নিবন্ধ

জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (ষষ্ঠ পর্ব)

অর্পণ পাল April 19, 2024 at 2:13 am নিবন্ধ

........................

পর্ব ৬। বেলুড়ে নিবেদিতার কর্মকাণ্ড ও বসুদের সঙ্গে মেলামেশা 

কাশী থেকে ফিরে আসবার পর হিন্দু পরিবারের আদবকায়দার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার জন্য স্বামীজীর পরামর্শে নিবেদিতা থাকা শুরু করেন বোসপাড়া লেনে সারদা মায়ের বাড়ির একটি ঘরে। কিছুদিন পর ওই রাস্তাতেই কিছু দূরে আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া নেন। কাছেই থাকতেন নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। 

এবারে নিবেদিতা কলকাতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে সাত মাস। ১৮৯৮-এর নভেম্বরের এক তারিখ থেকে  ১৮৯৯-এর জুনের উনিশ তারিখ; এই সময়কালের মধ্যেই তিনি কলকাতার শিক্ষিত সমাজে বেশ ভালোরকম পরিচিত হয়ে ওঠেন। 

১৮৯৮ সালের শেষের দিকে বিশেষ দুটো ঘটনা ঘটে: প্রথম, নভেম্বরের তেরো তারিখে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনে নিবেদিতার অনেক দিনের স্বপ্ন-উড়ান যাত্রা শুরু করে; তাঁর বালিকা বিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধন হল এইদিন সারদা মায়ের হাত ধরে এবং পরের দিন থেকে ক্লাস শুরু হয়। দ্বিতীয়, ডিসেম্বরের ৯ তারিখে স্বামীজীর উদ্যোগে নতুন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের (পরে বেলুড় মঠ নাম দেওয়া হয়) প্রতিষ্ঠা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্বামীজী এই অনুষ্ঠানের দশ দিন বাদে ১৯ ডিসেম্বর বৈদ্যনাথ ধামে যাত্রা করেন, প্রায় দেড় মাস পরে ফিরেও আসেন। জানুয়ারির গোড়া থেকেই মঠের জন্য নতুন কেনা জায়গাটায় (অর্থাৎ এখনকার বেলুড় মঠের স্থানেই) মঠের সমস্ত কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। নিবেদিতাকে স্বামীজী নতুন ব্রহ্মচারীদের বিভিন্ন ঐহিক বিষয়ে (অর্থাৎ জাগতিক) শিক্ষিত করে তোলবার ভার দেন। সেইমতো নিবেদিতা এইসময়ে প্রতিদিন বেলুড় মঠে আসতেন। মুক্তিপ্রাণার নিবেদিতা-জীবনী থেকে জানা যায়, ‘মঠে নিবেদিতার শিক্ষাদানের কার্যতালিকা ছিল এইরূপ—প্রতি বুধবার উদ্ভিদ্‌বিদ্যা ও চিত্রবিদ্যা এবং প্রতি শুক্রবার শারীরবৃত্ত ও সূচীশিল্প। পাঠদানের পর তিনি স্বামীজীর কক্ষে বসিয়া চা-পান করিতেন।’ [* মুক্তিপ্রাণার নিবেদিতা-জীবনী, ১২৫ পৃ] 

নিবেদিতার চিঠিতে জগদীশচন্দ্র বসুর কথা প্রথম পাওয়া যায় ১৮৯৯-এর জানুয়ারির এক তারিখে মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউড-কে লেখা চিঠিতে, যেখানে ছিল বেলুড় মঠে নিবেদিতার ওই শিক্ষাদানের তালিকাটাও: 

‘... I should want to tell you about my expedition to the Math and the dear little tea table in Swami’s room at which I drink tea after my lessons. My lessons are 

Wednesday 

     3. Botany 

     4. Drawing 

     5. Tea and home 

Friday 

     3. Physio 

     4. Sewing 

     5. Tea and home. 

‘Home’ today meant Swami— but on Friday will mean those dear Boses, whom I just love. [* letters of nivedita, 1st part, p 38 থেকে নেওয়া। ব্যাপারটা এইরকম যে বুধবার বিকেল তিনটেয় উদ্ভিদবিদ্যা, চারটেয় অঙ্কন, পাঁচটায় চা আর হোম, যে হোম প্রতি শুক্রবার হয়ে যায় বসুদের বাড়ি, অর্থাৎ জগদীশচন্দ্র আর অবলা বসুর সঙ্গ। যদিও এই চিঠির কিছু অংশ যখন শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ‘নিবেদিতা লোকমাতা’ (প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় পর্ব, ২১২ পৃ.) বইয়ে অনুবাদ করে উদ্ধৃত করেছেন, তখন drawing-এর জায়গায় লিখেছেন অঙ্ক]। 

এরপরে আমরা দেখি যে নিবেদিতা তাঁর বহু চিঠিতেই জগদীশচন্দ্র এবং অবলা বসুর সঙ্গে কীভাবে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে চলেছে, সে সবের বিবরণ লিখে পাঠাচ্ছেন। জগদীশচন্দ্রের গবেষণার প্রতিও তখন থেকেই তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন। আরও পরে আমরা দেখব যে এই আগ্রহ তাঁর দিনে-দিনে বেড়েই চলেছিল। 

এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে জানুয়ারির শুরুতেই ম্যাকলাউড আর সারা বুল তাঁদের দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁরা পরে আবার এ দেশে ফিরেও আসেন। 

 

২. 

এসব ছাড়াও নিবেদিতার কর্মসূচি ওই সময় ছড়িয়ে পড়েছিল মিশনের গণ্ডির বাইরেও। ১৮৯৮-এর ডিসেম্বরে উত্তর ভারত থেকে ফিরে আসবার পর সারা বুল আর মিস ম্যাকলাউড ক’দিন কলকাতায় আমেরিকার কনসাল জেনারেলের অতিথি হয়ে দিনকয়েক ছিলেন, কনসাল জেনারেলের স্ত্রী মিসেস প্যাটারসন কলকাতার ব্রিটিশ-ভারতীয় সামাজিকভাবে উচ্চ স্তরের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সময় নিবেদিতার সঙ্গে কলকাতার ব্রাহ্ম মহলেরও আস্তে-আস্তে পরিচিতি হতে থাকে। [* লিজেল রেমঁ-র নিবেদিতা জীবনী, ১৭৮ পৃ] 

ব্রাহ্মদের সঙ্গে নিবেদিতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল আরও এক উপায়ে। প্রতি বৃহস্পতিবার বিধান সরণিতে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে তিনি আসতেন ‘শিক্ষা’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে। এখানে আসতেন মূলত অভিজাত ব্রাহ্ম পরিবারের শিক্ষিতা মহিলারা— যেমন কেশবচন্দ্র সেনের দুই মেয়ে সুনীতি দেবী আর সুচারু দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী ও ভাগ্নি সরলা দেবী, জগদীশচন্দ্রের বোন লাবণ্যপ্রভা বসু প্রমুখ। অনুমান করার দরকার নেই, নিশ্চিত করেই বলা যায় ওই সময় থেকেই জগদীশচন্দ্র সম্বন্ধে কিছু-কিছু করে হলেও জানতে শুরু করেছিলেন নিবেদিতা। যেটা পরে মেলামেশার পরে ঘনিষ্ঠতায় রূপান্তরিত হয়। 

এবং বাংলা ভাষায় কিছু কিছু কথা ততদিনে তিনি বলতেও শিখে গিয়েছিলেন। লিখতেও পারতেন অল্প-অল্প করে। 


চা পানের সেই আসরে 

এবারে আমরা সেই বিশেষ দিনটার কথায় আসি, যেদিন জগদীশচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-নিবেদিতা (এবং অবশ্যই অবলা বসুও) মিলিত হয়েছিলেন প্রথমবার, এবং সম্ভবত একমাত্র সেই একবারই। 

তারিখ ২৮ জানুয়ারি, ১৮৯৯। শনিবার। উত্তর কলকাতার বাগবাজারের একটি সরু গলিতে একতলা একটি বাড়ির উঠোনে সেদিন জমায়েত হয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। এই আসর আজকে নানা কারণে বিখ্যাত; যার একটা কারণ একমাত্র এখানেই বিখ্যাত হয়ে দেশে ফেরবার পর স্বামীজীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ ঘটে। 

বলতে গেলে স্বামীজীর পরামর্শেই নিবেদিতা তাঁর বাড়িতে এই চা-পানের আয়োজন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্দরে নিবেদিতা প্রবেশ করুন, তাঁদের সঙ্গলাভ করুন। এতে তাঁর মধ্যে এ দেশের শিক্ষিত মানুষদের মনমেজাজ সম্বন্ধে ধারণা করতে বেশ কিছুটা সুবিধেই হবে। তাই এই পার্টির আয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই এই পার্টিতে হাজির থাকতে নিবেদিতা আমন্ত্রণ জানান তখনও পর্যন্ত তাঁর পরিচিতদেরকেই; সরলা ঘোষাল ও তাঁর মা স্বর্ণকুমারী দেবী, সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র, প্রসন্নকুমার রায় ও সরলা দেবী, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, বৃদ্ধ মহেন্দ্রলাল সরকার এবং রবীন্দ্রনাথকে তো বটেই। এসেওছিলেন এঁরা প্রত্যেকেই। 


২. 

ঠিক হয়েছিল যে নিবেদিতার স্কুলবাড়ির বারান্দাতেই বসা হবে। কিন্তু সেখানে পায়রাদের খুব উৎপাত। ওগুলোকে তাড়ানোও বেশ মুশকিল। তাই বসা হল শেষ অবধি তাঁর বাসার সামনের উঠোনেই। চা তৈরি নিয়ে কিঞ্চিৎ ঝামেলা হলেও শেষ পর্যন্ত চা বানানো গিয়েছিল, সেদিন চা বানানোর মূল ব্যবস্থা করেছিলেন অবলা বসুর দিদি মিসেস সরলা রায়, অর্থাৎ প্রসন্নকুমার রায়ের স্ত্রী। 

স্বামীজী একাই অনেক কথা বলে গিয়েছিলেন সেই আসরে। বাকিরা কী কথা বলেছিলেন, প্রায় কিছুই জানা যায় না। অতজন বিখ্যাত মানুষ সেদিন একত্রিত হয়েছিলেন, অথচ কেউই সেদিনের কথা পরে কিছুই লিখলেন না, এটাই আশ্চর্য! এমনকি এই আসরের কোনও বিবরণ রবীন্দ্রনাথ বা স্বামীজী, এঁদের লেখাতেও নেই। 

এই আসরের একটি বিবরণ নিবেদিতা লিখেছিলেন মিস ম্যাকলাউডকে, ১ জানুয়ারি, ১৮৯৯ তারিখের চিঠিতে: 

‘On saturday also I had a short of unarranged party. Mrs. P. K. Roy and young Mr. Mukherji, Mr. Mohini and the poet— and presently Swami with Dr. Sirkar. It was quite a brilliant little gathering, for Mr. Tagore sang 3 of his own compositions in a lovely tenor— ans Swami was lovely. Only there was some cloud— I could not tell what. Then he sent for me to dine with him— and I heard ... Oh Yum— when is one to be all right in choosing! I love this woman! Well, he [Swamiji] spoke beautifully about it, and said he was only making a suggesion on behalf of the school. As far as I was concerned I was safe anywhere. 

Anyway he told me to get up a tea party and invite all my Brahmo friends and he would come and talk!!! …. You can guess whether I’m doing it or not. I’m going to ask the Boses— Roys— (the Roys also, because they they are in the set, though it was that little man who was so horribly familiar the other evening) Mr. Mukherji— Mr. Mohini [Mohan Chatterji]— Mr. Tagore and Sarola Ghosal and her mother.’ 

এই চিঠিটা নিবেদিতা লিখেছিলেন মিস ম্যাকলাউডকে, এবং চিঠি লেখবার তারিখ ১/১/১৮৯৯ বলে শঙ্করীপ্রসাদ সম্পাদিত নিবেদিতার ইংরেজি চিঠিপত্র সংকলনে উল্লিখিত আছে। যদিও প্রশান্তকুমার পাল হিসেব করে জানিয়েছেন যে চিঠির সঠিক তারিখ হবে ৩১ জানুয়ারি। [* দ্রষ্টব্য রবিজীবনীর ৪র্থ খণ্ড, ২১৯ পৃ] 

নিবেদিতার অন্য কিছু চিঠিতেও এই পার্টির বর্ণনা পাওয়া যায়, যেমন ৩০ জানুয়ারি এবং ৭ ফেব্রুয়ারির চিঠিতেও। 

আগেকার ম্যাকলাউডকে লেখা ওই চিঠিতেই দেখি যে নিবেদিতা এমন লিখছেন: ‘রামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে বিরূপ কিছু সমালোচনা শুনে স্বামীজী জ্বলে ওঠেন এবং পরে যদিও বলেন, মেজাজ হারিয়ে তিনি মোটেই খারাপ কিছু করেননি। এইসময় তাঁকে দেখতে খুব ভালো লাগছিল।’ অর্থাৎ স্বামীজী চেয়েছিলেন এই সাক্ষাতেই তিনি ব্রাহ্মদের মধ্যে রামকৃষ্ণ-ভাবধারার বীজ সফলভাবে অন্তত উপ্ত করে দিতে পারবেন। যদিও আমরা জানি যে তাঁর সে প্রচেষ্টা প্রায় সফলই হয়নি কখনও।  

মিস ম্যাকলাউডকে লেখা ওই শনিবারের পরের মঙ্গলবারের চিঠিতে এই আসরের আরও কিছু বিবরণ পাঠিয়েছিলেন নিবেদিতা। তা থেকেই জানা যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথ সেদিন তিনটে গান গেয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে একটি দেবাঞ্জন সেনগুপ্তর ধারণা-অনুযায়ী হতে পারে ‘দিন ফুরালো হে সংসারী’— এটি। 

সভায় সামান্য গণ্ডগোল হয়েছিল বলেও কিছু ইঙ্গিত মেলে। যেমন চিঠিতে দেখি নিবেদিতা লেখেন, ‘there was some cloud’,-- এই মেঘ কি পারস্পরিক মনোমালিন্যের প্রতি ইঙ্গিত? স্বামীজীর সঙ্গে ব্রাহ্মদের কিছু ধারণায় অমিল প্রকাশ হয়ে যাওয়াতেই কি আড্ডার মূল স্পিরিট নষ্ট হয়ে যায়? তাই কি নিবেদিতা কিছু মেঘ জমতে দেখেছিলেন আকাশে? আবার এক ‘unholy’ মহিলাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য স্বামীজী কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, এমনটাও জানা যায় ওই চিঠি থেকে। কে এই অপবিত্র মহিলা, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। 

সব মিলিয়ে এইটাই খেয়াল করবার যে স্বামীজী আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে সদ্ভাব হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি শেষ পর্যন্ত। নিবেদিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল জগদীশচন্দ্রের, ভালোই সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও। জগদীশচন্দ্রের সঙ্গেও স্বামীজীর খুব বেশিবার সাক্ষাৎ না হলেও মোটামুটি সদ্ভাবই ছিল। একে অন্যের প্রশংসাই করতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-স্বামীজী? বয়সে দু’জনের মধ্যে মাত্রই বছর-দেড়েকের ব্যবধান, আর বাড়ির ঠিকানাও বেশ কাছাকাছি, তবু কোনওদিন দেখাসাক্ষাৎই হল না ঠিকমতো! রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে স্বামীজীর মনে যে বিরূপতা, সেটা হয়তো কিছুটা কাটত যদি স্বামীজী আরও কয়েক বছর বেঁচে থেকে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কর্মধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু নিয়তি তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তাই বাঙালি-সমাজের এই দুই প্রকাণ্ড আইকন পরস্পরের থেকে মুখ ফিরিয়েই জীবন কাটিয়ে দিলেন। 

..............


#

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

30

Unique Visitors

219551