বুলেট-ক্ষতের অদৃশ্য আলোয় তোলা ছবি ও এক ব্রিটিশ ডাক্তারের কথা
মাত্র বারো বছরের একটি ছেলে এসেছিল এক ডাক্তারের চেম্বারে। সমস্যা হল তার বাম হাতে ঢুকে গিয়েছে বুলেট! সে নাকি নিজেই নিজেকে গুলি করেছে। কিন্তু আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, ডাক্তারবাবুটি ওই ক্ষতের মধ্যে নানাভাবে চেষ্টা করেও বুলেটটির কোনো সন্ধান পেলেন না। ক্ষতের আকার বড় করে বুলেট সন্ধানের প্রক্রিয়া ছেলেটির পক্ষে আরও বেশি করে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে এটা ভেবে তিনি অন্য উপায় খুঁজতে বসলেন।
উপায় পাওয়া গেল হাতের কাছেই। তিনি ডাক দিলেন বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক অলিভার লজকে। লজ সাহেব তখন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি নানারকম যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাঁর পরীক্ষাগারে তৈরি করেছেন এক অদৃশ্য রশ্মি তৈরির ব্যবস্থা। ডাক্তারবাবুটি শুনেছেন, এই রশ্মি দিয়ে নাকি হাতের ছবি তুললে সেই ছবিতে ফুটে ওঠে কঙ্কালের হাত! মাস কয়েক আগেই বিভিন্ন পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল এই রশ্মির আবিষ্কারের খবর। বুলেটটা ঠিক কোথায় আছে, সেটা জানবার জন্য এই রশ্মি কাজে লাগিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী?
রবার্ট জোনস নামে এই ডাক্তারটির বয়স এখন আটত্রিশ। ছোটবেলাতেই কাকার কাছেই শিখে ফেলেছিলেন হাড়ের চিকিৎসার নানা খুঁটিনাটি। পরে লিভারপুল থেকে ডাক্তারি পাশ করে লিভারপুলেরই একটি হাসপাতালে সহকারী সার্জন হিসেবে যুক্ত হন। মাত্র বছর দশেক আগে পদোন্নতি হয়ে তিনি ওই হাসপাতালের সার্জনও হয়েছিলেন। আর কয়েক বছর আগে এফআরসিএস (ফেলোশিপ অব রয়াল কলেজ অব সার্জনস) উপাধি পেয়েছেন, এখন ইনি ম্যানচেস্টার শিপ ক্যানাল তৈরির যে বিরাট মাপের প্রোজেক্ট, সেখানে যুক্ত আছেন সার্জন-সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে। সেখানকার কর্মীদের হাড়ের চিকিৎসা করেন। কিন্তু এই ধরনের চিকিৎসায় আধুনিক ব্যবস্থার বড় অভাব, হাড় ভেঙে গেলে এখনও যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা পেতে হয় মানুষকে। কী করে এই অবস্থার উন্নতি করা যায়, চিকিৎসাকে আরও কম যন্ত্রণাদায়ক করে তোলা যায়, এটাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান এখন।
ওদিকে ১৮৯৫ সালের নভেম্বরের ন-তারিখে গোটা বিশ্ব চমকিত হয়ে জেনেছিল যে পাওয়া গিয়েছে এমন এক ধরনের অদৃশ্য রশ্মি; যা ভেদ করতে পারে মানুষের দেহ, অথচ পারে না হাড় ফুঁড়ে যেতে। জার্মানির ইঞ্জিনিয়ার এবং উর্জবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলহেল্ম রয়েন্টগেন তার পরীক্ষাগারে কাজ করার সময় আকস্মিকভাবে দেখতে পান যে এই অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে তোলা যায় হাড়ের ছবি। বউয়ের হাত রেখেছিলেন রশ্মির সামনে, দেখা গিয়েছে যেন এক কঙ্কালের হাত, আর সেই হাতে আবার আংটি পরানো!
তবে এক্স রশ্মি আসলে কী, তা তখন কারও না জানা থাকলেও এই রশ্মি যে চিকিৎসার কাজে লাগতে পারে, তা বুঝেছিলেন কয়েকজন। এঁদের একজন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক অলিভার লজ। তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষাগারে তৈরি করেছিলেন এক্স রশ্মি। শুধু ইনি একাই নন, গোটা ব্রিটেন জুড়ে একাধিক জায়গায় বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন যে হ্যাঁ সত্যিই তৈরি হচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তিশালী রশ্মি। যেদিনে রয়েন্টগেন ওই পরীক্ষাটি করেছিলেন, নভেম্বরের সেই আট তারিখকে পরে ‘ওয়ার্ল্ড রেডিওগ্রাফি ডে’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে রবার্ট জোনস-ই প্রথম, যিনি এই রশ্মির সাহায্যে হাড়ের ছবি তুলে ব্যাপারটাকে যে চিকিৎসাবিদ্যায় অসাধারণভাবে কাজে লাগান যায়, সেটা সফলভাবে প্রমাণ করেছিলেন। তিনি এই যন্ত্রকে চালানোর জন্য আরও একজন ডাক্তার চার্লস হল্যান্ড-কে নিযুক্ত করেছিলেন। লিভারপুলের রয়াল সাদার্ন হাসপাতালে গড়ে ওঠা এই এক্স রশ্মি বিভাগটি সম্ভবত বিশ্বের প্রথম এই ধরনের চিকিৎসা-কেন্দ্র।
হ্যাঁ, বলাই বাহুল্য যে সেদিন ওই বালকটির হাতের ছবি তোলা গিয়েছিল বিনা ঝঞ্ঝাটেই, এবং বুলেটের অবস্থানও জানা গিয়েছিল সহজে। প্রথম পরীক্ষায় সাফল্য পেয়ে এরপর ১৮৯৬ সালের গোড়াতেই জোনস তাঁর এই চিকিৎসার ফলাফল লিখে ফেললেন একটি পেপারের আকারে। সেটা প্রকাশিত হল বিখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এর ওই বছরের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। সবাই এবার নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ এক্স রশ্মি হাড়ের ছবি তুলতে অব্যর্থ। এরপর আস্তে-আস্তে প্রয়োগ শুরু হল এর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জোনস ব্রিটিশ সেনাবাহিনির সঙ্গেই যুক্ত থেকেছিলেন আর্মি মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে। তাঁর প্রচেষ্টায় আর উদ্যোগে আর এক্স রশ্মির কল্যাণে কত আহত সৈন্যের যে ক্ষতের চিকিৎসা হয়েছিল, ইয়ত্তা নেই তার। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, এরকম বহু দেশ থেকে ডাক্তারেরা আসতেন তার কাছে, প্রশিক্ষণ নিতে। পরে এই বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন প্রামাণ্য বইও। হাড়ের চিকিৎসায় রবার্ট জোনস বিশ শতকের প্রথম তিনটি দশক বলতে গেলে একাই রাজত্ব করে গিয়েছেন।
এক আকস্মিক ঘটনা থেকে আবিষ্কার হয়েছিল যে অদৃশ্য রশ্মির, সেটাই বদলে দিয়েছে হাড়ের চিকিৎসার গোটা বিষয়টাকে। আর এই বদলে একা রবার্ট জোনস-এর অবদান সবচেয়ে বেশি। সাধে তো আর তাঁকে ‘ফাদার অব মডার্ন অর্থোপেডিকস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি!
…………………………