জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (চতুর্থ পর্ব)
পর্ব ৪ : যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ও জগদীশচন্দ্র
..................
হুগলি জেলার দিঘরা গ্রামের হারাধন রায় বয়সে জগদীশচন্দ্রর চেয়ে বছরখানেকের ছোট হলেও তুলনায় অনেক বেশি দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন তিনি, বেঁচে ছিলেন প্রায় সাতানব্বই বছর। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে পড়বার সময় নিজের নাম পাল্টে তিনি নিজেই বেছে নিলেন নতুন নাম— যোগেশচন্দ্র। প্রচণ্ড মেধা আর জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানের স্বীকৃতি হিসেবে ওড়িশার পণ্ডিতমহল থেকে পরে পাবেন ‘বিদ্যানিধি’ উপাধি, আর এই সবটা মিলিয়েই যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬ খ্রি) হয়ে উঠবেন উনিশ-বিশ শতকের উজ্জ্বল এক বাঙালি চরিত্র। আর তাঁর জ্ঞানের পরিধি বুঝে ওঠাও বেশ কঠিন কাজ, তিনি একাধারে ‘উদ্ভিদবিদ, রসায়নবিদ, সরকারী কলেজের (মূলত কটকের র্যাভেন্শ কলেজের) বিজ্ঞানশিক্ষক, বাংলায় বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক লেখক, পুরাতত্ত্ববিদ, প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস রচয়িতা, বাংলার ধর্মীয় ইতিহাস-রচয়িতা এবং বাংলা ভাষার প্রথম বিজ্ঞানসম্মত অভিধান-প্রণেতা, যাঁর কাছে ঋণী ছিলেন স্বয়ং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ (বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা ও যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, আশীষ লাহিড়ী, অন্য স্বর অনলাইন পত্রিকা। লিঙ্ক: https://othervoice.in/article/ov-07-12-2020-5)
বাঁকুড়ার জেলা স্কুল থেকে পড়াশুনো করে পরে বর্ধমান রাজ স্কুলে ভরতি হয়ে সেখান থেকে ১৮৭৭ সালে ইনি পাশ করলেন এন্ট্রান্স পরীক্ষা, বৃত্তিসহ। এর কিছু আগেই তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছে নারায়ণী দেবীর সঙ্গে। এন্ট্রান্স পাশ করে ভরতি হলেন হুগলি কলেজে। ১৯৩৬ সালে স্থাপিত এই কলেজটিতে সে সময় পাঠ্যবিষয় হিসেবে ছিল জ্যামিতি, রসায়ন, ইতিহাস ইত্যাদি। প্রেসিডেন্সির মতো তখনও এখানে বিএ কোর্সে আলাদাভাবে বিজ্ঞান আর কলা বিভাগ ছিল না, ছিল একটাই বিভাগ, বিজ্ঞান। এরই মধ্যে পড়া যেত ইংরেজি বা ভূগোলের মতো কলা বিভাগের বিষয়ও। কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর তাঁর এক বছরের সিনিয়র ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। এখানে শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন রেভারেণ্ড লালবিহারী দে-কে, যিনি ‘Folk Tales of Bengal’ লিখে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বিএ পাশ করবার পরে ১৮৮৩ সালে তিনি হুগলি কলেজ থেকেই এমএ পাশ করেন উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে। পাশাপাশি পড়লেন আইনও। আর তারপর কটকের সদ্যস্থাপিত রেভেনশা কলেজ থেকে পেলেন বিজ্ঞানের লেকচারার হওয়ার নিয়োগপত্র। ১৮৮৩ সালে সেখানে যোগ দিলেন চব্বিশ বছরের তরুণ যোগেশচন্দ্র, মাইনে মাসিক একশো টাকা। খেয়াল রাখা দরকার, তাঁর চেয়ে এক বছরের বড় জগদীশচন্দ্র তখনও বিদেশ থেকে পড়াশুনো শেষ করে দেশে ফেরেননি।
কটকে তিন বছর কাটিয়ে ১৮৮৬ সালে তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়, এবার বিজ্ঞান বিভাগের স্থায়ী লেকচারার হিসেবে যোগ দিলেন ওয়েলেসলি স্ট্রিটের কলকাতা মাদ্রাসা কলেজে। ইতিমধ্যে কটকে থাকবার সময় তিনি লেখালিখিও শুরু করেছেন, কলকাতার ‘বিজ্ঞানদর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সেই লেখা ‘পাথুরিয়া কয়লা’ (আশ্বিন ১২৮৯ সংখ্যায়)। আর কলকাতায় বসবাস করা শুরুর কয়েক মাস পরে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম বই ‘সরল পদার্থ বিজ্ঞান’। এবং পরের বছর লিখলেন ‘সরল প্রাকৃত ভূগোল’। এই বইদুটি লেখবার কাজে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সুহৃদ রজনীকান্ত গুপ্ত-র কাছ থেকে, যিনি ‘সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস’ লিখে খ্যাতিবান হয়েছেন।
‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় তাঁর বই সম্বন্ধে একটি লেখায় বলা হয় যে: ‘যোগেশবাবু বাঙ্গালা পাঠ্যপুস্তক রচনায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছেন।’ (অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র জীবনী, সাহিত্য অ্যাকাডেমি, ২২ পৃ) আসলে কটকে অধ্যাপনা করার সময় যোগেশচন্দ্র অনুভব করতেন যে হাতেকলমে ছেলেদের বিজ্ঞানের অন্তর্গত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা না দেখালেই নয়। কিন্তু সেখানে ছিল না ওরকম কোনো পরিকাঠামো। যোগেশচন্দ্র প্রায় একা হাতেই নিজের যতটুকু সামর্থ্য তা দিয়েই কলেজের মধ্যে গড়ে তোলেন বিজ্ঞানের কিছু পরীক্ষা করে দেখানোর মতো যন্ত্রপাতি। কিন্তু এখানে আরও কিছু করে ওঠবার আগেই তাঁর কাছে ডাক এসে যায় কলকাতা থেকে।
১৮৮৮ সালের আগস্ট মাসে মাদ্রাসা কলেজে অধ্যাপনা-করাকালীন কিছুদিনের জন্য তাঁকে পাঠানো হয় পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ১৮৮৮ সালের শেষ দিকে কলকাতায় যখন ফিরলেন, হাতে পেলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরির চিঠি। মাদ্রাসা কলেজ থেকে তাঁকে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারণ ওই সময় কলকাতা মাদ্রাসার ক্লাসগুলো যুক্ত হয়ে গিয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে। পরে অবস্থার ফেরে তাঁকে চলে আসতে হয় সেই প্রেসিডেন্সিতেই। আলফ্রেড ক্রফট সাহেবের কাছ থেকে মৌখিক সম্মতি এসে গেল ১৮৮৮-র অক্টোবরে, এবং লিখিত নির্দেশ পেয়ে গেলেন পরের মাসেই। পদ হল জগদীশচন্দ্রের গবেষণা সহায়ক বা অস্থায়ী ‘ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট অব জেসি বোস’। মাইনে নির্ধারিত হল মাসে দেড়শো টাকা।
প্রেসিডেন্সি কলেজে এসে যোগেশচন্দ্রের খুবই সুবিধে হল। আত্মচরিত-এ লেখেন: ‘ভূত বিদ্যা আমার পড়া ছিল, কিন্তু উচ্চাঙ্গের যন্ত্র পাইনি, ক্রিয়া দেখতে পাইনি। এখানে লাইব্রেরিতে বই, ক্রিয়াশালায় যন্ত্র পেয়ে আনন্দ হল। ১০টা হতে ৫টা, কোনোদিন পাঁচ মিনিট বসিনি।’ (আত্মচরিত, যোগেশচন্দ্র, সাহিত্য সংসদ সংস্করণ)
প্রেসিডেন্সি নিয়ে তাঁর আরও স্মৃতিচারণ দেখতে পাই এই বইয়ে, যেখানে রয়েছে জগদীশ-প্রসঙ্গ: ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকবার ডানদিকের একতলা প্রোফেসর জে সি বোসের লেবরেটরি বা ক্রিয়াশালা। তিনি কলেজে বোস সাহেব নামেই পরিচিত ছিলেন, যদিও সাহেবী পোশাক পরতেন না।’
জগদীশচন্দ্রেরই গবেষণাগারে গবেষণা করতেন যোগেশচন্দ্র। তাঁর লেখা থেকে এই ল্যাবরেটরির চমৎকার এক বিবরণ পাওয়া যায়।
এরপরে যোগেশচন্দ্রের মনে ইচ্ছে জাগল, ফটোগ্রাফি শিখবেন। এখানেও তিনি পাশে পেলেন জগদীশচন্দ্রকে। ‘বোস সাহেব তখন ফটো ভাল তুলতে পারতেন। তাঁর দুটা কেমেরা ছিল, একটা হাফ প্লেট আর একটা ফুল প্লেট, বেশী দামের। তখনকার দিনে ছোটটার দাম প্রায় ৮০ টাকা। বলবামাত্র সেটা তিনি আমাকে দিলেন।’
কলকাতায় আসবার পর যোগেশচন্দ্রের আরও যে সুবিধেটি হয়েছিল, তা হল তাঁর লেখালিখি। আর পরিভাষা নির্মাণে মন দেওয়া। বাংলায় বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালিখি করতে গেলে যে সমস্যাটা তখন সবচেয়ে বেশি নজরে আসত, তা এই পরিভাষার অপ্রতুলতাই।
লেখালিখিতে মন দিতে পারার এক ফল তো প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই, ‘সরল পদার্থ বিজ্ঞান’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। বইটি যে পাঠকের মনে ধরেছিল, তার প্রমাণ দশ বছরে এর দশটি সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া। পাশাপাশি বইটি পূর্ববঙ্গে পাঠ্যবই হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছিল। এছাড়া ডাক্তারির ছাত্রদের জন্য তিনি একটি পাঠ্যপুস্তকও লিখেছিলেন, যেটা ক্লাসে পড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ১৯০৪ সালে তাঁর আরও একটি মহাগ্রন্থ ‘আমাদের জ্যোতিষী ও আমাদের জ্যোতিষ’ প্রকাশিত হয়। এই বইও মুগ্ধ করেছিল তাঁর ‘বস’ জগদীশচন্দ্রকে।
শুধু কি পাঠ্যপুস্তক? যোগেশচন্দ্র তাঁর দীর্ঘ জীবনে কত ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তার ফিরিস্তি দেখলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এর জন্মলগ্ন থেকেই। এই পরিষদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকাকালীন সময়েই প্রকাশ পায় তাঁর পরিভাষা সংক্রান্ত কাজ, প্রচুর প্রবন্ধ এবং একাধিক বই প্রকাশ পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। পরে লেখেন শব্দকোষ জাতীয় বই, বানান সংস্কার নিয়ে একাধিক লেখা, প্রাচীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সাহিত্যের অনুসন্ধানমূলক কাজ, আর এসবের পাশাপাশি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের মতো বিভিন্ন সভাসমিতিতে যোগ দেওয়া বা সভাপতিত্বের দায়ভার সামলানোর মতো কাজও তো ছিলই।
ছবি। যোগেশচন্দ্র
...............
যোগেশচন্দ্রের কলকাতাবাস যদিও বেশি স্থায়ী হয়নি; ১৮৮৯ সালের জুন মাসেই, মানে প্রেসিডেন্সিতে মাত্র সাত-আট মাস কাটাবার পরেই ফটো তোলা নিয়ে একটি ঘটনায় উচ্চতর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বার জন্য যোগেশচন্দ্রকে আবার বদলি হয়ে যেতে হল। এবার তিনি যাত্রা করলেন কটকের উদ্দেশ্যে, আবার সেই র্যাভেনশ কলেজেই। তবে এবারে আর অস্থায়ী নয়, তিনি পেলেন স্থায়ী অধ্যাপকের পদ। যোগেশচন্দ্র সেই যে কলকাতা ছাড়লেন ১৮৮৯ সালের জুন মাসে, এরপর কটকেই কাটবে তাঁর জীবনের তিরিশটি বছর।
পরবর্তী জীবনে যোগেশচন্দ্র
যোগেশচন্দ্র র্যাভেনশ কলেজ থেকে অবসর নেন ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে, ষাট বছর বয়সে। তখন তিনি ওড়িশার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। ওড়িশার উন্নতির জন্য একাধিক কর্মসূচিতে যুক্ত থেকেছেন, লিখেছেন ওড়িয়া ভাষায় বইও। অবসরের পর ফিরে আসেন বাঁকুড়ায়, পরে সপরিবারে এখানেই বাসা বানিয়ে থাকা শুরু করেন। ১৯২৩ সালে শেষ হওয়া সেই বাড়ির নাম রাখেন ‘স্বস্তিক’। এখানে আসবার পরেও তাঁর সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালিখি, প্রাচীন ভারতের জীবনযাপন আর সমাজব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে প্রাচীন ঘটনা বা চরিত্রের কালানুসন্ধানে লিপ্ত হন, লেখালিখি করেন কৃষ্ণ বা যুধিষ্ঠিরের প্রকৃত জন্ম-সাল কী হতে পারে তা নিয়ে। আরও কয়েক বছর পর লেখেন আত্মজীবনী, ‘আত্মচরিত’। সেই বই অবশ্য নানা কারণে প্রকাশ পায় অনেক পরে ২০০২ সালে। যদিও এই আত্মজীবনী অসমাপ্ত, মাত্র ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনের ঘটনা তিনি এতে লিখে যেতে পেরেছিলেন। সম্প্রতি এই আত্মজীবনীর একটি চমৎকার সটীক সংস্করণ (টীকা-নির্মাণে আশীষ লাহিড়ী) প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য পরিষদ থেকে।
জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলে, ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন সাম্মানিক ডি লিট উপাধি। এর কয়েক বছর আগে পেয়েছিলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। দীর্ঘ নীরোগ জীবন কাটিয়ে অবশেষে ছিয়ানব্বই বছর বয়সে মৃত্যু হয় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বহুবিদ্যাবিশারদদের যে ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করে প্রায় সমবয়স্ক জগদীশ-প্রফুল্ল বা প্রমথনাথ বসুর হাত ধরে, যোগেশচন্দ্র ছিলেন সেই ধারারই শেষ জীবিত প্রতিনিধি। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে এই যুগের আক্ষরিক অর্থেই সমাপ্তি ঘটে।
........................
#Jagadish Chandra Bose #JC Bose #science #series