জয় জওয়ান জয় কিষাণ ইত্যাদি…
পাঠান মুক্তির আগে যে হারে ‘হা রে রে রে রে’ রব উঠেছিল তাতে জওয়ানের আগের নৈঃশব্দ্য বেশ নতুন। শাহরুখ-ভক্তরা বুর্জ খালিফায় ছবির অ্যাকশন-বোঝাই ট্রেলার রিলিজ দেখে দিব্য ছিলেন। কিন্তু এই নৈঃশব্দ্য যে ঝড়ের পূর্বাভাস তা কে জানত! ‘জিন্দা বান্দা’-র অন্তরালে কী আছে তা টেরটিও কেউ পাবে না- এটিই হয়ত এটলি এবং রেড চিলিজ চেয়েছিল। না হলে ছবি মুক্তির আগেই ‘বয়কট বলিউড’-এর ডাক পড়ার সম্ভাবনা ছিল আবার। জওয়ান বয়কটের ডাক কয়েকদিন আগে উঠলেও তা ধোপে টেকেনি, কারণ বাইরে থেকে দেখতে গেলে তেমন বিতর্কের মশলা ছিল না। দেশের যোদ্ধাদের গল্প দেখতে কে না ভালবাসে।
প্রধানমন্ত্রীর সেই ভাষণ নিশ্চয় মনে আছে, “আমাদের জওয়ানরা সিয়াচেনে লড়ছে।” বিতর্কের মশলা ছিল না বলে আমার মতো লোকেরা, যারা শাহরুখ খানের ‘ভক্ত’ নয়, তারা বোধহয় টেরও পায়নি ‘জওয়ান’ বলে কোনও ছবি মুক্তি পেতে চলেছে। কিন্তু পাকেচক্রে গিয়ে সিনেমা হলে পৌঁছে দেখা গেল, আইটি সেলের আঙুলের ফাঁক গলে শাহরুখ একটি বোমা নিয়ে হাজির হয়েছেন।
বলিউড সম্বন্ধে দুই ধরনের জনমত বাজারে খুব চলছে। প্রথম দল, “বয়কট বলিউড” বলে সারাক্ষণ চ্যাঁচান। আর দ্বিতীয় দল, ধরেই নিয়েছে তথাকথিত মেনস্ট্রিম বলিউড ইন্ডাস্ট্রি প্রশ্ন তুলতে ব্যর্থ (আমি এই দলের লোক)। কিন্তু এমনটা কিছুদিন আগেও ছিল না। ‘রঙ দে বাসন্তী’ কিংবা ‘দ্য ওয়েডনেস ডে’ অনেক প্রশ্নই খাড়া করে। সুপার ডুপার ব্লকবাস্টার হওয়াই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু, বর্তমানে কয়েকজন পরিচালক বাদে প্রশ্ন তোলার কাজটা কেউ করছিলেন না। আর তথাকথিত সুপারস্টাররাও গুটিয়ে ছিলেন। আমির খান নানান ছবিতে তার অবস্থান স্পষ্ট করলেও জনতার দরবারে তিনি ‘দেশদ্রোহী’ তকমার অধিকারী হয়ে গেছেন ২০১৪-এর পর থেকে। আর তাই তাকে একঘরে করে দেওয়াটাও খুব সহজ। বাকি দুই খানের কেউ হুট করে এমন কিছু করবেন, যা ভারতের বর্তমান অবস্থাকে দর্শায় - এমনটা কষ্টকল্পনাই ছিল। কারণ, তাতে তাদের দর্শকের সংখ্যা কমে যেতে পারে। এমতবস্থায় দক্ষিণী পরিচালকের হাতে ও শাহরুখ খানের দুঃসাহসে শাপমোচন কিছুটা ঘটল।
ভারতে গণতন্ত্র কতটা বেঁচে আছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেকদিনই। ফ্রিডম হাউসের ২০২১ এর রিপোর্ট বলে, ভারত এখন ‘ইলেকটেড অটোক্রেসি’-তে পরিণত। গণতন্ত্রের টিকে থাকা তখনওই সম্ভব যখন ভোটার দায়িত্ব নিয়ে ভোট দেয়। ধর্মের আবেগ, উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজা দেখে ভোট দেওয়া নাগরিক গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। কারণ, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার উপায় ভোটদান হলেও তার মূলমন্ত্র আলোচনা-পর্যালোচনা। সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন। অমৃতকালের সংসদীয় গণতন্ত্রে আমরা দেখেছি কীভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ না রেখে একের পর এক আইন পাশ করা হয়। কীভাবে হুট করে রাত দুপুরে প্রধানমন্ত্রী এসে নোটবন্দীর মতো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে জনতার সামনে হাজির করেন। কোভিডে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাহাকার পড়ে গেলেও তা নিয়ে যথাযথ জবাবদিহি করেন না নেতামন্ত্রীরা। দীর্ঘদিন ধরে জ্বলতে থাকা মণিপুরকে নিয়ে এক মিনিটে জবাব সাঙ্গ করেন ‘প্রধান সেবক’। চিন ভারতে ঢুকে বসে থাকলেও তা সহজভাবে এড়িয়েই