরাসরি ইতিহাস হিসেবেই তুলে ধরা হয়। ইতিহাস এবং পুরাণ তো এক নয়। এই দুই বিষয়কে এক করার চেষ্টা মানে শুধু ইতিহাস নয়, পুরাণকেও বিকৃত করা। সেদিক থেকে দেখলে এই আধুনিকতার প্রয়াস এবং অনুসন্ধান আশাজনক হয় যখন দেখানো হয় রম্ভাসুরের লিগ্যাসি রক্তবীজের মধ্যে দিয়ে কার্যত অমর হয়ে থেকে যাচ্ছে। জয়-পরাজয়, ভালো-মন্দের একমেটে দ্বন্দ্ব ছেড়ে জীবনের জার্নির কথাই এখানে প্রধান হয়ে ওঠে। দুর্গার কাছে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের যোগ্য সেনাপতিদের আগলে মহিষাসুরের নিজে এগিয়ে গিয়ে লড়াই করা, দেবতাদের মধ্যেও ক্ষমতা ধরে রাখার লোভ, আলস্য, অসুরকুলের বিক্রম এবং স্ট্রাগলকে যথার্থ অনুধাবন না করার সত্যকে সামনে আনা, আবার অসুরকুলের ক্ষমতার অলিন্দে এসে ঠিক একই ভুল করা, ক্ষমতা ব্যবহারের ধরন - এ সবই দর্শককে ভাবাবে। কারণ এসব গড়পড়তা 'মহালয়া'-য় দেখার সুযোগ মিলবে না।
কিন্তু এইসব অমিত সম্ভাবনার জায়গাগুলোকে সবসময় একশো শতাংশ যথাযথভাবে সিনেম্যাটিক মোমেন্টে রূপান্তরিত করা গেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। চিত্রনাট্য, সম্পাদনা, মেকিং এবং ট্রিটমেন্টে বারবার কিছু দুর্বলতা ধরা পড়ে। ফলে এই সমস্ত রেফারেন্স এবং দর্শন দর্শকমনে গভীর দাগ কাটতে পারবে কিনা, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অভিনয়ও এই সিনেমার আরেকটি দুর্বল দিক। অনেক উল্লেখযোগ্য সংলাপ এবং মুহূর্তে আরো যত্নশীল হওয়া যেত। অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ এক্সপ্রেশন ছাড়া সংলাপগুলো শুধুই আওড়ে যাওয়া হয়েছে। আবহসঙ্গীতের ব্যবহারে আরও পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ ছিল। সুপারফিসিয়াল স্পেশাল এফেক্টগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতে পারেনি তার পরিমিতির অভাবে। সিনেমাটোগ্রাফিতেও নতুনত্বের ছাপ পাওয়া যায় না সেভাবে। বাজেট হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব ক্ষেত্রে বাজেটকে দোষ দেওয়া যাবে না বোধহয়। তবে এই প্রচেষ্টা হয়তো ভবিষ্যতে আরো কিছু পুরাণ-সম্পর্কিত কাজকে নতুন ভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। সেটাই এই সিনেমার সম্ভাবনার দিক। ফিকশনাল ক্লাসিক সাহিত্যের মতোই, পৌরাণিক টেক্সটকেও 'লার্জার দ্যান লাইফ' দেখানো বা ভাবার পরিবর্তে তাকে বহতা জীবনের বিন্দুতে বিন্দুতে মিশিয়ে দেবার এই প্রয়াস নিশ্চয়ই উস্কে দেবে ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়ে আরও আরও কাজের সম্ভাবনাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই তো বদলায়। ছোটবেলায় কান্নার সময় যে হজমি মন ভোলাত, বড় হয়ে বদহজমে তা আর একই ভাবে কাজ করে না। 'জয়ং দেহি' যথার্থই বড়দের মহালয়া, চিন্তাশীলদের মহালয়া। এ ছবি মহালয়ার সেই সাবেকি মুগ্ধতাকে ধরে রেখেই দুর্গা-মহিষাসুরের দ্বন্দ্বের ইতিহাসকে চলতি জীবনের ধারাপাতে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে শেখায়। এই জার্নিটুকুই পুরাণ-উৎসাহী দর্শকের আগামীর ভাবনার হাইওয়েতে অতীতের মাইলফলক হতে পারে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার তফাৎ তো গুণগত নয় ঠিক, মাত্রাগত। ঐতিহ্যই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে পাল্টাতে পাল্টাতে যথাসময়ে আধুনিকতা হয়ে যায়। 'জয়ং দেহি' ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এই একাত্মতাকে চিনিয়ে দেয়।
........................
[সিলি পয়েন্ট 'জয়ং দেহি' ছবির মিডিয়া পার্টনার]
#Jayang Dehi #Independent Film #Bengali Film #জয়ং দেহি #silly পয়েন্ট