বিদেশের পাঠ্যক্রমে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী তরুণী কবি জাসিন্তা কারকেট্টা
বর্তমান দেশ-কাল-পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কবিতাই হতে পারে মানুষের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিবাদের অস্ত্র, কারণ যুগে যুগে বারংবার প্রমাণিত হয়েছে কলমের জোর যে কোনও সামরিক অস্ত্রের চেয়ে বেশি। এমনটাই মনে করেন তিনি। তিনি, জাসিন্তা করকেট্টা, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সমাজের এক তরুণী কবি। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিচিতি পেয়েছেন বিদেশেও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কবিসম্মেলনে তিনি আমন্ত্রণ পাচ্ছেন। রাশিয়ায় তাঁর কবিতা পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা জাসিন্তা। ছোটোবেলা থেকে লড়াই করেই বেঁচেছেন। বাবা পেশায় ছিলেন পুলিশকর্মী, আর স্বভাবে ছিলেন মদ্যপ, অত্যাচারী। প্রায়শই তিনি বাড়ি ফিরতেন না, ফিরলেও নেশা করে তাঁর মা-কে মারধর করতেন। সংসারকে তিনি শান্তি, ভরসা, নিশ্চয়তা কোনোটাই দিতে পারেননি, বরং পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তিমান ত্রাস। এইসব কারণে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সংসার চালানোর ভার নিতে হয়েছিল জাসিন্তার মা-কে। এই গার্হস্থ্য হিংসা আর অশান্তিময় পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন জাসিন্তা। তাঁর দেখা প্রথম নির্যাতিত মানুষ ছিলেন তাঁর মা। মায়ের প্রতি চলা এই ধারাবাহিক অত্যাচারই তাঁর মনে প্রথম আগুনের ফুলকির জন্ম দিয়েছিলো।
এই সময় থেকেই জাসিন্তা খুঁজে চলেছিলেন নিজের প্রতিবাদের ভাষা। সে খোঁজ পেলেনও তিনি, তবে তা খানিকটা নাটকীয়ভাবেই। ঝাড়খণ্ডের অধিবাসী হওয়ার সুবাদে সাঁওতালি আর হিন্দি দুই ভাষাতেই সড়গড় ছিলেন। ক্লাস এইট-এ পড়ার সময়ে হাতে আসে মুন্সি প্রেমচন্দের লেখা। সেই শুরু, তারপর আস্তে আস্তে অন্য অনেক লেখা পড়লেন। আর পড়তে পড়তেই এক সময়ে বুঝতে পারলেন লেখালেখিই হল তাঁর স্বাচ্ছ্যন্দের জায়গা। তখন যে বইই পেতেন গোগ্রাসে পড়তেন। পাশাপাশি শুরু করলেন কবিতা লেখা। জাসিন্তার কবিতার বিষয় হিসেবে শুরু থেকেই উঠে এল তাঁর মায়ের কথা, ছোটোবেলা থেকে দেখা আশপাশের মানুষের কথা। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় সেই কিশোরীবেলাতেই, রাঁচির 'রাহি' পত্রিকায়। এরপর থেকে তাঁর কলম থামেনি, বরাবর অক্ষরের সঙ্গে চলেছে ওঠাবসা। পড়াশোনার শেষে জাসিন্তা সাংবাদিকতার চাকরি পেলেন। এই চাকরি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনে কিছুটা স্থিতি আনে। কাজের জন্য অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। সেই সূত্রেই আরও অনেক বেশি মানুষের মধ্যে গিয়ে পড়লেন তিনি, প্রচুর মানুষ, তাদের বিচিত্র জীবনযাত্রা - দেখলেন খুব কাছ থেকে। এই সময়ে তাঁর নিজের জীবন খানিকটা অস্থির হয়ে পড়েছিল। কাজ আর সাহিত্যচর্চার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি তিনি, যার জন্য সাময়িকভাবে কবিতা লেখা থেকে দূরে সরে যান। প্রায় তিন বছর কিছুই লিখতে পারেননি জাসিন্তা।
তিন বছর চাকরি করার পর ২০১৩ সালে জাসিন্তা চাকরি ছেড়ে দেন, লেখালেখির জগতে আবার ফিরে আসেন। এই দ্বিতীয় দফার লেখায় ছাপ ফেললো তাঁর অভিজ্ঞতা। সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণ শক্তি আর অনুসন্ধানী মনের প্রভাব পড়লো তাঁর কবিতায়। তবে চাকরি ছাড়লেও সাংবাদিকতা পুরোপুরি ছাড়েননি জাসিন্তা। এখনও তিনি সাংবাদিকতার কাজ করেন, তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। মায়ের যে কষ্ট জাসিন্তা দেখেছিলেন, তার চেয়েও প্রতিকূল পরিবেশে মানুষকে বেঁচে থাকতে দেখেছিলেন তিনি গত কয়েক বছরে। জাসিন্তা মনে করেন, সাধারণ মানুষের দিনযাপন, তাদের চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-হতাশা, অভাব-অভিযোগ এই সবকিছুই বারবার হয়ে ওঠে তাঁর লেখকসত্তার খোরাক। কবিতা তাঁর কাছে নিভৃত সাধনার ফসল নয়, তীব্র সংরাগময় মানুষের জীবনই তাঁর লেখার রসদ জোগান দিয়েছে আর তাঁর সৃষ্টিকে পৌঁছে দিয়েছে চরম উৎকর্ষে।
আরও পড়ুন : বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা দৈনিক সংবাদপত্র : ‘দ্য মুসলমান’ / টিম সিলি পয়েন্ট
জাসিন্তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে, কলকাতার 'আদিবাণী' প্রকাশনা থেকে। হিন্দি ভাষায় লেখা এই প্রথম বইতেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। আদিবাসী সমাজের প্রাত্যহিক জীবন, তাদের সুখ-দুঃখ সবকিছু খোলসহীন ভাবে ফুটে উঠেছে এই বইতে। অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় এই বইটির অনুবাদও হয়েছে। এছাড়া জাসিন্তার অন্য কয়েকটি বই জার্মান ইত্যাদি বিদেশি ভাষাতেও অনুবাদ হয়েছে। লেখালেখির সূত্রে এখন সাহিত্য জগতে জাসিন্তা কারকেট্টা পরিচিত একটি নাম। পৃথিবীর অনেক জায়গায় তাঁর লেখা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি জাসিন্তার লেখা কবিতা রাশিয়াতে পড়ানোও হয়। আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া-তে কবি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি যোগ দিয়েছেন বেশ কিছু সাহিত্য সম্মেলনে। ২০২০ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। নিজের কথা, নিজের উপলব্ধির কথা এভাবেই সবার কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জাসিন্তা। ছোট্ট একটি জনপদ থেকে উঠে আসা এক তরুণী কবি এভাবেই ক্রমশ বাড়িয়ে নিচ্ছেন তাঁর পরিসর। বললে অত্যুক্তি হয় না যে, সাহিত্যজগতে জাসিন্তা কারকেট্টা এখন সত্যিই এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত।
.................................