পরিবেশ ও প্রাণচক্র

হিরাকুদ বাঁধ ও বাঁধ-বিরোধী আন্দোলন : উন্নয়নের ও-পিঠের গল্প

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় Sep 23, 2020 at 4:33 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

ওড়িশা রাজ্যের সম্বলপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে মহানদীর উপরে বিখ্যাত হিরাকুদ বাঁধ। স্বাধীন ভারতে প্রথম যে বহুমুখী নদী-উপত্যকা প্রকল্পগুলি তৈরি হয়, হিরাকুদ বাঁধ তারই মধ্যে অন্যতম। মহানদী বদ্বীপ অঞ্চল বরাবর বন্যাপ্রবণ। মূলত প্রতি বছরের এই বন্যাপরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে এম. বিশ্বেশ্বরাইয়া এই বাঁধ তৈরির প্রস্তাব দেন। ১৯৩৬ সালে ওড়িশায় ভয়াবহ যে বন্যা হয়েছিল, তার আগেই তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সেই বন্যার পর সরকার এই নিয়ে কোনো ভিন্নমতের জায়গা রাখতে চায়নি। এই বাঁধ নির্মাণের ‘মেগা’ প্রকল্পের পিছনে বন্যা আটকানো ছাড়াও বাঁধের বহুমুখী উপযোগিতার কথা বলা হয়েছিল; যেমন, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ-চলাচল ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই অঞ্চলের একটি বিশেষ স্থানিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। মহানদীর উপরের অংশে ছত্তিশগড়ের সমভূমি অঞ্চলে অধিকাংশ সময়েই খরার প্রকোপ, কিন্তু নিচের অববাহিকার ব-দ্বীপ অঞ্চলে আবার বেশিরভাগ সময়েই লেগে থাকে বন্যা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই স্থানে দেখা দেয় বন্যাজনিত নানা সমস্যা এবং ফসলের অপূরণীয় ক্ষতি। এমনই এক পরস্পর-বিপরীতধর্মী ক্ষতিকর পরিস্থিতিকে রোখার জন্য এই বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল মহানদীর স্বচ্ছন্দ প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ আনা, যাতে বন্যার প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং সেই সঙ্গে, বলাই বাহুল্য, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন।

৪.৮ কিমি (৩.০ মাইল) মূল দৈর্ঘ্যের এই বাঁধ তৈরির ফলে এর প্রধান ও প্রকৃত উদ্দেশ্য অনেকাংশেই চরিতার্থ হয়েছে। এটি প্রায় ১,৩৩,০৯০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জল নির্গমনে সাহায্য করছে এবং সেইসঙ্গে এই বাঁধ-প্রদত্ত সেচ দিয়ে সম্বলপুরের একটি বড় অংশে বিপুল পরিমাণে ধান চাষ সম্ভবপর হয়েছে। সেই কারণে ওড়িশার এই অঞ্চলকে ‘ধানের গোলা’ বলা হয়। পুরী ও কটক অঞ্চলের বদ্বীপ এলাকায় ৯,৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে বন্যা থেকে রক্ষা করে চলেছে এই বাঁধ। এছাড়াও এই হিরাকুদ বাঁধের একপ্রান্তে বুরলা ও চিপ্লিমায় অবস্থিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ৩০৭.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়া সম্ভব। সেইসঙ্গে হিরাকুদ বাঁধ থেকে প্রাপ্ত জলের একটি অংশ বরাদ্দ করা হয় ঝাড়সুগদা ও সম্বলপুর জেলার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় প্রবল বিরোধিতা।

