ভারতের ‘প্লাস্টিক ম্যান’ রাজাগোপালন বাসুদেবন
সহজ থেকে সহজতর জীবন খুঁজতে খুঁজতে আমরা কখন জটিলতর সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়ি তা বুঝে ওঠার সময় পর্যন্ত পাইনা। যখন বুঝতে পারি, ততক্ষনে ক্ষতি হয়ে গেছে অনেকটা। ধুঁকতে থাকা পৃথিবীর অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। কিন্তু টনক নড়লে তখন কি আমরাও নড়ে বসি? নাকি নিজেদের সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতে বিন্দুমাত্র কমতি না পড়ে এই ভেবে পাশ ফিরে শুই? হ্যাঁ, দ্বিতীয়টাই প্রমাণিত সত্য। আর এই স্বাচ্ছন্দ্য-দানকারী উপাদানটি হলো প্লাস্টিক, আমাদের রোজকার জীবন যাকে ছাড়া প্রায় অভাবনীয় হয়ে পড়েছে।
পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে সমুদ্রের প্রতি বর্গ মাইল, প্রায় ৪৬,০০০ ভাসমান প্লাস্টিকের টুকরো বহন করে। দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম মনে করছে বর্তমান এই অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের থেকে প্লাস্টিকের সংখ্যা বেশি হয়ে দাঁড়াবে; এই প্লাস্টিক দূষণের প্রায় ৬০% অবদান আমাদের দেশ ভারতেরই। প্রতিবছর ভারত প্রায় ৫৬,০০,০০০ প্লাস্টিক বর্জন করে। NGT (National Green Tribunal)-এর নির্দেশ অনুযায়ী ২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে ডিসপোজাল প্লাস্টিক গ্লাসের ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সে নিয়ম লেখা থাকে কেবল খাতার পাতাতেই। এছাড়াও সমীক্ষা করে দেখা গেছে এর ফলে পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে ঠিকই, আবার তেমনই এই প্লাস্টিক থেকে উৎপন্ন নানা দ্রব্যের উপর নির্ভর করে থাকা বহু দরিদ্র মানুষের আর্থিক দিকটি প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই সন্ধান চলতে থাকে কোন বিকল্প পদ্ধতির। ধ্বংস ও সৃষ্টি চিরকালই পাশাপাশি হাঁটে। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়না তার। সুমেরুর বরফ গলে কুঁজো হয়ে যাওয়া পৃথিবীর অসুখ সারিয়ে সুস্থভাবে হাঁটার জন্য রাস্তা তৈরি করতে থাকে ‘প্লাস্টিক ম্যান’, রাজাগোপালান বাসুদেভান।
তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরের অধ্যাপক রাজাগোপালান বাসুদেভান এক অবিশ্বাস্য বিকল্প পদ্ধতি আমাদের সামনে আনেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে কীভাবে সড়ক পথ নির্মাণ করা যায়। তাঁর মতে “প্লাস্টিক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জীবনধারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার প্লাস্টিক পোড়ালে বা মাটি চাপা দিলে পরিবেশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে”। সুতরাং একটি বিকল্প পদ্ধতির কথা অনেকদিন ধরেই তাঁকে ভাবাচ্ছিল। কিন্তু কে এই প্লাস্টিক ম্যান? ১৯৬৭ সালে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে MSc পাস করে, সেখানেই ১৯৭৪ সালে তিনি তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট। বর্তমানে তিনি তামিলনাড়ুর থিয়াগ রাজরান কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
আরও পড়ুন : অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্র : হারম্যান ডালির তত্ত্ব
২০০১ সাল থেকেই প্লাস্টিক বর্জ্যের বিকল্প ভাবনা তাঁকে ভাবায়। এ বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করেন তিনি। তার ফলবশত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সড়ক নির্মাণ পদ্ধতিটির ভাবনাই তাড়িত করে তাঁকে। সর্বপ্রথম তাঁর নিজের কলেজেই এই ভাবনার কথা জানালেও সেই সময় তেমন সাড়া মেলে না। পরবর্তীকালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. এ.পি.জে. আবদুল কালাম কলেজ পরিদর্শনের সময় এ বিষয়ে জানতে পারেন এবং বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করে রাজাগোপালান বাসুদেভানকে কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ধূসর রঙের রাস্তা নির্মাণ করতে উৎসাহিত করেন। ২০২০ সালে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি ৬০ ফিট দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করেন যা আজও অক্ষত আছে। বিটুমিন নামক এক প্রকার হাইড্রোকার্বন আর নুড়ি পাথরের মিশ্রণ এই রাস্তা তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে এই উপাদানসমূহের সঙ্গে গলিত প্লাস্টিক মেশালে তা অনেক বেশি উন্নত হয়। বিটুমিন-মডিফাইড প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে সড়কের ঘাত বহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ২০০৪ সালে বিষয়টি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয় এবং তিনি এই উদ্ভাবনী সৃষ্টিতে এতটাই উৎসাহিত হন যে ১০০০ কিলোমিটার রাস্তাকে প্লাস্টিক রোডে রূপান্তরিত করার জন্য অনুমোদন দেন প্লাস্টিক ম্যানকে। ২০০৬ সালে এই পদ্ধতিটির জন্য বাসুদেভন পেটেন্ট পান।
আরও পড়ুন : হিরাকুদ বাঁধ ও বাঁধ-বিরোধী আন্দোলন : উন্নয়নের ও-পিঠের গল্প
এটা প্রমাণিত যে এই পদ্ধতিতে একাধারে যেমন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সময় অনেক কম লাগবে তেমনই অপরদিকে প্লাস্টিক দূষণের মতো ভয়ংকর অভিশাপের হাত থেকে মুক্তি পাবে পরিবেশও। এখনও পর্যন্ত ভারতের প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার সড়ক এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও এই সড়কপথের গুণগত মান যথেষ্ট উন্নত। প্রথম পাঁচ বছর কোন ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় নেই, এমনকি অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেও ফাটল ধরার কোন সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। জাসকোর প্রতিবেদনে দেখানো হচ্ছে যে প্রতি ১ X ৪ বর্গ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের ফলে ভারতীয় অর্থের প্রায় ৫০,০০০ টাকা সাশ্রয় হয়। ভোকারভেসেলস নামক এক প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক ব্যাগ, চকলেটের প্যাকেট, জলের বোতল ইত্যাদি থেকে প্রায় ৫০ মাইক্রন প্লাস্টিকের টুকরো দিয়ে সড়কপথ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করেছে। জামশেদপুরে এই প্লাস্টিক বর্জ্য প্রয়োগ করে প্রায় ১২-১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথ নির্মাণ করেছে জাসকো। বর্তমানে ভারতের প্রায় ৫০,০০০ কিলোমিটারের বেশি সড়কে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে এবং সেইসঙ্গে ১১টি রাজ্যের সরকারি প্রক্রিয়ায় এই প্রযুক্তি গ্রহণ করা হয়েছে।
সময় এসে গেছে। অস্তিত্ব বাঁচাতে এমনভাবেই চলছে বিকল্পের সন্ধান। ‘প্লাস্টিক ম্যান’ সেই পথেরই একজন অগ্রপথিক।
#Plastic man of India #Rajagopalan Vasudevan #Indian scientist #waste management #Reuse #Recycle #Plastic Recycle #Eco Friendly Living #Technology #Sustainable Development #বিকল্প #প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার #প্লাস্টিকের রাস্তা #পুনর্ব্যবহার #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট