জগদীশচন্দ্র ও সমকালীন বঙ্গসমাজ (প্রথম পর্ব)
পর্ব ১: রায়চৌধুরী পরিবার ও জগদীশচন্দ্র
বাড়িটার ঠিকানা তখন ছিল ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। সে-রাস্তার নাম এখন বিধান সরণি, যার বিস্তার কলেজ স্ট্রিট সংযোগের কাছে কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার পেরিয়ে টালা ব্রিজ পর্যন্ত। ঠনঠনে কালীবাড়ি থেকে কিছুটা উত্তর-মুখে হাঁটলে বাম দিকে চোখে পড়ে হলুদ রঙের একটা প্রকাণ্ড স্থাপত্য। সামনে পুরসভার হলুদ বোর্ড— ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’। আর এই বাড়িটির উলটোদিকেই লাল বিরাট আরও এক বাড়ি চোখে পড়ে, এক কালে যে বাড়িটা পরিচিত ছিল ‘লাহা বাবুদের বাড়ি’ নামে। তেরো নম্বর বাড়িটি পরে শরিকি বিবাদে ভেঙে ‘১৩এ’ আর ‘১৩বি’-তে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে বি চিহ্নিত বাড়িটি ভেঙে সেখানে এখন বহুতল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, ১৮৭০ সালের দিকে এই বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয় ব্রাহ্মসমাজের তরফে। যে সব ব্যক্তিরা ব্রাহ্ম হওয়ার ‘অপরাধে’ পরিবারে ব্রাত্য হয়ে যেতেন, তাঁরাই আশ্রয় পেতেন এই বাড়িতে। তবে শুধু এই একটাই কারণে নয়, এই বিশেষ বাড়িটির গুরুত্ব উনিশ-বিশ শতকের কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছিল প্রবল।
ছবি : লাহাবাড়ির একাংশ, এখনকার হাল
আরও বহু ব্রাহ্ম বিশিষ্টজনদের মতোই এই বাড়ির এক কালের বাসিন্দা ছিলেন পূর্ববঙ্গের মসুয়ার জমিদার-পরিবারের উজ্জ্বল এক ব্যক্তি। যদিও বিয়ের আগে ইনি থাকতেন ৫০ নং সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের আরেকটি বাড়িতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকতেন গগনচন্দ্র হোম, হেমেন্দ্রমোহন বসু বা প্রমদাচরণ সেনের মতো আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্রাহ্মনেতা। এই মানুষকে আমরা সকলেই চিনি, ইনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩ - ১৯১৫), বয়সে যিনি জগদীশচন্দ্রের চেয়ে ছিলেন পাঁচ বছর এবং রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের ছোট।
বাড়ির অমতেই উপেন্দ্রকিশোর বিয়ে করেন আরেক ব্রাহ্ম নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে বিধুমুখীকে। দ্বারকানাথই এই বাড়ির একেবারে আদিযুগের ভাড়াটে (যে কারণে পরে অনেকে এই বাড়িকে মজা করে ‘অবলা ব্যারাক’ নামেও ডাকত, বিশেষ করে হিন্দুরা)। বিধুমুখী এবং এক রুগ্ন ছেলেকে রেখে দ্বারকানাথের প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন অনেক আগেই। বিয়ের পর এই লাহাদের বাড়ির দোতলার একটা দিকে বসবাস শুরু করেন উপেন্দ্রকিশোর। তখন ইনি তরুণ ব্রাহ্ম নেতা, সেই সঙ্গে লেখালিখিতে বেশ হাত পাকাতে শুরু করেছেন; বিভিন্ন পত্রিকায় লিখছেন ভক্তিমূলক গান বা জ্ঞানবিজ্ঞানভিত্তিক গদ্য।
ছবি : উপেন্দ্রকিশোর
উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় ১৮৮৫ সালে। ততদিনে তাঁর অবশ্য বিএ পাশ করা হয়ে গিয়েছে। বিধুমুখীকে বিয়ে করবার সুবাদে ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট এবং দ্বারকানাথের দ্বিতীয় স্ত্রী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর শাশুড়ি-জামাই সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলির কথা এই লেখায় বিশদে বলবার সুযোগ নেই, তবে এইটুকু বলা যেতে পারে যে তিনি ছিলেন এই দেশের প্রথম মহিলা দু-জন গ্র্যাজুয়েটদের একজন এবং প্রথম বিলেত থেকে পাশ করে আসা ডাক্তার।
দ্বারকানাথও তখন এই বাড়িরই ভেতরের দিকে তেতলায় দ্বিতীয় স্ত্রী কাদম্বিনীর সঙ্গে বসবাস করছেন। তাঁদের উপস্থিতির কারণে এই বাড়িটি সবসময় যেন গমগম করত। এখানেই বলে নেওয়া যেতে পারে আরও একটা মজার তথ্য, ১৮৯৭ সাল নাগাদ স্ট্রিট ডাইরেকটরি অনুযায়ী এই বাড়ির দখলদার হিসেবে দেখানো ছিল ‘Dr. Mrs. Gangooly’-র নাম। ডক্টর, আবার মহিলা, এই প্রশ্ন মনে এলে যে নামটা প্রথমেই উত্তর হিসেবে বলতে ইচ্ছে হয়, হ্যাঁ, তিনিই। দ্বারকানাথ এখানে তাঁর স্বামী হিসেবে যেন গৌণ ভূমিকায় ছিলেন।
পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামের রায় পরিবারের উপেন্দ্রকিশোর (আসলে নাম কামদারঞ্জন) প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৮৮০ সালের দিকে। জগদীশচন্দ্রের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট এই মানুষটি প্রেসিডেন্সিতে একটানা চার বছর পড়াশুনো করে স্নাতক হন। তিনি যখন এখানে পড়ছেন, তখন জগদীশচন্দ্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে রয়েছেন বিদেশে।
বিয়ের পর উপেন্দ্রকিশোর কিছুকাল মাত্র বাস করেছিলেন ওই ১৩ নং বাড়িতে। আসলে ব্রাহ্মমতে বিয়ে করবার জন্য (এবং নিজে কায়স্থ হয়েও ব্রাহ্মণ-কন্যাকে বিয়ের জন্যেও) উপেন্দ্রকিশোরের বাড়ির লোকেরা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁর সঙ্গে বাড়ির সম্পর্ক আবার সহজ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর বাবা তাঁকে পারিবারিক সম্পত্তি বিশেষ কিছু দিতে চাননি, যদিও বাবা হরিকিশোরের মৃত্যুর পর তাঁর মা রাজলক্ষ্মী দেবী তাঁকে পৈত্রিক সম্পত্তির অর্ধেক (বাকি অর্ধেক পেয়েছিলেন তাঁর ভাই নরেন্দ্রকিশোর) পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
এই লাহাদের বাড়িটির আরও নানা কারণে বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে, যেমন এই বাড়িতেই কিছু সময় থেকেছেন বিখ্যাত পণ্ডিত-নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী, এই বাড়িতেই জাতীয় নেতা নবগোপাল মিত্র চালু করেন ন্যাশানাল স্কুল (এখানে পড়াশুনোর পাশাপাশি নাকি শেখানো হত বন্দুক ছোঁড়া-ও!), ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার অফিস ছিল এই বাড়িতেই। আর এটাও এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এই বাড়িরই একটি অংশে এক কালে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’ নামের একটি স্কুলে ১৮৬৫ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বল্পকালীন পড়াশুনোর সূত্রপাত ঘটে। এই বাড়ির কাছেই ছিল বিখ্যাত সেই ‘পান্তির মাঠ’, যেখানে বঙ্গভঙ্গের সময় কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলারের জবাব দিতে প্রকাণ্ড এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে সুবোধ মল্লিক-কে রাজা উপাধি দিয়েছিল কলকাতার জনগণ। এখন অবশ্য সেই মাঠ আর নেই, বদলে সেই জায়গায় গড়ে উঠেছে বিদ্যাসাগর কলেজের হোস্টেল।
এ ছাড়াও এই বাড়ির একেবারে ভিতরেই ছিল আরও একটি স্কুল, যার নাম ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়। কলকাতা শহরে মেয়েদের জন্য নির্মিত দ্বিতীয় এই স্কুলটি স্থাপন করেন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৯০ সালের ১৬ মে তারিখে, বিলেত থেকে ফিরে আসবার পর। ততদিনে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি এখান থেকে অন্যত্রও সরে গিয়েছে। শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে এই নতুন স্কুলটি তৈরিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বন্ধু দ্বারকানাথ ও আনন্দমোহন বসুও। এই স্কুলেই পড়তেন উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেমেয়েরা, যাঁদের অন্যতম সুকুমার রায় [* উপেন্দ্রকিশোর-বিধুমুখীর মোট ছয়টি সন্তান— তিন ছেলে সুকুমার, সুবিনয়, সুবিমল, আর তিন মেয়ে সুখলতা, পুণ্যলতা আর শান্তিলতা। এঁদের মধ্যে সুবিমল বাদে বাকিদের প্রত্যেকের জন্ম এই বাড়িতেই]। ‘বালিকা শিক্ষালয়’-এ সুকুমার রায় পড়তেন শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই, তখনকার দিনে বারো বছর বয়স অবধি ছেলেরাও এই স্কুলে পড়তে পারত। বছর কয়েক পরে ১৯০৩ সালে স্কুলটা ওই জায়গা ছেড়ে আপার সার্কুলার রোডে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের উলটোদিকে উঠে আসে। এখনও এই স্কুল ওই স্থানেই দিব্যি টিকে রয়েছে। সুতরাং এটাও ধরে নেওয়া যায় যে ভগিনী নিবেদিতা প্রথমবার কলকাতায় আসবার দিন কয়েক বাদে জগদীশচন্দ্রের বোন লাবণ্যপ্রভার সঙ্গে দেখা করতে এই লাহা বাড়িতেই এসেছিলেন।
একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ের এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল যেন তখন এই এলাকাটাকে, বিশেষ করে এই বাড়িটাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল, আর তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ওই ব্রাহ্ম বালিকা স্কুলের কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিতেও। পড়াশুনোর পাশাপাশি এ দিকেও বিশেষভাবে নজর দেওয়া হত। শেখানো হত গান, যেটা তত্ত্বাবধান করতেন স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর; তিনি নিজে বেহালা বাজিয়ে গান শেখাতেন, সেই গান তাঁর নিজেরই লেখা, সুরও তাঁরই। ততদিনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে; প্রসঙ্গত লীলা মজুমদার লিখেছিলেন যে, ‘উপেন্দ্রকিশোর ও তাঁর বেহালা ছাড়া জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কোন গানের জলসা সম্পূর্ণ হতো না।’ (* লীলা মজুমদারের উপেন্দ্রকিশোর জীবনী, ১৯ পৃ, বুক ট্রাস্ট)
ছবি : বন্ধুদের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর। একেবারে ডান দিকে পেছনে রবীন্দ্রনাথ, সামনে উপেন্দ্রকিশোর
এর পাশাপাশি এই স্কুলটায় প্রতি রবিবার নীতিশিক্ষার ক্লাস হত। কোনও-কোনও রবিবার ছেলেমেয়েদের দল বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে বা আলিপুর চিড়িয়াখানায়। আবার কোনও-কোনও রবিবার আসতেন এক অধ্যাপক, যিনি চার্ট, মডেল ইত্যাদির সাহায্যে ছাত্রীদের দেখাতেন বৈজ্ঞানিক নানা তত্ত্ব।
তাঁরই নাম জগদীশচন্দ্র বসু।
২. উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে তো বটেই, পরবর্তীকালে রায় পরিবারের একাধিক সদস্যের সঙ্গেও জগদীশচন্দ্রের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই বাড়িতে তিনি আসতেন নিয়মিত, বিশেষ করে উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে আড্ডা দিতে। এই প্রসঙ্গে আমরা পুণ্যলতা দেবীর স্মৃতিচারণ কিছুটা পড়ে দেখব :
‘আচার্য জগদীশচন্দ্রকে কেমন যেন ‘ভোলা’ মানুষ মনে হত। একবার তিনি আমাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরবার জন্য উঠেছেন। সিঁড়ির মুখে এসে হঠাৎ কি কথা মনে পড়ে গেল, দাঁড়িয়ে আবার বাবার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। এদিকে আমাদের স্কুলের সময় হয়েছে, আমরা বইখাতা হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছি; বাবা আমাদের দিকে পিছন ফিরে আছেন বলে দেখতে পাচ্ছেন না, জগদীশচন্দ্র আমাদের দিকেই ফিরে আছেন, কিন্তু দেখেও দেখতে পাচ্ছেন না। একমনে গল্প করে চলেছেন— আর এমনভাবে এদিকের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, ওদিকের দেওয়ালে হাত রেখে, বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে, আমাদের যাবার পথও নেই। রাস্তায় বাসের গুম্গুম্ শব্দ শুনে দিদি বলল, “চল্, পিছনের সিঁড়ি দিয়ে যাই।” (রান্নাঘরের দিকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি ছিল।) টুনী আপত্তি করল, “কেন? ঘুরে যাবো কেন?” “দেখছিস্ না, উনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন?” “তাতে কি হয়েছে?” বলে টুনী বোঁ-ও করে জগদীশচন্দ্রের হাতের তলা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল, তিনিও চমকে উঠে হেসে পথ ছেড়ে দিলেন।’ (* ছেলেবেলার দিনগুলি, ১০৬-১০৭ পৃ.)
রায় পরিবারের আরও একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের মেলামেশার কথা আমরা জানব, পরের পর্বে।
[চলবে]
...........................