ভারতে বড় বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের ইতিহাস অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই শুরু। বহুসংখ্যক দরিদ্র মানুষের উচ্ছেদ হওয়া, বহুদিনের জীবিকা হারানো এবং সর্বোপরি নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার মতো ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক আগে থেকেই দানা বাঁধতে থাকে নানা গণ-প্রতিরোধ ও পরিবেশ-আন্দোলনের বীজ। ভারতে বাঁধ নির্মাণের মেগা প্রকল্পের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়ার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন হয় ১৯২৭ সালে পশ্চিম ভারতের তৎকালীন বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে, মুলশি বাঁধ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সময়ে। হিরাকুদ বাঁধের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের আন্দোলনের ঝাঁঝ তাকেও ছাপিয়ে গেছিল। প্রায় তিরিশ হাজারের বেশি কৃষক বাঁধের পাশে আশ্রয় নিয়ে শিল্পের জন্যে এই জল-বরাদ্দকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ওই অঞ্চলে শিল্পস্থাপন স্থানীয় মানুষের প্রকৃত অর্থে কোনো কাজেই আসবেনা। উপরন্তু তা সুবিধা করে দেবে শিল্পপতি ও ধনী সম্প্রদায়েরই। সেইসঙ্গে ৩১০টি উর্বর গ্রাম নষ্ট হবে। কৃষকদের এই প্রতিবাদের সূত্রেই আরও কিছু গভীরতর সমস্যা ধীরে ধীরে আমাদের সামনে আসতে থাকে। মহীশূরের চিফ এঞ্জিনিয়ার এম.জি. রঙ্গাইয়া এই বাঁধ নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং হিরাকুদ বাঁধের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তোলেন। দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে রঙ্গাইয়া মূলত দুটি যুক্তি তুলে ধরেন - ১) যেহেতু এখানে পর্যাপ্ত জলের জোগান দেওয়ার মতো কোনো প্রাকৃতিক জলধারা নেই, সেহেতু এই বাঁধ থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ হবে, ২) এই বাঁধ নির্মাণের ফলে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ গৃহহীন হবে, তার একটা বড় প্রভাব দেখা দেবে সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক দিয়ে। দারিদ্র্যের প্রাবল্য বিপুল হারে বাড়তে থাকবে। ওড়িশার উপমন্ত্রী ভরত নায়ক এক বিরাট জনসভায় হিরাকুদ বাঁধের বিরোধিতা করে উচ্ছেদ হতে চলা মানুষদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এছাড়াও সাধারণ মানুষ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বক্তব্য ছিল, এত আয়োজন আসলে শিল্পোন্নয়নের জন্যই, অথচ সেই শিল্পোন্নয়ন স্থানীয় মানুষের কোনও কাজেই লাগবে না, বরং শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সকে আরও মোটাসোটা করবে। ১৯৪৭ সালে দামোদরণ পূজারী এবং তাঁর স্ত্রীর নেতৃত্বে সম্বলপুরে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু আন্দোলন শুরুর তিনদিনের মধ্যেই নেতৃবৃন্দদের গ্রেপ্তার করা হয়; সাময়িক ভাবে ওড়িশার নানা স্থানে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। ফলে যে আশঙ্কা ছিল, আন্দোলনের পিছনে তাই ধীরে ধীরে স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। বাঁধের নির্মাণের ফলে প্রায় ১,৫০,০০০ মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার মধ্যেও মারাত্মক প্রভাব পড়ে ওড়িশার পশ্চিম অংশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের উপর। প্রায় ২২,০০০ আদিবাসী পরিবার গৃহহারা হয়। তাদের খবর আজও আমাদের অজানা।

পাশাপাশি হারিয়ে গেছে বহু মূল্যবান আঞ্চলিক ইতিহাসও। ১৯৫৭ সালে এই বাঁধটি সম্পন্ন হওয়ার পরে বাঁধ-সংলগ্ন একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু ঐতিহাসিক মন্দির তলিয়ে যায় জলের তলায়। ওই এলাকায় পদ্মপুর নামে একটি গ্রাম ছিল – সেই সময়ে ওড়িশার অন্যতম জনবহুল ও প্রাচীন গ্রাম। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসেবমতো এই গ্রামের বহুসংখ্যক প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে ২০০টিরও বেশি মন্দির ডুবে যায় জলের তলায়। আমরা চিরকালের মত হারিয়ে ফেলি ওড়িশার লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের একটা বড় অংশকে। একথা অনেকেরই জানা যে পঞ্চাশের দশকের বাঁধ তৈরির প্রকল্পের রূপান্তর ঘটে জওহরলাল নেহরুর হাত ধরেই। তিনিই এই প্রকল্পের নাম দিয়েছিলেন ‘Temple of Modern India’ বা ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’। কিন্তু এ কেমন মন্দির, যার জন্য গৃহহীন হতে হয় হাজার হাজার মানুষকে! বাঁধের কারণে আশ্রয় হারানো মানুষের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল একটিমাত্র স্তোকবাক্য – “If you are to suffer, you should suffer in the interest of the country”। মনে পড়ে যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন – “তুমি মানুষকে ভালোবাসো না, অথচ দেশকে ভালোবাসো কেন?”

