ইরফান: এক অন্যরকম ‘দেখা’-র গল্প
বইয়ের খবর: ইরফানলেখক: শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী প্রকাশক: ঋত প্রকাশনপ্রচ্ছদ: মৃণাল শীল
বিগত এক দুঃসহ বছরের শুরুতেই ব্যথাতুর মায়াবী চোখের নায়ক চিরবিদায় নিলেন। আবার সেই বছরশেষেই যদি হাতে আসে সদ্যপ্রকাশিত নভেলা ‘ইরফান’, বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে বইকি। মনে হয়, আবারও কি তাঁকে নিয়ে কোনও ব্যক্তিগত গদ্য বা সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ? নবাগত লেখক শুভংকর সেই দিকে অন্তত আশ্বস্ত করেছেন, এই ‘ইরফান’ বেনারসের পটভূমিতে এক কল্পিত কাহিনিমাত্র।
অথচ শুধু কি তাই? গল্পের নামভূমিকার ব্যক্তিটি কলেজ-পড়ুয়া, ভবঘুরে। বেনারসের ঘাটে, অলিগলিতে, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কবিতা খুঁজে বেড়ানো এক আশ্চর্য মানুষ ইরফান। মণিকর্ণিকা থেকে মান সরোবর ঘাট হয়ে মহীন, শাম, সুদর্শনা, কল্যাণ ভাই সবার জীবন ছুঁয়ে যায় ইরফানের পথচলা। অবশ্য চলা না বলে একে বয়ে যাওয়া বলাই ভালো। কাহিনির শরীর জুড়ে ইরফানের যাতায়াত বারাণসীর গঙ্গার মতোই; গলিঘুঁজিতে মিশে গেলে তার দেখা পাওয়া ভার, কিন্তু সে আছে, বাকি সবকিছুর থেকে অনেক বেশি করে আছে। ইরফানের ভবঘুরেপনা ঠিক নীললোহিতের মতো দামাল নয়, হিমুর সাবলীলতাও নেই তার। এক অদ্ভুত ঝিম ধরা মায়ার বিস্তার ছেয়ে থাকে ইরফানকে; তার কবিতা লেখা, পরিবেশ আন্দোলনে জড়িয়ে পরা, সুদর্শনার প্রতি তার একবুক খামচে-ধরা ভালোবাসা– কোনও কিছুই উচ্চকিত নয়, বরং কোমল ধৈবতে বাঁধা। পড়তে পড়তে মনে হয়, এই ইরফানেরও বুঝি অমন একজোড়া মায়াবী চোখ আছে। বাস্তবের অভিনেতা আর কল্পনার কবি, কোথাও গিয়ে মিশে যেতে থাকে।
এই গল্প যতটা ইরফানের, ততটাই বারাণসীরও। বৃদ্ধ শহরের সেই গল্প বুনে চলে অসমবয়সি তিন ইয়ারি কথা। মহীনের প্রতিবাদী সাংবাদিকতার সঙ্গে ঘটনাচক্রে মিলে যায় ইরফানের মানবচেতনার অন্তর্লীন আহ্বান। ধার্মিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা শাম, যেন কোনও আরেক গালিবের টানে, বারবার ছুটে আসে ইরফানের কাছে। অস্সি নদীর দূষণ, জাতপাতের বিচার, ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার-ভাটা, খোরি ঘাটের মালাই চায়ের ঠেক– সবকিছু মেখে শাশ্বত এক আলোর মতো জ্বলতে থাকে মণিকর্ণিকার চিতা। মৃত্যুর থেকে বড় কোনও সাম্যবাদ নেই।
ব্লার্ব অনুযায়ী লেখকের এইটিই প্রথম উপন্যাস, হয়তো এক অর্থে প্রথম ফিকশনও বটে। তাঁর লেখার সঙ্গে পূর্বপরিচিতি না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে লেখক মূলত একজন কবি। কাব্যময়তা এবং কাব্যভাষার প্রলেপ তাঁর গদ্যের ছত্রে ছত্রে। এমনকি ‘শেষের কবিতা’-র স্টাইলে উপন্যাসের শেষভাগে ইরফান ও সুদর্শনার এক কাল্পনিক প্রেমালাপ উঠে আসে কবিতার শরীর নিয়ে। সৌভাগ্যের বিষয়, এই কাব্যময়তা গদ্যের স্বাভাবিক চলনকে এতটুকুও রুদ্ধ করে না। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, বিষাদে-বিরহে-আমোদে-বিজনে মায়াকাব্যের পরশ পড়েছে ঠিক ততটুকুই। ছাপোষা গেরস্ত বাড়ির দৈনন্দিন আলাপচারিতা বা উঁচু জাতের ক্ষমতার নীরব আস্ফালন– টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলি যত্ন নিয়ে তৈরি করেছেন লেখক, এমনকি কথ্য ভাষার কোনও লব্জ প্রয়োগ না করেও চরিত্রগুলিকে বাঙালি হয়ে যেতে দেননি। বারাণসী শহর, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, শ্মশান সংলগ্ন চায়ের ঠেক, সবকিছুর বর্ণনায় লেখক বিস্ময়কর রকম সাবলীল; স্পষ্টত এ ক্যানভাস তাঁর অনেকদিনের চেনা। তুলনায় রাজনীতির আঙিনা বা মহল্লার বাদবিবাদের ছবি আঁকায় তিনি কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট, কিন্তু সেটুকু দুর্বলতা বুঝতে না দেওয়ার ক্ষমতা এই উপন্যাসের আছে। প্রসঙ্গত, উপন্যাসের আরেক হাতিয়ার এর প্রচ্ছদ। শিল্পীর সাহসী কল্পনায় মন্দির-শহর ফুটে উঠেছে ঋজু রেখার আঁচড়ে। কালো-সাদার মাঝে বইয়ের নামটিকে আলাদা মাত্রা দেয় লালের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার। দু-একটি মুদ্রণপ্রমাদ রসভঙ্গ করলেও আসল খেদ অন্যখানে– যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা এই আখ্যানেও অনেক রং লাগানো যেত, মানবমনের ভিতরে গেঁড়ে বসা ক্যানসারগুলোকে নিয়ে আরও শানিত ব্যবচ্ছেদ করা যেত। সমাজের দুরূহ সমস্যাগুলিকে গল্পের মধ্যে চারিয়ে দিয়েই তাদের প্রতি অদ্ভুতরকম নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যান লেখক। তাঁকে পলায়নবাদী বলা যাবে না, কারণ প্রতিটি ঘটনার বাস্তব পরিসংহার টানা হয়েছে সুখী সমাপ্তি দেখানোর হাতছানি উপেক্ষা করেই। তবু চাইলে ইরফানের পথচলা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত। সম্ভবত জেনেবুঝেই লেখক সে পথে যাননি। তাঁর লেখার মূল সুরটি আসলে বাঁধা আছে ইরফান আর সুদর্শনার ক্ষণিকের সফরনামায়। নাগরিক ক্লেদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নয়, তার মধ্যে থেকেও জীবনের বৃহত্তর দর্শনকে আঁকড়ে ধরার গল্প বলে ইরফান।