জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (সপ্তম পর্ব)
পর্ব ৬v: দেশীয় শিল্পকলা ও জগদীশচন্দ্র (নন্দলাল ও অন্যান্য)
...........................
শুধু বসু বিজ্ঞান মন্দির নয়, এই প্রতিষ্ঠানের লাগোয়া জগদীশচন্দ্রের বাসগৃহ আচার্য ভবনের জন্যও নন্দলাল বসু বেশ কিছু অন্দরসজ্জার কাজ করেছিলেন। যদিও এই বাড়িটি নির্মিত হয় শতকের একেবারের শুরুর দিকে, তখনও নন্দলাল ছবি আঁকা শেখাই শুরু করেননি।
এরপর এল আর্ট স্কুলে শিক্ষালাভ পর্ব, তারপর এল অবন ঠাকুরের কাছে থেকে শিল্পচর্চা করবার ছোট একটা অধ্যায়। ওই সময়ে তাঁর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে ভগিনী নিবেদিতা-সহ আরও অনেক গুণী মানুষের, যাঁদের মধ্যে অন্যতম স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। যদিও তাঁদের আলাপ হয়েছিল ওই অজন্তা-সফর পর্বেই, ১৯০৯ সালে। সে-বছর রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি প্রকাশিতব্য নির্বাচিত কবিতার সংকলন ‘চয়নিকা’-র জন্য কয়েকটি ছবি আঁকবার বরাত দেন তখনও পর্যন্ত প্রায় অপরিচিত শিল্পী নন্দলালকে। সেই বইয়ের কবিতাগুলো স্বয়ং কবির মুখ থেকে প্রথমবার শোনবার সৌভাগ্য হয় তাঁর, এবং পরে ওই বইয়ের জন্য সাতাশ বছরের যুবক নন্দলাল সাতটি ছবি এঁকেছিলেন বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ছবিগুলো রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি। যদিও এই ঘটনার বছরখানেক বাদে নন্দলালের আঁকা একটি ছবি ‘দীক্ষা’ দেখেই রবীন্দ্রনাথ আবেগ-তাড়িত হয়ে লিখে ফেলেন বিখ্যাত সেই গান ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা, যেখানে জাগেন একা’। সেই ছবির সঙ্গেই কবিতাটি ছাপা হয় ভারতী পত্রিকায়।
তাঁদের মধ্যে সত্যিকারের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে, যখন শান্তিনিকেতনের কলাভবন দেখতে গিয়েছিলেন নন্দলাল। সেবারে তাঁকে বেশ ঘটা করে সেখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর বছর দুয়েক পর ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ দিন কয়েকের জন্য শিলাইদহ যান এবং সে-বারে সঙ্গে নেন তিন তরুণ শিল্পী নন্দলাল, সুরেন কর আর মুকুল দে-কে। ওই সফরেই নন্দলালের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে বাংলার গ্রামীণ জীবনের চিত্র দেখবার সৌভাগ্য হয়। সেই সঙ্গে মানুষ রবীন্দ্রনাথকেও এতটা কাছ থেকে একটানা কয়েক দিন দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য।
ছবি : বসু বিজ্ঞান মন্দিরের লেকচার হলের ভেতরের ছাদের ডিজাইন, নন্দলাল বসুর কীর্তি
ওই ১৯১৬ সালেই, শিলাইদহ থেকে ফিরে আসবার পর জোড়াসাঁকোয় শুরু হয় ‘বিচিত্রা’ ক্লাব। সে এক সমবায় পদ্ধতিতে আঁকাজোখার মাধ্যমে পেট চালানোর পরিকল্পনা। নন্দলালদের এই পরিকল্পনায় অবন ঠাকুর সায় দিলেন, তাঁদের বাড়ির কয়েকটা ঘরেই সকলের থাকবার ব্যবস্থা হল, সেই সঙ্গে মাসিক কিছু টাকা ধার্য হল বৃত্তি হিসেবে। বিচিত্রা ক্লাবে এসে যোগ দিলেন অসিত হালদার বা মুকুল দে-রাও। ‘বিচিত্রা’ নামটি রবীন্দ্রনাথরই দেওয়া, এর পুরো নাম ‘দ্য বিচিত্রা স্টুডিও ফর আরটিস্টস অভ দ্য নিয়ো বেঙ্গল স্কুল’। বেশ গালভরা নাম, সন্দেহ নেই। এই সংস্থায় এরপর যোগ দিলেন অবন ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, হাইকোর্টের জজ জন উড্রোফ্, এবং আরও বেশ কয়েকজন সমাজের গণ্যমান্য মানুষেরা।
