জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (একাদশ পর্ব)
...............
পর্ব ১১। রবীন্দ্রনাথ-নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্র: মেলামেশা পর্বের শেষ প্রান্তে
পূর্ববঙ্গের যে বিস্তীর্ণ এলাকায় একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেখানে একাধিকবার ছুটি কাটিয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু জগদীশচন্দ্র। এখানে আসবার জন্য নিবেদিতার কাছে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ এসেছিল ১৮৯৯-এর জুন মাসের আগেই। নদীকেন্দ্রিক এই গ্রামীণ জনপদে যাওয়ার জন্য নিজে প্রবলভাবেই আগ্রহী ছিলেন নিবেদিতাও। তিনি স্থির করেছিলেন, স্বামীজী বিদেশে চলে গেলে তিনি রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আসবেন। কিন্তু আকস্মিকভাবেই ওই সময় স্বামীজীর সঙ্গে তাঁরও বিদেশযাত্রা স্থির হয়ে যাওয়ায় পূর্ববঙ্গে যাওয়া বাতিল করতে হয় নিবেদিতাকে। তিনি সেই মর্মে যেতে না পারবার বেদনা-ভরা একটি চিঠিও লেখেন রবীন্দ্রনাথকে।
প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা তাঁর নিবেদিতা-জীবনীতে লিখছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ তখন অধিকাংশ সময় শিলাইদহে অবস্থান করিতেন। নিবেদিতা কয়েকবার সেখানে গিয়েছিলেন।’ কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে যে নিবেদিতা কয়েকবার না, গিয়েছিলেন একবারই। সেটা ওই ১৯০৪-এর ডিসেম্বরে।
শিলাইদহে যাওয়ার সুযোগ অবশেষে এল ১৯০৪-এর ডিসেম্বর মাসের শেষে। তখন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্রও ছিলেন সেখানে। নিবেদিতা সিস্টার ক্রিস্টিনকে সঙ্গে নিয়ে শিলাইদহ যাত্রা করেন ডিসেম্বরের তিরিশ তারিখে, ফিরে আসেন জানুয়ারির দুই তারিখে। তিন দিনের সফর শেষে কলকাতায় একসঙ্গে ফেরেন সবাই; সস্ত্রীক রবীন্দ্রনাথ এবং জগদীশচন্দ্র— সকলেই।
শিলাইদহে নিবেদিতা এবং সিস্টার ক্রিস্টিন ছিলেন পদ্মা বোটের সঙ্গেই লাগোয়া ‘নাগর’ নামে আর একটি ছোট বোটে। দিনের বেলা তাঁরা গ্রাম-দেশ ঘুরে-ঘুরে দেখে বেড়াতেন সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনযাত্রার এক-এক খণ্ডচিত্র, আর সন্ধের পর ‘পদ্মা’য় বসত আড্ডা; সেই আড্ডায় নিশ্চিতভাবেই বলা চলে উপস্থিত থাকতেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র।
কাছারির এক আমলা দক্ষিণারঞ্জন চৌধুরীকে ডেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওপর দায়িত্ব দিলেন এই দুই বিদেশিনী অতিথিকে গ্রাম-এলাকা ঘুরে দেখানোর। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পেশার মানুষজন কীভাবে তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করে, ঘুরে ঘুরে দেখাতে বলে দিলেন তা-ও। দক্ষিণারঞ্জনবাবুর সঙ্গে মিলেই এরপর দু-দিন ধরে তাঁরা ঘুরে-ঘুরে দেখলেন এক প্রাচীন বটগাছ, মুসলিম তাঁতিদের পাড়া, তাঁদের কাজকর্ম; দেখলেন মেয়েদের ধান ভানা বা চিঁড়ে তৈরির খুঁটিনাটি বা পুরনো আমলের মন্দিরও। গ্রামের লোকেরাও অপার বিস্ময়ে দেখলেন, এই দুই ফর্সা রমণী কত আগ্রহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁদের চারপাশে। তাঁরাও এঁদেরকে দুধ, আখের গুড় বা খেজুরের রস খাইয়ে আপ্যায়ন জানাতে ভোলেননি।
