জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (ষষ্ঠ পর্ব)
...............
পর্ব ৬ : দেশীয় শিল্পকলা ও জগদীশচন্দ্র
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোডে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজ এবং বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মাঝে যে লাল বাড়িটা, ওটাই জগদীশচন্দ্রের নিজস্ব বাসভবন, নাম আচার্য ভবন। গত শতকের গোড়ায় কিনে রাখা জমিতে এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু। তারপর বাকি জীবনটা তাঁর কাটে এখানেই। দার্জিলিং বা ফলতার মতো আরও কয়েকজায়গায় তিনি পরবর্তীকালে গবেষণার উদ্দেশ্যে বাড়ি বা বাগানবাড়ি বানিয়েছিলেন বটে, তবে তাঁর প্রকৃত বাসস্থান বলতে এই বাড়িটিকেই বোঝায়।
অপ্রশস্ত ভারি কাঠের তৈরি দরজা দিয়ে এই বাড়িতে কেউ ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে বাম দিকের কালো পাথরের কৃত্রিম ঝর্ণা ও নদী এবং সেটার ওপরে নুড়ি-পাথর দিয়ে তৈরি একটি সুসজ্জিত সেতু। ছোটবেলায় পূর্ববঙ্গের বাসার কাছে যেমনটা দেখে কেটেছিল তাঁর শৈশব, বা কৈশোর, সেই স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতেই এই নান্দনিক অলংকরণ নির্মাণ করিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। অজন্তার গুহাচিত্রের অনুকরণে বানানো হয়েছিল এই অংশটি।
স্থানীয় মানুষের কাছে ‘লালকুঠি’ নামে পরিচিত আচার্য ভবনের মূল অংশের চওড়া ভারি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই যে বড় ঘরটি, সেটা তাঁর বৈঠকখানা। অতিথিদের সঙ্গে এখানেই সাক্ষাৎ করতেন তিনি। এই ঘরে ঢুকে মাথার ওপরের দিকে তাকালে নজরে আসে চারদিকের দেওয়াল এবং ছাদে আঁকা ছবিগুলো। নন্দলাল বসুর আকায় ফুটে উঠেছে মহাভারতের নানা দৃশ্য। সেই সঙ্গে ‘অজন্তার গুহাচিত্রের অনুসরণে বুদ্ধদেবের জীবনের কাহিনী। মহাভারতের কাহিনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মনুষ্য জীবনের সেই চিরন্তন সমস্যা— জীবনের সংগ্রাম ও শান্তি। একদিকে দেখা যায় কুরুপাণ্ডবের দ্যূতক্রীড়ার জন্য এক পাশে বাজি হিসেবে রাখা আছে রাজমুকুট, আর অন্য পাশে যুদ্ধায়োজন এবং অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ প্রচারের দৃশ্য— “ক্লৈব্যং মাম্মগমঃ পার্থ।” দেওয়ালের আর এক দিকে দেখানো হয়েছে যুদ্ধশেষের অবস্থা— বিজয়ী পাণ্ডব ভ্রাতারা গালে হাত দিয়ে বিমর্ষভাবে বসে আছেন, কবে যে দেশে আবার শান্তি ফিরবে, সেটারই অপেক্ষা।
২.