এই ক্লাবে দিনের বেলায় চলত আঁকা শেখবার ক্লাস, আসতেন ঠাকুরবাড়ির অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা, এমনকি বউরাও। রবীন্দ্রনাথের বউমা প্রতিমা দেবীও আসতেন আঁকা শিখতে, প্রত্যেকেরই তখন উৎসাহের অন্ত ছিল না। আঁকার পাশাপাশি আড্ডা, সাহিত্য পাঠ, গানবাজনা এসবও চলত। বাইরে থেকে আসতেন পরিচিত গুণী ব্যক্তিরা— সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, এবং কখনও আসতেন জগদীশচন্দ্র বসুও।
কিন্তু মাত্র দেড় বছরেরই এই হাসিঠাট্টার পালাগান সাঙ্গ হল, ভেঙে গেল বিচিত্রা। আর সেই সময়েই একদিন জগদীশচন্দ্র এসে নন্দলালের কাছে তাঁর বাড়ি আর বিজ্ঞান মন্দিরের জন্য কাজের বরাত দিলেন।
২. জগদীশচন্দ্র এবং তাঁর আত্মীয় অবনীনাথ মিত্রের সঙ্গে অনেক আলোচনা করে স্থির হয় যে দেওয়ালে যে ফ্রেস্কো আঁকা হবে, সেগুলোর থিম হবে মহাভারত। সেইমতো বৈঠকখানা ঘরের ওপরের দিকে কয়েকটা প্যানেলে ফুটিয়ে তোলা হল পাণ্ডব-কৌরবদের পাশাখেলা, দুর্যোধনের যুদ্ধ-দৃশ্য, যুধিষ্ঠিরের স্বর্গে যাওয়া, রইল সেই কুকুররূপী ধর্মও।
সেই সঙ্গে দু-পাশে রইল যুদ্ধ-শেষের রিক্ত দৃশ্য— ‘জনশূন্য প্রকাণ্ড মাঠ। মাঝে মাঝে চিতা জ্বলছে; কৃপাচার্যেরা সবাই পালাচ্ছেন; মাঝে যুধিষ্ঠির—’ (পঞ্চানন মণ্ডল লিখিত নন্দলাল জীবনী-১ম খণ্ড, ৩৮২ পৃ) সেই সঙ্গে রইল অজন্তার প্যানেলও।
অন্যদিকে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের যে লেকচার হল, সেখানে নন্দলাল বানালেন সৌরজগতের উদয়-সবিতা— রথে চেপে আসা সূর্যের আবির্ভাবে অন্ধকারের হঠে যাওয়ার দৃশ্য। সেই দৃশ্যের ডিজাইন ছিল নন্দলালের, আর চিৎপুর থেকে আসা এক অভিজ্ঞ কারিগর সেই ডিজাইন দেখে খোদাই করে দিয়েছিলেন।
এছাড়া নন্দলালের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় এই বিজ্ঞান মন্দিরেই ভগিনী নিবেদিতার একটি রিলিফ-মূর্তি আছে, যেটা তৈরি হয়েছিল নন্দলাল বসুর ডিজাইন থেকেই। সেই কাজ শেষ করতে নাকি তাঁর ছ-মাসের বেশি সময় লেগেছিল।
ছবি : বিজ্ঞান মন্দিরে নিবেদিতার চিত্র
সব মিলিয়ে এই দুটো জায়গায় যাবতীয় কাজের জন্য নন্দলাল দক্ষিণা হিসেবে পেয়েছিলেন সাড়ে তেরশো একত্রিশ টাকা। আর সুরেন কর পেয়েছিলেন ৬৩১ টাকা। সে-আমলের পক্ষে এই টাকাটা কয়েক লক্ষ টাকার সমান।
জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে সব মিলিয়ে কোথায় কী বানিয়েছিলেন নন্দলাল আর তাঁর সহকারী শিল্পীরা, সে বিবরণ আছে পঞ্চানন মণ্ডলের ‘ভারতশিল্পী নন্দলাল’ বইয়ের ১ম খণ্ডের ৩৮৬ পাতায়।
এই ঘটনার বছর দুয়েক বাদেই নন্দলাল গুরুদেবের ডাকে চলে যান শান্তিনিকেতনে, সেখানকার কলাভবনেই এরপর তিনি কাটাবেন জীবনের আঠাশ বছর, যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে পাবেন আরও আঠেরো বছর।