সান্ধ্য আড্ডায় এক-একদিন গান শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ। বিভোর হয়ে শুনতেন নিবেদিতা। কিন্তু ওই আড্ডাতেই একদিন ঘটে গেল এমন কিছু ঘটনা, যা নিবেদিতার অন্তঃকরণকে ভরে তুলল এক তিক্ত স্বাদে; তার রেশ রয়ে গেল দুই মহামানবেরই অন্তরমহলে। রবীন্দ্রনাথ আর নিবেদিতা— এই দুজনের মধ্যে এরপরে দেখাসাক্ষাৎ হবে, চলবে পরস্পরের বাড়ি যাতায়াতও, কিন্তু আগেকার সেই সৌহার্দ্য এরপরে যেন গেল উধাও হয়ে।
দেবাঞ্জন সেনগুপ্তর কথা ধার করে আমরাও বলতে পারি, ওই সময়ে নিবেদিতার মনের মধ্যে নিশ্চয়ই জেগে উঠেছিল তাঁর গুরুর এক সতর্কবাণী: ‘পূর্বে তোমার ছিল ব্রাহ্মদের প্রতি প্রত্যয়, টেগোরের প্রতি প্রত্যয়, আর এখন এসব (ওকাকুরা-সংক্রান্ত) প্রত্যয়। এটিও যাবে, যেমন অন্যগুলো গেছে।’ (নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ, গাংচিল, ১১৭ পৃ)
২.
শিলাইদহে থাকবার সময়েই রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে শোনান ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রাথমিক সারগল্পটি। উইলিয়াম পিয়ারসন-কে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘She (Nivedita) was our guest in Shilaidaha and in trying to tell her a story as per her request, I gave her something which came very near to the plot of Gora’। যদিও নিবেদিতা গোরা উপন্যাসের শেষটা রবীন্দ্রনাথ যেমনভাবে করতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সেখানে গোরা আর সুচরিতার প্রেম পূর্ণতা পায়নি। বলতে গেলে নিবেদিতার আপত্তিই শেষটা পাল্টে দেন কবি।
নিবেদিতার অসুস্থতা ও বসু দম্পতির সেবাদান
১৯০৫ সালটা শুরু হল এক দুঃখজনক ঘটনা দিয়ে। জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮৮ বছর বয়সে দেহত্যাগ করলেন। নিমতলা শ্মশানঘাটে তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষ। ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুরাও, যাঁদের মধ্যে জগদীশচন্দ্র বসু, মহিমচন্দ্র দেববর্মা, মোহিতচন্দ্র সেন প্রমুখ।
এরপরে এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে বেলুড় মঠে স্বামীজীর জন্মোৎসবে যোগ দেন দুই বন্ধু জগদীশচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ। এর আগের দিন রবীন্দ্রনাথ বাগবাজার আর পার্শীবাগান গিয়েছিলেন, রবিজীবনী-লেখক প্রশান্তকুমার পাল অনুমান করেছেন জগদীশচন্দ্র আর নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করতেই এই দুই জায়গায় যাওয়া ও তাঁদের অনুরোধেই সম্ভবত তিনি বেলুড় যেতে রাজি হন (রবিজীবনী, ৫ম খণ্ড, ২১৮ পৃ)।
২.
