চলচ্চিত্রে জগদীশচন্দ্র
১৯৫৮ সাল। জগদীশচন্দ্রের শতবর্ষ। এই উপলক্ষ্যে ভারত সরকারের ফিল্মস ডিভিশনের উদ্যোগে তৈরি হয় জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র, "আচার্য জগদীশচন্দ্র"। পরিচালনা করেছিলেন পীযূষ বসু, যিনি পরবর্তীকালে বানাবেন সন্ন্যাসী রাজা, সব্যসাচী, বিকেলে ভোরের ফুলের মতো হিট ছবি।
প্রায় আটত্রিশ মিনিটের এই তথ্যচিত্রটি ইউটিউবে রয়েছে, ইচ্ছে করলেই দেখে নেওয়া যায়।
ইংরেজি ভাষায় নির্মিত এই ছবিটিতে শুরুতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখানো হয় ভারতের গৌরবময় অতীতের কিছু নিদর্শন, স্থাপত্য এবং পৌরাণিক ঘটনার বর্ণনার মধ্যে দিয়ে। এরপরে জগদীশচন্দ্রের ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠা দেখানো হতে থাকে। তাঁর স্কুলে পড়া, বিদেশ যাত্রা, ক্রাইস্ট কলেজে ভরতি হওয়া, দেশে ফেরা, অধ্যাপনায় যোগ দেওয়া এবং গবেষণায় আত্মনিয়োগ, বসু বিজ্ঞান মন্দির নির্মাণ, সাহিত্যকীর্তি– এর সবই একে একে আসে, ধারাভাষ্য সহ। শেষে তাঁর প্রয়াণের দৃশ্যটিও বড় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।
এইবারে আসল খটকা। এই সিনেমার শুরুতে দেখানো হয় যে, প্রযোজনা এবং স্ক্রিপ্ট রচনায় তপন সিংহ।
কিন্তু সম্প্রতি হাতে আসা তপন সিংহ লিখিত বই "চলচ্চিত্র আজীবন"-এর পাতা উলটে পাওয়া গেল জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে তাঁরই বানানো একটি তথ্যচিত্র সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য। তারপরেই মনে বাসা বাঁধল খটকাটি, দুটি চলচ্চিত্রই কি এক? তপন সিংহের তৈরি করা স্ক্রিপ্ট নিয়েই কি এটি বানিয়েছিলেন পীযূষবাবু?
২/
বিশিষ্ট পরিচালক তপন সিংহ তিনটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সারা জীবনে, সেসবের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য জানা যায় তাঁর লেখা গদ্যসংগ্রহ "চলচ্চিত্র আজীবন" বইটি থেকে। এগুলোর মধ্যে প্রথম অবশ্যই জগদীশচন্দ্র বসু (ওদিকে ইউটিউবে দর্শিত তথ্যচিত্রটির নাম 'আচার্য জগদীশচন্দ্র', খেয়াল রাখা দরকার)। এমনিতে তিনি তখন ব্যস্ত চলচ্চিত্রনির্মাতা, একটা সিনেমা শেষ হতে না হতেই হাত দিতে হচ্ছে পরের ছবির নির্মাণে। ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছেন টনসিল, কাবুলিওয়ালা, লৌহকপাট, কালামাটি ইত্যাদি সিনেমা। এরকম অবস্থাতেও তিনি এই তথ্যচিত্রটি বানাতে এগিয়ে এসেছিলেন, কারণ এর পিছনে মূল আগ্রহ ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর। এরপর তপনবাবুর স্মৃতিচারণ থেকে পড়ে দেখি–
"উনি তথ্যমন্ত্রকে চিঠি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ বসুকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করার উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। এবং বলেছিলেন স্থানীয় পরিচালকদের দিয়েই যেন ছবি দুটি করানো হয় ও বিশেষভাবে সত্যজিৎবাবু ও আমার নাম উল্লেখ করেছিলেন। তখন আমি খুবই ব্যস্ত। তার ওপর ঘাড়ের ওপর চাপল এই বাড়তি দায়িত্ব। ওঁরা বললেন প্রাইম মিনিস্টার বলেছেন। যাই হোক বিষয়টা নিয়ে লেগে পড়লাম। প্রতিদিন সকালে জগদীশ বসুর ভাগনে ড. ডি এম বসুর কাছে যেতাম। উনি তখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ডিরেকটর। উনি বললেন জগদীশ বসুর খ্যাতি যদিও প্লান্ট ফিজিওলজিস্ট হিসেবে তাহলেও উনি বেসিকালি ছিলেন ফিজিসিস্ট। তুমি তো ফিজিকসটা জানো, ওইভাবে স্ক্রিপ্টটা তুমিই কর না। আমি বললাম, না স্যার আপনিই স্ক্রিপ্টটা করে দিন। তারপর ওঁর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন বসে স্ক্রিপ্টটা করলাম। উনি লিখতে বললেন। লেখার পর উনি সংশোধন করলেন। তারপর সেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে দিল্লি গেলাম। তখন তথ্য দপ্তরের সেক্রেটারি ছিলেন রামধানি। আমি স্ক্রিপ্ট-এর শুরুতে খানিকটা কাব্য করেছিলাম৷ প্রথমে এলেন সাহিত্যিকরা, তারপর বিজ্ঞানীরা, কাজ করতে আরম্ভ করলেন; দেন কেম নিউটন। তখন সবাই বলতে লাগল- ফর নেচার নেচারস ল আর হিডন ফ্রম দ্য সাইট, গড কমান্ডেড লেট নিউটন বি অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট। রামধানি বললেন- তোমার এইসব কবিতা বাদ দিতে হবে, রাশিয়ানরা এএ এক্সেপশন নেবে। আমাদের তো সব কথা ভাবতে হবে। এই কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল। আমি বললাম, এটা আমার কবিতা নয়; ইংল্যান্ডে পোপ বলে একজন কবি ছিলেন, এটা তাঁর রচনা। আমি শুধু এটা জায়গা মতো ব্যবহার করেছি। এই বলে বেরিয়ে এলাম। আমি ফিরে এসে ড. বোসকে সব কথা বললাম৷ উনি শুনে বললেন, ঠিক আছে আমি দেখছি। জওহরলাল কেমব্রিজে ওঁর ক্লাসমেট ছিলেন। নেহরুর সঙ্গে ড. বোস কী কথা বলেছিলেন জানি না; আমায় শুধু বললেন তোমাকে আর যেতে হবে না, আমিই ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি। রামধানি কলকাতায় এলেন এবং বোস ইনস্টিটিউটে এসে কথা বললেন। দেখলাম কথাবার্তায় একদম অন্যরকম। বললেন– ছবি শুরু করুন, কোনো অসুবিধা হবে না। আমি বললাম, আমি চাইছি এবং ড. বোসও চাইছেন কেমব্রিজে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় শট্ নিতে। রামধানি বললেন ঠিক আছে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে। ফরেন এক্সচেঞ্জের কথা তুলতে জানালেন তাতেও কোনো সমস্যা হবে না। তারপর গম্ভীরভাবে বেরিয়ে গেলেন। এরপর ছবি তৈরিতে আর কোনো সমস্যা হয়নি।" (চলচ্চিত্র আজীবন, তপন সিংহ। দে'জ। ৪০৯-৪১০ পৃ)
এই সিনেমার জন্য রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জানা যাচ্ছে এই বইয়ের ১০৯ পৃষ্ঠা থেকে। যদিও সিনেমাটিতে কোনও গান নেই, আছে আবহসংগীত। হেমন্তবাবু বম্বে থেকে একদিনেই রেকর্ড করে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (অষ্টম পর্ব) / অর্পণ পাল
উইকিপিডিয়ায় অবশ্য লিখছে যে ১৯৫৮ এবং ১৯৫৯ সালে দুটিই তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল ফিল্ম ডিভিশনের সহায়তায়, একটি পীযূষবাবুর পরিচালনায়, অন্যটি তপনবাবুর। তপনবাবুর তথ্যচিত্রটির সন্ধান কোথাও না পাওয়া অব্দি বা এ ব্যাপারে আরও বেশি তথ্য হাতে না আসা অব্দি এই সমস্যার মীমাংসা করা বোধ করি সম্ভব নয়।