ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

India’s Daughter: একটি ছেঁটে ফেলা সত্য

সায়নদীপ গুপ্ত Oct 14, 2020 at 6:02 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

তথ্যচিত্র : ইন্ডিয়া’জ ডটার
পরিচালনা ও প্রযোজনা : লেসলি উডউইন
পরিবেশক : বিবিসি

২০১৫ সাল, মার্চ মাস। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আপত্তিতে ভারতে এই তথ্যচিত্রটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়।
২০২০ সাল, অক্টোবর মাস। নিষেধাজ্ঞা পুরোমাত্রায় জারি আছে।

এটুকু নান্দীমুখ নিয়ে দেখা শুরু করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সমাজের পচাগলা শবদেহটার উপর থেকে কারুকার্য করা সার্কোফেগাসের ঢাকনা সরাতে রাষ্ট্রের কতটা আপত্তি। মেনে নিতে সমস্যা হয় না, দিল্লি-কামদুনি-পার্ক স্ট্রিট-তেলেঙ্গানা-হাথরস – জায়গা ভেদে মেয়েদের যোনিপথে বারবার অনুপ্রবেশ করে, কোনো পুরুষাঙ্গ নয়, আমাদের সমষ্টিগত সমাজভাবনা। দেশ কাঁপানো নির্ভয়া মামলার নিরিখে তৈরি এই তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে সে ধারণা আরও পোক্ত হয়। পরিচালক লেসলি, বিবিসি ফোর চ্যানেলের সহযোগিতায়, এই নারকীয় ঘটনার পুনর্নির্মাণে অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতার মূল ভাবটিকে মাথায় রেখেই এগিয়েছেন। যতটুকু ঘটনা, ততটুকুই বর্ণনা – একদাগও এদিক-ওদিক নয়। ফলত, নতুন কিছুই হয়তো দেওয়ার নেই এখানে। কোনো অজানা তথ্যের ঝলক বা থ্রিলারের মোড়ক, সবই অনুপস্থিত। তবে দেওয়ার মতো লজ্জা আছে কিছু, গলার কাছে পিত্ত উঠে আসা লজ্জা। 

আরও পড়ুন : ‘কী জ্বলছে?’-র পাশেই রাখা থাক প্রশ্ন ‘কে জ্বালিয়েছে?’ / সরোজ দরবার

দক্ষিণ দিল্লির নিম্নবিত্ত পরিবারের আদরের জ্যোতি থেকে সারা দেশের কান্নাগেলা নির্ভয়া হয়ে ওঠার এই কাহিনি আমাদের পরিচিত। লেসলির ক্যামেরায় জ্যোতির মা, বাবা, গৃহশিক্ষক সবার বক্তব্যে স্পষ্ট হতে থাকে তাঁর হার-না-মানা সংকল্প, নিজের শিক্ষার ডানায় ভর দিয়ে স্বপ্নের উড়ান দেওয়ার সুতীব্র বাসনা। এরপরেই সামনে আসে অন্যতম অভিযুক্ত মুকেশ সিং, জানায় - “ধর্ষিত হওয়ার দায় তো মেয়েদেরই বেশি... মেয়ে সুশীল হলে, সন্ধের পর ঘরের বাইরে থাকারই কথা না...”। এটুকুই করেছেন লেসলি। এই ধাক্কাটাই দিয়েছেন গোটা তথ্যচিত্র জুড়ে, জায়গায় জায়গায়। একদিকে যেমন পরিচিত সহযোদ্ধাদের মুখে জ্যোতি থেকে নির্ভয়া হওয়ার গল্প দানা বাঁধে, অন্যদিকে মুকেশের জবানিতে, ভারতের যে কোনো সাধারণ পরিবারের সাধারণ একটি মেয়ে থেকে মুনিরকার রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া এক মাংসপিণ্ডে পরিণত হওয়ার বিবরণ ধীরে ধীরে চেপে বসে। ধর্ষক, ধর্ষকদের আইনজীবী এম.এল শর্মা, এ.পি সিং – এদের সবার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে পাশবিকতার এক নিরুত্তাপ বিনির্মাণ স্পষ্ট রূপ পেতে থাকে। এক আইনজীবীর মতে, মেয়েরা ফুলের মতো কোমল; ফুলকে চার-দেওয়াল ঘেরা মন্দিরে না রেখে খোলা রাস্তার আস্তাকুঁড়ে একা ছেড়ে দিলে, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। অন্যজন, সাকেত জেলা আদালতের রায় ঘোষণার পর সদম্ভে বলেছিলেন, “আমার পরিবারের মেয়ে এমন বেচাল হলে তাকে ফার্ম হাউসে সবার সামনে পেট্রোল ঢেলে পোড়াতাম”। লেসলির ক্যামেরার সামনেও সেই গর্ব এতটুকু টসকায়নি। 

আমাদের সাধের সনাতন গৌরব। আমাদের বেদজ্ঞানের ঐতিহ্য। আমাদের সাত দশকের স্কুলশিক্ষার বাস্তব। 