১৯০৫-এর ১৩ই মার্চ (লিজেল রেমঁ তাঁর নিবেদিতা-জীবনীতে বলেছেন এপ্রিল মাসে) নিবেদিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁকে প্রায় এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়। কলকাতার গরমের কারণে টাইফাস, সঙ্গে ব্রেন ফিভার দেখা দেয়। এমনিতে তিনি শীতের দেশের মানুষ, এ দেশের গরম কেন সইবে? ডাক্তার নীলরতন সরকারের পরামর্শে দু’জন নার্সও রাখা হয়। তিনি নিজেও মাঝেমধ্যেই এসে দেখে যেতেন। বাগবাজারের বাড়িতে নানারকম অসুবিধা, সে জন্য তাঁকে অনেক বুঝিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে। এখানে থাকায় সুবিধেই হল, বসু-দম্পতি নিয়মিত আসতে পারেন এবং দেখাশুনোও করতে পারেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন আরও অনেকেই, নিবেদিতার শুভার্থী বা প্রিয়জন তো বড় কম নয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে তখন কলকাতাতেই ছিলেন, তিনি দিনের পর দিন এসে নিবেদিতার পাশে বসে মাথায় আইসব্যাগ ধরে রাখতেন। তার উদ্যোগে চাঁদা তুলে একটি তহবিলও গঠন করা হল, নিবেদিতার চিকিৎসায় যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেদিকেই সবার নজর। নীলরতন সরকার জানালেন, এই অসুখ থেকে সেরে ওঠার একমাত্র উপায়, পরিপূর্ণ বিশ্রাম। তাঁরই পরামর্শে একটু সেরে উঠবার পর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিবেদিতা আর সিস্টার ক্রিস্টিন দার্জিলিং যাত্রা করেন। তখন গরমের ছুটি পড়েছে, তাই সঙ্গী হিসেবে পেলেন জগদীশ-অবলাকেও। দার্জিলিং-এ তাঁরা উঠলেন Assyline Villa-য়। জুলাই মাসের ৩ তারিখ নিবেদিতা ফিরে আসেন, তবে বসু দম্পতি সেখানে রয়ে গিয়েছিলেন আরও কয়েকদিন।
এইসময় জগদীশচন্দ্র লিখছিলেন ‘প্ল্যান্টস রেসপন্স অ্যাজ আ মিনস অফ ফিজিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন’ বইটি। প্রথম একত্রিশটি অধ্যায় তখন লেখা হয়েছে। নিবেদিতা মনেপ্রাণে চাইছিলেন লেখাগুলির প্রুফ দেখে দিতে, কিন্তু শরীর মোটেই সাহায্য করছিল না। অবশ্য দার্জিলিং-এর আবহাওয়া আর বসু দম্পতির সেবা ও সঙ্গদানে নিবেদিতা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন।
অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা ও নিবেদিতা
এরপর এসে গেল বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার যুগ। বাংলাকে ভাগ করবার এই ব্রিটিশ-প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন আর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল বাংলা। বিশেষ করে কলকাতায় ঝড়টা উঠল বেশি, কারণ কলকাতা তখন বাংলা-বিহার প্রদেশের রাজধানী। এই বঙ্গভঙ্গের সময়কার বয়কট আন্দোলনের পাশাপাশি আর একটি প্রধান ঘটনা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’।
এই ছবিটির প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল বঙ্গমাতা। নিবেদিতাই অবনীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন নাম পাল্টে ‘ভারতমাতা’ করবার জন্য। ছবিটিতে জলরঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এক শান্ত অভয়দাত্রী মাতৃমূর্তিকে। তাঁর চারটি হাতে ধরে আছেন পুঁথি বা বই, একটি ধানের ছড়া, বস্ত্রখণ্ড আর রুদ্রাক্ষের জপমালা; যেগুলো যথাক্রমে শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র আর দীক্ষাকে নির্দেশ করছে।