যাওয়া হয়। আর ‘বুলডোজার রাজ’-কে প্রতিষ্ঠা করা হয় গণতন্ত্রের নামে। এতকিছুর পরও ২০২৪ এর ভোটের আগে সদর্পে সংসদে অমিত শাহ বলতে পারেন যে বিরোধীরা বুঝতে পারছেন না, তবে ভোটে তো তারাই আবার হারবেন। এই ঔদ্ধত্যের কারণ বোধহয় একটাই। শাহ জানেন যে জনতার ভোট আর চাকরি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্ববহ বিষয়কেন্দ্রিক নয়। নীরব মোদী-বিজয় মাল্যরা আমাদেরই টাকা নিয়ে কেটে পড়লেও আমাদের কিছু আসে যায় না। কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় দিয়ে কৃষকের ঋণ মুকুব না করলেও ‘আব কি বার বিজেপি সরকার’। কারণ, ভারতের অধিকাংশ জনগণ ভোটের সময় মেকি দেশপ্রেম ও ধর্মের নেশায় বুঁদ। ২০১৪ সাল থেকে ভারত ও ‘ভাজপা’-কে সমার্থক প্রতিপন্ন করতে সফল হয়েছে বিজেপি। তাই বিরোধী স্বর প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ‘ইন্ডিয়া’ নামে একত্র হলেও রোজ টিভির পর্দায় বিদ্রূপের রূঢ় স্বরে অ্যাঙ্কররা যা চালাচ্ছিলেন তাতে বিরোধী ঐক্যের টেকা দায়! এই পরিস্থিতিতে একমাত্র শিল্পের হাত ধরেই উপরের সব ঘটনাকে সম্বোধন করা সম্ভব। কিন্তু আজকাল ভারতের ‘কেরালা স্টোরি’ আর ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর যুগ চলছে। বর্তমান সরকারের স্বরে স্বর মিলিয়ে মিথ্যাচারিতাকেই শিল্পের নতুন পথ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হচ্ছিল। উপরোক্ত সমস্যা নিয়ে কেউ মুখ খুললে বিপদ আছে বলে শিল্পীরা চুপ ছিলেন। কিন্তু এটলি ও শাহরুখ খানের জুটি অ্যাকশন থ্রিলারের নাম করে উপরের সমস্যাগুলিকেই তাগ করেছেন। ২ ঘন্টা ৪৯ মিনিটে যেমন নানান লুকে শাহরুখকে দেখা যায়, তেমনই পাওয়া যায় কিছু মোক্ষম রাজনৈতিক সংলাপও। দ্রুতগতির প্রথমার্ধের শেষের চমক দ্বিতীয়ার্ধকে আরও টানটান করে। আর দ্বিতীয়ার্ধেই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকের চোখে চোখ রেখে মোনোলগে এতদিনের চুপ করে থাকা শাহরুখ খান সোচ্চার হন।
অভিনেতাদের তালিকায় নয়নতারা, বিজয় সেতুপতি থেকে আসামের অভিনেতা কেনি বসুমোতারির উপস্থিতি সারা ভারতকে জোটবদ্ধ করেছে পর্দায়। নেপোটিজমের দোষারোপে ডুবে থাকা বলিউডকেও বেশ কিছুটা ধাক্কা দেয় এই ছবির কাস্টিং। বাংলায় প্রথম দিনের ১১০০ শোই হাউজফুল হয়েছে। মুম্বইয়ে নৃত্যরত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভিডিও ভাইরাল হয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে। সারা ভারতব্যাপীই ছবিটা প্রায় এক। কোভিড-পূর্ব যুগের শাহরুখ খানের ছবি রিলিজের উন্মাদনাকে যেন ফিরিয়ে এনেছে এই ছবি। অর্থাৎ, জনতা সামাজিক কথা শুনতে সিনেমা হলে যায় না, এ-কথা অসত্য। তাই বলিউডে অ্যাকশন আর সামাজিক বার্তার কম্বো প্যাক নতুন হিটের সমীকরণও হয়ে উঠতে পারে এই ছবি সুপার ব্লকবাস্টার হলে। দক্ষিণী ছবিতে এই সমীকরণ তো চলছে অনেক দিন ধরেই। মারকাটারি অ্যাকশন থাকলেও কেউ বলতে পারবে না যে, দক্ষিণী ছবি সামাজিক বা রাজনৈতিক কথা উচ্চারণ করতে ভয় পায়। বলিউডও এই পথ ধরলে তাই হবে প্রকৃত শিল্পমাধ্যমের কাজ। উজান স্রোতে এগোনোর সাহস তো শিল্পীরাই দর্শায়।
পুনশ্চ : রিভিউটিকে স্পয়লারহীন করার চেষ্টায় অনেক কিছুই বাদ রাখতে হল। এই ছবি হলে গিয়ে দেখলে ছবি ও ছবির রাজনীতি আরও স্পষ্ট ও সফল হবে বলে আশা রাখি।
..................
#Jawan #Shah Rukh Khan #SRK #Atlee #Nayanthara #Vijay Sethupathi #Red Chillies Entertainment #silly পয়েন্ট