এরপরে যখন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি লীলা শেঠ বলেন, একমাত্র শিক্ষার আলোই পারে ছেলে-মেয়ের বৈষম্য ভাবনা দূর করতে, সেই দৃঢ়তায় ভরসা রাখতে ভয় হয়। কোন শিক্ষার কথা বলছি আমরা? কোন স্কুলে শেখানো হয় সেই পাঠ? এই আইনজীবীরা, হাথরসের সাংবাদিক সম্মেলনে দাঁড়ানো পুলিশ আধিকারিকরা, “মেয়েরা গায়ে ট্যাটু করালে ছেলেরা তো হাত দেবেই” ভাবা অভিভাবকরা কি পড়েননি সেই স্কুলে? সমাজ, দেশ তো তৈরি হয়েছে এদের নিয়েই। তাই অবাক লাগে না, আজ যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতি বা ধর্মের বিরুদ্ধ মত জানালেই অবলীলাক্রমে ধেয়ে আসে যৌন অত্যাচারের গ্রাফিক হুমকি। অবাক লাগে না, যখন নির্ভয়ার সমর্থনে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষের নিরীহ পদযাত্রার উপর রাষ্ট্রের অনর্থক টিয়ার গ্যাসের শেল আছড়ে পড়ে মুহূর্মুহু। এই রাষ্ট্রও তো একদিনে গড়ে ওঠেনি; তিল তিল করে গাঁথা প্রতিটি ইটে সযত্নে খোদাই করা হয়েছে জাতের দোহাই দিয়ে শরীর ভোগ করা রাজনীতিবিদ, “লড়কে তো লড়কে হোতে হ্যায়” মনে করা সাংসদ, অগণিত খাপ পঞ্চায়েত আর সালিশি সভার মোড়লদের নাম। তাই সরকার বদলায়, তবু স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের উপর জলকামান দাগার ছবি বদলায় না। 

তথ্যচিত্রের নির্মাণে একটিও উত্তেজক দৃশ্য না দেখিয়ে, শুধুমাত্র শব্দের ঝাঁকুনিতে বীভৎসতার বাস্তব বুনে চলেন লেসলি উডউইন। কী অসম্ভব নির্লিপ্তি নিয়ে মুকেশ জানায়, সব কাজ শেষ হওয়ার পরে সেই নাবালক বলেছিল, “আমি ওইটা কাপড়ে জড়িয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছি”। ওইটা? জ্যোতির ভিতর থেকে লোহার ডান্ডাটা বের করে আনার সময় বেরিয়ে আসা নাড়িভুঁড়ির অংশটা। হাসপাতালের ডাক্তার জানান, শরীরে অগুণতি অনিরমেয় ক্ষত নিয়ে কীভাবে সেই মেয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে বিবরণ দিয়ে গেছে গোটা ঘটনার। নাবালক অপরাধী ও ধর্ষিতদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, ঝাঁ চকচকে ফ্লাইওভারের নিচে থাকা, ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষের জীবনযাপনের ধরন, যেখানে প্রতিনিয়ত অন্ধকারের স্বাদ নিচ্ছে কৈশোর। মুকেশ বলে, “এসব শুধু সঠিক শিক্ষা দেওয়ার জন্যই... দাদা (রাম সিং) তো বোঝাতে চেয়েছিল, এত রাতে একটা ছেলের সঙ্গে মেয়েটার বেরোনো ঠিক হয়নি... শুধু রেপ করলেই লজ্জায় ঠিক পথে চলে আসত, নেহাত বাধা দিল তাই...”। শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায় যযাতি কন্যা মাধবীর কথা, বাবার দানধর্মের গৌরব রক্ষার্থে যাঁকে বারবার একাধিক পুরুষের হাতে নিজেকে সঁপে দিতে হয়েছিল। না না, মহাভারতকার পিতার লজ্জার তিলমাত্র জায়গা রাখেননি। মাধবী যে অক্ষত যোনি! প্রতিবার সম্ভোগ শেষে তাঁর কুমারীত্ব ফিরে আসে! ভারতের মেয়েমানুষ তো মানুষ নয় আসলে, একটা পরিপাটি নিষ্কলুষ যৌনাঙ্গ মাত্র। ভয়, ঘেন্না, শ্রদ্ধা, লজ্জা – সব বোধ একসময় তালগোল পাকিয়ে নির্ভয়ার ছেঁড়া অন্ত্রের মতো কোনো এক হাইওয়ের ধারে পড়ে থাকে। 

এই ছবিকে ঘিরে বিতর্কও কম নেই। Peabody Awards, United Nations Association Film Festival-এর মতো একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতলেও, এর বিরুদ্ধে মুকেশের পরিবারকে প্রচুর টাকা দিয়ে তার সাক্ষাৎকার কেনার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে নিয়মমাফিক অনুমতি না নিয়েই অভিযুক্তের সাক্ষাৎকার নেওয়ার, যদিও লেসলি তা প্রমাণসহ খারিজ করেছেন। বহু সমাজকর্মীর মতে, ঘটনার একদর্শী বর্ণনায় লেসলি অনেকাংশেই নারীর অধিকারের লড়াইতে সামিল পুরুষদের ভূমিকা এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তথ্যচিত্র মাত্রেই প্রাথমিকভাবে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ। শিল্পের মতো, নান্দনিকতা বা রুচিশীলতার প্রতি তার কোনো দায় নেই। এক সত্যের উন্মোচন মানেই অন্য সত্যের উপর কাদা লেপে দেওয়া নয়, বরং সত্যের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখানো। যে প্রশ্ন জ্যোতির বাবার অবিচল ভাষ্যে বয়ান পায়, “আজকের সমাজে ‘মেয়ে’ শব্দটার জায়গা কোথায়?”

উত্তরটা সম্ভবত আইনজীবী এম.এল শর্মা আগেই বলে দিয়েছেন, “We have the best culture. In our culture, there is no place for a woman”। 


[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

#India’s Daughter #ডকুমেন্টরি # documentary film # Leslee Udwin # BBC #2012 Delhi gang rape #Nirbhaya #Jyoti Singh #Stop Rape #Say No to RAPE #Feminism #Protest #লিঙ্গসাম্য #নারীপক্ষ #নারী #ফিল্ম রিভিউ #review #banned film #প্রতিবাদ #silly পয়েন্ট #সায়নদীপ গুপ্ত

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

7

Unique Visitors

219110