এই বৈঠকখানারই উত্তর দিকের দেওয়ালে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা সেই বিখ্যাত ‘ভারতমাতা’ ছবিটি। তবে তাঁর চেয়ে নন্দলাল বসু-র কাজের পরিমাণ এখানে অনেকটাই বেশি, সে-কারণে নন্দলালের আগেকার জীবনের কথা এখানে কিছুটা অন্তত না বলে পারলাম না।
এখনকার বিহারের মুঙ্গের প্রদেশের এক গ্রাম-এলাকা হাভেলি-খড়গপুরে জন্ম নন্দলাল বসুর। তারিখ ছিল ১৮৮২-র ৩ ডিসেম্বর। বাবা পূর্ণচন্দ্র ছিলেন ওই এলাকার একজন সরকারী কর্মচারী। আদতে তাঁরা ছিলেন বাংলা প্রদেশের লোক। নন্দলালের পড়াশুনো দ্বারভাঙ্গা আর কলকাতার স্কুলে। কলকাতায় তিনি পড়তেন ক্ষুদিরাম বসুর সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে। এখান থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন ১৯০২ সালে। এরপর শুরু হয় কলকাতা-বাস। ছোট থেকেই এলাকায় মূর্তি নির্মাণ এবং পুজো প্যান্ডেল অলংকরণ করবার অভ্যেস তৈরি হওয়ায় তাঁর মধ্যে একটা শিল্পী-মন একটু একটু করে গড়ে উঠতে থাকে। কলকাতায় বসবাস করবার সময় তিনি চাইলেন, এবার শিল্পকলা নিয়ে চর্চা করবার পথেই এগিয়ে যাবেন। সেইমতো তিনি একদিন চেষ্টা শুরু করলেন সরকারী আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার। পাশাপাশি আর্ট বিষয়ক পুরনো বইপত্তর কিনে চলতে থাকে নিজস্ব প্রস্তুতি।
এর আগে তাঁর তিনটি কলেজে ঘুরে আসা হয়ে গিয়েছে। প্রথমে গিয়েছিলেন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনে, সেখানে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হওয়ায় চলে আসেন মেট্রোপলিট্যান কলেজে। সেখানেও কিছু হল না, শেষে প্রেসিডেন্সি। কিন্তু বানিজ্য শাখায় সেখানে ভর্তি হয়েও আশানুরূপ ফল হল না, অগত্যা চলে এলেন আর্ট স্কুলে।
চৌরঙ্গী এলাকায় যাদুঘরের পাশে আগের শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি হওয়া ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অভ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট’-এ ভাইস প্রিন্সিপাল বা উপাধ্যক্ষ তখন উনিশ শতকের একেবারে শেষ সম্বল। এখানকার প্রিন্সিপাল বা অধ্যক্ষ তখন আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল নামে এক ব্রিটিশ শিল্প-বিশেষজ্ঞ। এই হ্যাভেল সাহেব দায়িত্ব নিয়েই এখানকার আবহাওয়া বা শিক্ষার অভিমুখ বদলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। ভারতীয় আঙ্গিকে বা পদ্ধতিতে শিল্প-রচনার দিকে যাতে ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যায়, সেই ইচ্ছেয় তিনি এখানে দেশীয় শিল্প-শিক্ষা এবং প্রদর্শনের বন্দোবস্ত করতে উদ্যোগী হন। আর এই কাজেই তিনি পাশে টেনে নেন ঠাকুরবাড়ির উজ্জ্বল শিল্পী অবনীন্দ্রনাথকে। অধ্যাপনা করবার জন্য।
প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না অবনীন্দ্রনাথ। আভিজাত্য তাঁর রক্তে। আর্ট কলেজে পড়াতে গেলে তাঁর নাকি দুপুরের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। সে সমস্যার সমাধান করে দিলেন হ্যাভেল সাহেব। কলেজেই দুপুরেই অবনীন্দ্রনাথের বিশ্রামের জন্য শোওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন।
নন্দলাল বসু প্রত্যক্ষভাবেই এই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র। যৌবনে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে মনে-মনে ঠিকই করে নেন, এঁকেই তিনি এরপর থেকে গুরু বলে মানবেন।
নন্দলালের এক পিসতুতো দাদা অতুল মিত্র তখন সরকারী আর্ট স্কুলের ছাত্র। তাঁর কাছ থেকেই নন্দলাল জানলেন, এই স্কুলের উপাধ্যক্ষ। জেনেই তিনি স্থির করলেন, দেখা করবেন মনে-মনে মেনে নেওয়া গুরুর সঙ্গে। সেইমতো একদিন গেলেন নিজের আঁকা ছবি নিয়ে। সালটা ছিল ১৯০৬।
অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখে প্রথমেই কিচ্ছু জিজ্ঞেস না করে একটা বড় মাপের গণেশের মূর্তির সামনে বসিয়ে দিয়ে হাতে একটা বড় আর্ট পেপার দিয়ে বললেন, এঁকে দেখাতে। নন্দলাল খেয়াল করলেন, গুরু তাঁকে গোটা আর্ট পেপারেই গণেশ আঁকতে হবে এমনটা বলেননি, কথার সেই ফাঁক কাজে লাগিয়ে তিনি ওই কাগজের একটা কোণে ছোট্ট অথচ নিখুঁত একটা গণেশ এঁকে ফেললেন। সেই ছবি দেখে অবনীন্দ্রনাথ মুগ্ধ, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, স্কুল পালিয়ে আসা হয়েছে বুঝি? পড়াশুনোয় মন নেই, তাই আঁকা শিখতে এসেছ। তা লেখাপড়া শিখেছ কিছু?
