ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণ কাহিনি ‘রামায়ণ কাকাবিন’
রামায়ণের মতো মহাকাব্য আসলে নিছক গল্পকথা না। তার কাহিনিপ্রবাহে আসলে একটি গোটা জাতির আত্মা বাঙ্ময় হয়েছে। সেই কারণেই নানাবিধ পাঠ তৈরি হয়েছে রামকথার। নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই কাহিনি রূপ পেয়েছে। যে মনন বা দৃষ্টি নিয়ে বাল্মীকি রচনা করেছিলেন এই রামায়ণকথা, পরবর্তীকালে ভিন্নতর মানসিকতা বা বিচার নিয়ে নির্মিত হয়েছে আরও অসংখ্য রামায়ণ-আখ্যান। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে রামায়ণ কাহিনির বিভিন্ন রূপ প্রচলিত। মূল কাহিনিসূত্র অনেকাংশে এক হলেও তাদের মধ্যে পার্থক্যও কম নয়। বিশেষত উত্তর ভারতীয় রামায়ণগুলির সঙ্গে তামিল, তেলুগু, কন্নড় বা মালয়ালি রামায়ণের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য অনেকটাই। তবে শুধু ভারতবর্ষে নয়, তার বাইরেও অনেক দেশে রামকথার নিজস্ব সংস্করণ পাওয়া গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ-সঞ্জাত এই মহা-আখ্যান আসলে পরিভ্রমণ করেছে গোটা এশিয়া জুড়ে। জাপান, মায়ানমার, নেপাল, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া ইত্যাদি দেশে পাওয়া গেছে তাদের নিজস্ব রামায়ণকথা। বহির্ভারতের এই রামায়ণ-কাহিনিগুলির মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ‘রামায়ণ কাকাবিন’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ-প্রদেশ জাভা প্রাচীনকালে যবদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। যবদ্বীপের প্রাচীন সাহিত্যধারায় ছন্দোবদ্ধ কাব্যকে ‘কাকাবিন’ (kakawin) বলা হত। রামায়ণ কাকাবিনের রচয়িতা যোগীশ্বর। অবশ্য এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে যিনিই রচনা করে থাকুন, তিনি বাল্মীকি রামায়ণ অনুসরণ করেননি, অনুসরণ করেছিলেন ভট্টিকাব্য। বিশিষ্ট রামায়ণ গবেষক ড. বাল্কের মতে, ভট্টিকাব্যের শৈব পরিমণ্ডল তাঁর রুচির অনুকূল ছিল বলে যোগীশ্বর এই কাব্যকে অনুসরণ করে তাঁর রামায়ণকাহিনি রচনা করেছিলেন। আসলে ইন্দোনেশিয়ায় বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সভ্যতার হাত ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ ও শৈব ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের অসংখ্য মন্দির আজও এই দেশে রয়েছে। ভারতীয়দের সৌজন্যে আমদানি হওয়া রামায়ণকথাও এদেশের সংস্কৃতিতে মিলেমিশে গেছে বহুকাল আগে থেকেই। বরবুদুরের শৈলেন্দ্র রাজাদের তৈরি করা প্রাম্বাননের শিবমন্দিরের গায়ে খোদাই করা রামায়ণকাহিনি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন - অযোনি : একটি রূপকথার অপমৃত্যুর গল্প / জুঁই নিয়োগী
ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ কাহিনি শুধুমাত্র লোকশ্রুতি বা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি; নাটকে, নৃত্যশিল্পে, চিত্রকলায় বা মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্যে এই কাহিনি দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত ছিল। রামায়ণ কাকাবিন সেই ধারারই অঙ্গ। যোগীশ্বর রাজা দশরথকে বেদজ্ঞ ও শৈবধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যেজেতু ভট্টিকাব্য মূলত বাল্মীকি রামায়ণকে অনুসরণ করে রচিত, তাই যোগীশ্বরের কাব্যের সঙ্গে বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে তেমন মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু একটি জায়গায়। ভট্টিকাব্যের মতো এই কাব্যও রাম-সীতার মিলনে শেষ হয়েছে। উত্তরকাণ্ডের কাহিনি বাদ গেছে। যবদ্বীপের ভাষায় রচিত হলেও মালিনী, রুচিরা, শিখরিণীর মতো কিছু সংস্কৃত ছন্দ যোগীশ্বর প্রয়োগ করেছিলেন। পণ্ডিতেরা তাঁর ছন্দকুশলতার প্রশংসা করেছেন। ‘দ্বীপময় ভারতের প্রাচীন সাহিত্য’ বইয়ে ড. হিমাংশুভূষণ সরকার মন্তব্য করেছেন - “রচনাশৈলী এবং ভাবের দিক দিয়া সমগ্র গ্রন্থটিই যেন ভারতীয় বলিয়া মনে হয়।”
.........................................
[ঋণ : রামায়ণের বিশ্বায়ন / সুধীরকুমার করণ]
#ramayana #রামায়ণ #রাম #ইন্দোনেশিয়া #জাভা #যবদ্বীপ #বাল্মীকি #যোগীশ্বর #ভট্টিকাব্য #Indonesia #Java #ফিচার #Feature #বিশ্বসাহিত্য #টিম সিলি পয়েন্ট