শিলালিপি: আরও এক নারায়ণী কলম
বেঙ্গল পাবলিশার্স (প্রাঃ) লিমিটেড
কিছু গল্প থাকে, যেগুলো ঘটনাকেন্দ্রিক। যা ঘটছে সেটার সাধারণ বর্ণনা থাকে। কিন্তু কিছু গল্প থাকে যেখানে গল্পের চেয়ে বেশি থাকে লেখকের চিন্তা, পারিপার্শ্বিক বর্ণনা, এবং মানুষের মনের গলিঘুঁজির চোরাগোপ্তা খবর। শিলালিপি হলো দ্বিতীয় শ্রেণীর গল্প। এটা একটা ছোট্ট ছেলের (রঞ্জু)- বড় - (রঞ্জন) হয়ে ওঠার গল্প। খরগোশ শিকার করতে যাওয়া থেকে শুরু করে, গান্ধিবাদী দর্শনে মেতে ওঠা থেকে শেষে ক্ষুদিরামের মতো 'নিহিলিস্ট' হয়ে যাওয়ার গল্প।
ছোট্ট একটা গ্রামের ছেলে রঞ্জুর চোখ দিয়ে গ্রাম এবং পারিপার্শ্বিক বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক গড়ে তুলেছেন এক অপূর্ব ঐশ্বর্যমণ্ডিত ঐতিহ্য। গল্পের বর্ণনা একদমই কল্পনার পক্ষবিস্তার নয়, বরং মেধা ও অনুভুতির আনন্দঘন মিলনের পরিণাম। প্রথম পাতা থেকেই রঞ্জু নিজের বিচার ও অনুভূতির বর্ণনা দিয়ে গেছে, পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলেছে গল্পের গাড়ি। ছোট্ট শিশুর সামনে অনাস্বাদিত পৃথিবীর মোড়ক পরতে পরতে খুলছে, আর সেই প্রত্যেক পরতের ঘ্রাণ নেয়ার বিপুল কৌতূহল ওকে বয়ে নিয়ে যায় জীবনের পথে। কিছু বিশেষ ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে ওর জীবনের শিলালিপিতে যে গভীর আঁচড় পরে তাতে তার জীবনের মোড় ও স্বপ্ন ঘুরে যায়। লেখক সব জায়গায় ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা দেয় না, বরং বাকি অর্ধেকটা আমরা রঞ্জুর চিন্তা ও বিশ্লেষণে দেখতে পাই। তাতে গল্পের খেই একটুও হারায় না। এত সুন্দর নির্মেদ লেখা যে পাত্র কখন গ্রামে বসে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে বেমালুম স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনের জন্য বুলেট চুরি করতে চলে আসবে তা যেন আপনি বুঝতেই পারবেন না।
"পদ্মা। গভীর, গম্ভীর। কর্গাধার জলতরঙ্গ। নিজের রক্তের সঙ্গে তার সংযোগ আছে। হৃদপিণ্ডের মধ্যে পদ্মার কলধ্বনি শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোড় ঘনিয়ে আসে চেতনায়। আর তখন, ঠিক তখনই সলাবনের নীচে হটাৎ কে যেন হেঁসে ওঠে খলখল শব্দে। একটি ছোট্ট নদী- তার নাম আত্রাই।
শিশির-ঝরা কোনো এক আশ্চর্য সকালে সে চোখ মেলেছিলো। চোখ মেলেছিলো পদ্মের একটা কুঁড়ির মতো। কিন্তু তখন কি জানতো অগ্নিকমল হয়ে ফুটে উঠবে তার সেই দৃষ্টি। শিশির-ঝরা সকালে পথ হারিয়ে ফেলবে মৃত একটা আগ্নেয়গিরির চড়াই উৎরাইয়ে?" (শিলালিপি - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়)
অবাক লাগে ইনি 'টেনিদা' লিখেছেন আবার 'টোপ'-ও লিখেছেন। এই উপন্যাসে কিন্তু একদমই সত্য ঘটনার উপর অবাস্তবের মনোহর প্রলেপ প্রয়োগ হয়নি। মনের ভেতরে চলা আদর্শের টানাপোড়েন, ভালোবাসা, আবেগ, হিংসা, ভেঙে পড়া- এই সব অভিব্যক্তির খুব অদ্ভুত মিশ্রণ আমরা চরিত্রের মধ্যে দেখতে পাই। প্রত্যেক পৃষ্ঠা যেন একটি একটি পর্দা সরিয়ে নিয়ে গেছে আরও গভীর, আরও নিবিড় ভাবে চরিত্রের চেতনায়। কেউ বলে না দিলেও এই বই যে ক্লাসিক সেটা পাঠক পড়া মাত্রই বুঝতে পারবে। এত সহজ ভাষা প্রয়োগে এত দুর্বোধ্য ইমোশন লেখক কী করে ফুটিয়ে তুললেন সেটা পাঠককে বিস্মিত করতে বাধ্য। এতে লুকিয়ে আছে এক মানুষের স্বপ্ন, আর তার অনিশ্চিত ভালোবাসার আখ্যান।