এই একই ছবি অবনীন্দ্রনাথ আরও একটি কপি এঁকেছিলেন জগদীশচন্দ্রের বাড়ির বৈঠকখানায় টাঙানোর জন্য। এখনও সেখানে এটি সযত্নে রক্ষিত আছে। আরও একটি কপি আঁকা হয়েছিল একটি পতাকার গায়ে।
দেশকে তখন শিল্পীরা কল্পনা করছেন মাতৃপ্রতিমা হিসেবে। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তাঁদের শিল্পকর্মে। আর এটা মোটামুটি এখন সকলেই মেনে নিয়েছেন যে ওই সময়টায় জাপানি শিল্পী কাকুজো ওকাকুরা এ দেশে আসবার পরেই তাঁকে কেন্দ্র করে এক দল বাঙালি শিল্পী উৎসাহ নিয়ে একটি দল গড়ে তোলেন, যে দলের কাজকর্মের পরে নাম হবে ‘বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট’। এই দলে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির একাধিক শিল্পী, আর নিবেদিতাও।
বঙ্গভঙ্গের ওই সময়কালে নিবেদিতার বাহ্যিক চেহারা কেমন ছিল, সেটার খুব ভালো এক বিবরণ শব্দের তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই অবনীন্দ্রনাথই। তাঁর লেখা থেকে:
‘প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় আমেরিকান কনসলের বাড়িতে। ওকাকুরাকে রিসেপ্শন দিয়েছিল তাতে নিবেদিতাও এসেছিলেন। গলা থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেছে সাদা ঘাগরা, গলায় ছোট্ট ছোট্ট রুদ্রাক্ষের এক ছড়া মালা; ঠিক যেন সাদা পাথরের গড়া তপস্বিনীর মূর্তি একটি। যেমন ওকাকুরা একদিকে, তেমনি নিবেদিতা আর একদিকে। মনে হল দুই কেন্দ্র থেকে দুটি তারা এসে মিলেছে। সে যে কি দেখলুম কি করে বোঝাই।
‘আর একবার দেখেছিলুম তাঁকে। আর্ট সোসাইটির এক পার্টি, জাস্টিস্ হোমউডের বাড়িতে। আমার উপরে ছিল নিমন্ত্রণ করার ভার। নিবেদিতাকেও পাঠিয়েছিলুম নিমন্ত্রণ-চিঠি একটি। পার্টি শুরু হয়ে গেছে। একটু দেরী করেই এসেছিলেন তিনি। বড় বড় রাজারাজড়া সাহেব-মেম গিসগিস করছে। অভিজাত বংশের বড় ঘরের মেম সব; কত তাদের সাজসজ্জার বাহার, চুল বাঁধবারই কত কায়দা; নামকরা সুন্দরী অনেক সেখানে। তাদের সৌন্দর্যে, ফ্যাশনে চারিদিক ঝলমল করছে। হাসি, গল্প, গানে বাজনায় মাত্। সন্ধ্যে হয়ে এল, এমন সময় নিবেদিতা এলেন। সেই সাদা সাজ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় চুল ঠিক সোনালি নয়, সোনালি রুপোলিতে মেশানো, উঁচু করে বাঁধা। তিনি যখন এসে দাঁড়ালেন সেখানে, কি বলব যেন নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে চন্দ্রোদয় হল। সুন্দরী মেমরা তাঁর কাছে যেন এক নিমেষে প্রভাহীন হয়ে গেল। সাহেবরা কানাকানি করতে লাগলো। উড্রফ, ব্লান্ট এসে বললেন, ‘কে এ?’ তাঁদের সঙ্গে নিবেদিতার আলাপ করিয়ে দিলুম। (জোড়াসাঁকোর ধারে, ১০৮ পৃ)
ঠাকুরবাড়ির গুণী মানুষেরা বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে দেশমাতৃকাকে গান-কবিতা-নাটক বা শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে যেভাবে বন্দনা করেছিলেন, তাকে আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিলেন নিবেদিতা-জগদীশচন্দ্র— দু’জনেই। যদিও জগদীশচন্দ্র নিজেকে কিছুটা নিষ্ক্রিয়ই রেখেছিলেন এই গোটা কর্মকাণ্ড থেকে, তবু তাঁর অন্তরের জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম ফুটে উঠতে দেখি তাঁর লেখা চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে। সে আলোচনা, অন্য পর্বে।
................