মুকুল দে-র স্মৃতিচারণ
১৯১৭ সাল, সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ। জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা তখনও চলছে। সেই ক্লাবের জন্য নির্ধারিত ভবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বক্তৃতা দিলেন গানের ওপর। সে প্রসঙ্গে শিল্পী মুকুল দে-র (১৮৯৫ - ১৯৮৯) স্মৃতিচারণ:‘আজ গুরুদেব গানের উপরে এক বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার মাঝে মাঝে অনেক গান গেয়ে বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন। বক্তৃতার শেষে জগদীশবাবুর সঙ্গে দেখা হল। অনেক কথাবার্ত্তার পর বল্লেন, ‘দেখ, তোমাকে frankly একটা কথা বলি— তুমি যে shantiniketan বই-এর ছবি এঁকেছ ওগুলো খুব ভাল হয়েছে, তবে একটা [ব্যাপার] আমার পছন্দ হয়নি। সেটা এই যে— তুমি ওই ছেলেগুলোকে কালো করেছ। ওতে ও দেশের লোকেরা বড় ঘৃণা করে— কালো দেখেই ওদের একেবারে সব ভাব বদলে যায়— একে ছোট কাপড় পরা তায় আবার কালো— এটা ওদের সামনে দেখান ঠিক নয়। ড. উইল লিখেছিলেন— আমাদের যেমন একরকম সেদ্ধ করা গায়ের রং— এটা একেবারেই ভাল নয়। আর আমাদের রং রোদে পোড়া— বেশ brown রং। আমরা তো নিগার নই। কালো রং-এর লোক দেখলেই ওরা নিগার বলবে। এটা ওদের সামনে দেখান মোটেই ঠিক নয়।” জগদীশবাবু বল্লেন, “আমাদের রং খুব ভাল রং। আসল টাট্কা রং— কোন গাছকে রোদের থেকে ঢেকে রাখলে যেমন একটা ফ্যাকাশে রং হয়ে যায়— তেমনি রং ওদের— কিন্তু আমাদের রং একেবারে natural রং। এ রং ওরা পাবে কোথায়? জগদীশ বাবুর সঙ্গে মঙ্গলবার সকাল ৯টার সময় দেখা করতে বল্লেন। আরও সকলের সঙ্গে দেখা হল। কালও সকালে Sketch করতে যেতে হবে। ক্রমশঃ আমাকে সফল দলের সঙ্গে ভিড়ে পড়তে হবে।’ (* জাপান থেকে জোড়াসাঁকো, মুকুল দে, নিউ এজ সংস্করণ, ১০৩ পৃ) এই লেখায় উল্লিখিত ‘শান্তিনিকেতন’ বইটি (পুরো নাম ‘Shantiniketan: The Bolpur School of Rabindranath Tagore’) প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। এই বইয়ের লেখক ছিলেন উইলিয়াম পিয়ারসন, এবং বইয়ের ছবিগুলো এঁকেছিলেন মুকুলবাবু।
এবং স্মৃতিচারণের শেষ দিকে তিনি যে ‘কালও সকালে sketch করতে যেতে হবে’ বলছেন, এটা বিশিষ্ট বারো জন বাঙালির পোর্ট্রেট অঙ্কন সংক্রান্ত। সেই বারোটি ছবি নিয়ে ‘Twelve Portraits’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্যার জন উড্রফ্, এবং এই বইয়ে ব্যবহৃত জগদীশচন্দ্রের ছবিটা ছিল এইরকম:
এবং এই বইটির প্রচ্ছদ ছিল এইরকম:
(এই কপিটি স্বয়ং মুকুল দে-র নিজস্ব সংগ্রহের বই। শান্তিনিকেতন-বাসী সত্যশ্রী উকিল-মহাশয়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত)
বাঙালি শিল্পচর্চার ওই সোনালি যুগে এই বাংলার খ্যাতনামা গুণী শিল্পীদের আরও অনেকেরই সঙ্গে যোগাযোগ ছিল জগদীশচন্দ্রের। আগামী পর্বে আমরা বলব তেমনই আরও দু/তিনজন শিল্পীর কথা।
…………………
(বসু বিজ্ঞান মন্দির ও আচার্য ভবন কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি)