জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (অষ্টম পর্ব)
..................
প্রবাসে জগদীশচন্দ্রের অসুস্থতা, বই প্রকাশ ইত্যাদি প্রসঙ্গ
ইউরোপ-প্রবাসে এসে নিবেদিতার সঙ্গে একটু বেশিই মেলামেশার সুযোগ পেলেন জগদীশচন্দ্র–অবলা। প্রায় প্রতিদিনই একসঙ্গে বসে তাঁরা গল্পগুজব করেন, কখনও নিবেদিতার কাছে বসু-দম্পতি শোনেন ভারতীয় পুরাণের ওপর আধারিত নানা কাহিনি। নিবেদিতা এই কাহিনিগুলোকে একত্রিত করে একটি বই হিসেবে প্রকাশ করতে চান, সে ব্যাপারে জগদীশচন্দ্রের প্রবল উৎসাহ।
সারা বুলও তখন প্যারিসে আসছেন, নিবেদিতা তাঁকে অনুরোধ জানালেন, আসবার সময় তিনি যেন নিবেদিতার খসড়া পাণ্ডুলিপিটি সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই পাণ্ডুলিপিই পরে ‘দ্য ওয়েব অভ ইন্ডিয়ান লাইফ’ নামে বই আকারে প্রকাশ পাবে। যাতে থাকবে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা, নারীদের অবস্থা, এ দেশে ইসলামি ভাবধারার আগমন ও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবদান, শিব-পার্বতীর গল্প— এরকম বেশ কিছু গদ্য। ১৯০৪ সালে বইটি প্রকাশিত হয়, এর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরে জগদীশচন্দ্র তখন নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়েও চলেছেন। সে সব বক্তৃতা ও-দেশের বিজ্ঞানীমহলে বেশ সাড়াও ফেলছে। ফ্রান্সের একাধিক জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি আসেন ইংল্যান্ডে, সেখানে ব্র্যাডফোর্ড ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভায় ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে এক বক্তৃতা দেন। এর বিষয় ছিল প্যারিসের বক্তৃতার সঙ্গে প্রায় একই। এই বক্তৃতারই শেষে অধ্যাপক অলিভার লজ সাহেব উঠে গিয়ে অবলা বসুকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এবং পরের দিন উইলিয়াম ব্যারেট নামে এক অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের কাছে ও দেশে চাকরির প্রস্তাব নিয়ে আসেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র সেই প্রস্তাবে তক্ষুনি রাজি হতে পারলেন না। অবশ্য পরেও দিনরাত ভেবে-ভেবে তিনি চাকরি গ্রহণ না করবার সিদ্ধান্তেই স্থির থাকেন। সেই সময়কার তাঁর মানসিকতা রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে ব্যক্ত করেছিলেন তিনি।
এই বক্তৃতার দিন কয়েক বাদে, অক্টোবরের গোড়ার দিকে হঠাৎ এক দিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন জগদীশচন্দ্র। সেই খবর জানালেন বন্ধুকে:
‘এখানে আসিয়া Dr. Crombie-র সহিত দেখা করিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন যে আভ্যান্তরিক কি গোলমাল হইয়াছে— শীঘ্র চিকিৎসা না করিলে আশঙ্কার কারণ। কঠিন Operation আবশ্যক, তাহাতে বিশেষ ভয় নাই, তবে প্রায় ৫ সপ্তাহ শয্যাগত থাকিতে হইবে। সুতরাং আমার কার্যের বড় বাধা পড়িল।’ (১৯০০ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি)
প্রবাসে তখন জগদীশচন্দ্রের দেখাশুনো করবার জন্য সহায় বলতে সেই নিবেদিতা আর সারা বুল। তাঁরাই তখন একত্রে থাকছিলেন বসু-দম্পতির সঙ্গে। সেবা-শুশ্রূষা করা, খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করা, আবার জগদীশচন্দ্রের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটাতেও খেয়াল রাখা— সবই করে চলেছেন এঁরা।
অনেকদিন পর দীর্ঘ দিন বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছেন জগদীশচন্দ্র। এই অবসরে তাঁর মনে ভাবনা জেগে ওঠে, যদি রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায়? না, তিনি নিজে নন, এই অনুবাদকাজের দায়িত্ব তিনি দিতে চাইলেন নিবেদিতাকেই। বন্ধুকে চিঠিতে জানালেন, তিনি চান রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে এ দেশে প্রকাশ করতে। এজন্য তিনি একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্তাও চালাচ্ছেন। এঁদের একজনের নাম মিসেস নাইট, যিনি তখন অনুবাদ কাজে বেশ পরিচিত। আরও একজনের কথা তিনি লেখেন চিঠিতে, নাম উল্লেখ করেন না, যদিও সহজেই বোঝা যায় তিনি হলেন নিবেদিতা।
নিবেদিতা মোট তিনটি রবীন্দ্র-গল্পের অনুবাদ করেছিলেন— কাবুলিওয়ালা, ছুটি আর দেনাপাওনা। অনেক বছর পর, ১৯১১ সালের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় উদ্যোগ নিয়ে কাবুলিওয়ালা গল্পটির অনুবাদ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। যদিও ততদিনে নিবেদিত প্রয়াত, তাঁর অনুবাদের এহেন স্বীকৃতি জেনে যেতে পারেননি তিনি।
২.
নিউ ক্যাভেন্ডিশ স্ট্রিটে জগদীশচন্দ্রের অপারেশন হয় ডিসেম্বরের ১১ তারিখে। অপারেশনের পর তিনি এসে ওঠেন ২৯ নং উইম্পল স্ট্রিটের (যে ঠিকানায় অপারেশনের আগেকার দিনগুলোয় থাকতেন) কাছের আর একটা বাড়িতে। এখানে নিবেদিতা আর সারা বুল অক্লান্তভাবে তাঁর সেবা করতে থাকেন। লিজেল রেমঁ তাঁর নিবেদিতা-জীবনীতে লিখেছিলেন ‘নিবেদিতা আর বসু-পত্নী পালা করে রাতের পর রাত জগদীশের সেবা করতেন।’
তবে কিছুদিন বাদে এই ঠিকানা ছেড়ে তাঁরা চলে আসেন উইম্বল্ডনে নিবেদিতার মায়ের কাছে। এই এলাকাটা গ্রাম্য, ফলে শহরের নাগরিক কোলাহল ব্যাপারটা এখানে নেই। শান্ত পরিবেশে, নিবেদিতা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেশ ভালোই দিন কাটে বসু-দম্পতির। কখনও তাঁরা একত্রিত হয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গ্রাম্য রাস্তা ধরে। সাইকেলে যেতে-যেতে একদিন তো নিবেদিতা সোজা গিয়ে ধাক্কা দিলেন এক ঝালাইওয়ালাকে। ধাক্কা দেওয়ার আগে তিনি চিৎকার করছিলেন, ‘মি. ঝালাইওয়ালা, সাবধান সাবধান!’ সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে অনেক কাল পরেও জগদীশচন্দ্র উচ্চঃস্বরে হেসে উঠতেন। নিবেদিতার ভাই রিচমন্ডের তত্ত্বাবধানে সাইকেল-চালনা শিখে নেন সারা বুলও। জগদীশচন্দ্র-অবলা তো কলকাতাতেই এর আগে সাইকেল চালানোতে রপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
৩.
আড্ডা-হাসি-গল্পগুজবের মধ্যে দু-জনের কাজের ব্যাপারটাও চালু ছিল বিলক্ষণ। জগদীশচন্দ্রের প্ররোচনায় রবীন্দ্র-গল্পের অনুবাদের পাশাপাশি নিবেদিতা তখন জগদীশচন্দ্রের প্রথম বিজ্ঞান-গ্রন্থ রচনার কাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত। বিজ্ঞানী-মহলে বিতর্কের সূচনা হওয়ার পর এবং কিছু তিক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জগদীশচন্দ্র তখন স্থির করেছেন যে তিনি আর কোনও পত্রিকায় তাঁর লেখা পাঠাবেন না, বদলে তাঁর যা কিছু বক্তব্য, তা গুছিয়ে বই আকারেই প্রকাশ করে সকলকে জানাবেন। সেইমতোই তখন চলছিল তাঁর প্রথম বই লেখবার প্রস্তুতি। আর সেই কাজে সর্বক্ষণ পাশে ছিলেন নিবেদিতা।
এমনকি এজন্য নিবেদিতা নিজের ভারতে ফেরাও একটু একটু করে পিছিয়ে দিচ্ছিলেন। একদিকে স্বামীজীর ডাকে দেশসেবার কাজে নিয়োজিত করবার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে জগদীশচন্দ্রের কাজের প্রতি আনুগত্য, এই দুইয়ের টানাপড়েনে তখন নিবেদিতা দ্বিতীয়টির দিকেই একটু বেশি ঝুঁকে। অবশ্য এইসময় তাঁদের পাশে আর্থিক এবং অন্যান্য আরও নানা ধরনের সাহায্য দিয়ে যাচ্ছিলেন সারা বুল-ও। সব মিলিয়ে তখন জগদীশচন্দ্রের জীবনের এক মহা-সন্ধিক্ষণ।
নিবেদিতা এরই পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে চলেছিলেন জগদীশচন্দ্রের কাজের ব্যাপারেও। ‘রিভিউ অভ রিভিউজ’ পত্রিকার জন্যও তিনি জগদীশচন্দ্রের এক ‘লাইফ স্কেচ’ লিখেছিলেন, তবে লেখাটা তখনই ছাপা না হলেও পরে ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে জগদীশচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে অন্য রূপে সেটা ছাপা হয়।
নিবেদিতা দেশে ফেরেন ১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে। জগদীশ-অবলা তখনও বিদেশে। তাঁরা ফেরেন
দেশে ফিরে একাধিক জায়গার বক্তৃতায় (যেমন মাদ্রাজে বা কলকাতায়) তিনি জগদীশচন্দ্রের প্রবাসে সংগ্রামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন এবং তাঁকে একজন জাতীয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টা চালান। স্বামীজী, রমেশচন্দ্র দত্ত এবং জগদীশচন্দ্রের দেখানো পথ অনুসরণ করে আরও মানুষকে ইংল্যান্ডে এসে ভারতের প্রকৃত স্বরূপ ব্রিটিশদের সামনে তুলে ধরা উচিত যাতে ওই সব দেশে তাঁদের লক্ষ লক্ষ অনুরাগী তৈরি হয়। এবং সেরকম হলে তবে আরও কুড়ি বছর পর ও দেশের মানুষ চিৎকার করে বলে উঠতে পারবে, হ্যাঁ ভারতকে স্বাধীন করে দেওয়া উচিত!
অন্যদিকে প্রবাসে থাকাকালীনই, ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে লংম্যান, গ্রিন অ্যান্ড কোং প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের প্রথম বিজ্ঞান-গ্রন্থ ‘রেস্পন্স ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং’। সেই বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা হতে লাগল সর্বত্র।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, এই বইয়ের কোথাও উল্লেখ রইল না নিবেদিতার নামটুকুও!
............................
#Jagadish Chandra Bose #Sister Nivedita #series #silly পয়েন্ট