নন্দলাল বললেন, ‘আজ্ঞে, স্কুল নয় কলেজ। তবে ফেল করেছি।’ (এই অংশটা ভারতশিল্পী নন্দলাল (১), নিমাইসাধন বসুর লেখা বই থেকে নেওয়া)
একদিন অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংঘাত বাঁধল সরকারী আর্ট কলেজের সাহেব কর্তাব্যক্তিদের। তাঁদের অন্যায় অভিযোগে পাত্তা না দিয়ে ঠাকুরবাড়ির সন্তান অবনীন্দ্রনাথ এক কথায় চাকরি ছেড়ে দিলেন। নন্দলাল গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নন্দলালও ছেড়ে দিলেন কলেজ। আরও কয়েক জন মিলে জোড়াসাঁকোর কাছেই একটা বাসা ভাড়া পাওয়া গেল।
জগদীশচন্দ্রের বাড়ির অলংকরণ ও নন্দলাল
জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে নন্দলালের আলাপ হয় ১৯০৯ সালের আগে। অনুঘটকের কাজ করেছিলেন ব্রহ্মচারী গণেন মহারাজ। তাঁদের মধ্যে শিল্পকলার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হত, নিজের স্মৃতিচারণে বলেছিলেন নন্দলাল। তাঁকে ছবি আঁকবার জন্য বেশ কিছু আইডিয়াও দিয়েছিলেন নানা সময়ে। বিশেষ করে মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রকে তিনি নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে ছবি আঁকবার প্রেরণা যোগাতেন।
মিসেস কানিংহ্যাম এবং ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে ১৯০৯ সালে যে টিম অজন্তার গুহাচিত্র আঁকবার জন্য যাত্রা করেছিলেন (এই প্রসঙ্গ আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছিলাম) সেই দলে ছিলেন জগদীশচন্দ্র এবং নন্দলালও।
ব্যক্তিগত সখ্যতার সুবাদে জগদীশচন্দ্র তাঁর নির্মীয়মাণ বিজ্ঞান মন্দিরের দেওয়ালে চিত্র অঙ্কনের জন্য বরাত দিয়েছিলেন নন্দলালকে।
১৯১৭ সালে স্থাপিত হয় বসু বিজ্ঞান মন্দির, এদেশীয়রা বিজ্ঞানচর্চায় সাহেবদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে, জগদীশচন্দ্রের দীর্ঘ দিনের এই স্বপ্ন সফল হয় এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার মধ্যে দিয়ে। বিজ্ঞান মন্দিরের মূল ভবনেই রয়েছে একটি প্রশস্ত লেকচার হল। যেখানে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন এখানকার আচার্য জগদীশচন্দ্র, বা কখনও দেশি-বিদেশি গুণী মানুষদেরকে এনে দর্শকদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ানো হত।
প্রায় বারোশো মানুষের বসবার বন্দোবস্ত রয়েছে যে লেকচার হলে, সেটার মূল মঞ্চের (অর্থাৎ যেখানে দাঁড়িয়ে বক্তা বক্তব্য রেখে থাকেন) পেছনের দেওয়ালে নন্দলাল বসু এঁকে দিয়েছিলেন প্রকাণ্ড একটা ছবি। সেই ছবিতে এক পুরুষ, তার হাতে খোলা তরবারি, ‘সে এগিয়ে চলেছে নির্ভয়ে সত্যের সন্ধানে। প্রকৃত সত্য অনাবৃত, উন্মুক্ত বলে’ তরবারিটিও খোলা। পুরুষের আগে আগে চলেছে নারী— বাঁশী হাতে, কল্পনা ও প্রেরণা জোগাতে। নারীহস্তের এই মোহিনী বাঁশীই যুগ যুগ ধরে সত্যের সন্ধানরত পুরুষকে দিয়ে আসছে উৎসাহ, প্রেরণা ও কল্পনা। এই দুটি মূর্তির পিছনে পড়ে আছে পদচিহ্ন, যা অনুসরণ করে সত্যের সন্ধানে এগিয়ে চলবে পরবর্তী যুগের মানুষেরা।’ (আচার্য জগদীশচন্দ্র ও বসু বিজ্ঞান মন্দির, অবনীনাথ চক্রবর্তী, ৩৩ পৃ)
জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে নন্দলাল বসু বা অন্যান্য শিল্পীদের পারস্পরিক সম্পর্কের খতিয়ান বা নানা সময়ে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে আরও আলোচনা আগামী পর্বে।
………………………………