নজরে থাকুক


অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্র : হারম্যান ডালির তত্ত্ব



আমাদের ইতিহাস চিরকালই প্রমাণ করে গেছে যে আধুনিকতা ও উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান পিলার হল বঞ্চনা। আর সেই বঞ্চিত মানুষেরা ইতিহাসের শুকনো পাতায় থাকে বটে, তবে কেবল কয়েকটা সংখ্যা হয়ে। সম্বলহীন মানুষেরা চিরকাল এইধরনের সর্বগ্রাসী উন্নয়নের আওতায় পড়ে গৃহহীনতা, বেকারত্ব, দারিদ্র্যের পরিসংখ্যানে কেবল সংখ্যার পিঠে সংখ্যা লিখে চলেছে দীর্ঘদিন ধরেই। এই উন্নয়ন কি প্রকৃত অর্থেই উন্নতি আনছে সমাজের? শুধুমাত্র বাঁধের ক্ষেত্রেই নয়, সমগ্র উন্নয়ন-প্রকল্পের খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয় সেই অর্থের প্রকৃত ব্যবহার কতটা হচ্ছে, এ প্রশ্ন আমাদের ভাবায়। কারণ বছর ঘুরতে না ঘুরতে শুরু হয়ে যায় মেরামতির কাজ। প্রায়শই মেরামতের প্রয়োজন কি আমাদের এটাই বুঝিয়ে দেয় না যে গোড়াতেই ছিল কোনো মস্ত বড় গলদ? ২০০৩ সালে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় রামচন্দ্র গুহ একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন, “Too many people had made too large a sacrifice for what was, in the end, not too great a benefit.”

পরবর্তীকালে নেহরু নিজেই বাঁধ-প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববর্তী বক্তব্য থেকে সরে এসেছিলেন। বলেছিলেন, এই বাঁধের মতো প্রকল্পগুলি হল আসলে ‘গগনচুম্বী পরিকল্পনার অসুখ’ বা ‘disease of gigantism’। হিরাকুদ বাঁধের ফলে অসংখ্য মানুষের তীব্র দারিদ্র্য, অসহায়তা, গৃহহীনতা থেকেই বোধহয় তাঁর এই উপলব্ধি। “We want to show that we can build big dams and do big things. This is a dangerous outlook developing in India…” – একথাও তাই উঠে এসেছে তাঁর মুখে।

কিন্তু এই আত্মোপলব্ধি কি ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই মানুষগুলোর ঘরবাড়ি? সেচের উন্নতিকল্পে কি কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছিল যাতে প্রকৃত অর্থেই উন্নতি হয় সেখানকার কৃষিজীবী মানুষদের? প্রশ্নগুলোর উত্তর আর খুঁজি না আমরা। প্রাথমিক মূল্যায়নে যা যা বলা হয়েছিল এবং বাস্তবে তা যে রূপ নিয়েছিল তার একটা আলোচনা করলে দেখা যাবে, তলা দিয়ে অনেক জলই গলেছে! বলা ছিল, এই বাঁধ তৈরির ফলে প্রায় ১৬৮টি গ্রামের ১,৩৫,০০০ একর জমি জলে ডুবে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, বাস্তবে ৩২৫টি গ্রামের ১,৮৩,০০০ একর জমি ডুবে গেছে, যার মধ্যে ১,২৩,০০০ একর জমি ছিল ফসলি জমি! যেসব কৃষক পরিবারকে ভিটেমাটি খোয়াতে হয়েছিল, তাদের জন্য সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করলেও, বলা বাহুল্য, তা ছিল নামমাত্র। বাস্তুচ্যুত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য যে ঘোষিত সরকারি ব্যবস্থা, তা আখেরে বাস্তবায়িত হয়েছিল মোট উচ্ছেদ হওয়া মানুষের মাত্র ৮.৪৬ শতাংশের ক্ষেত্রে। ১৯৭৯ সালের ২৯শে অক্টোবর হিরাকুদ বাঁধের ছবিসহ পোস্ট অফিস থেকে ৩০ পয়সার একটি স্ট্যাম্প মুক্তি পায়। বোধকরি, এটাই তবে সেই হাজারো গৃহহীন মানুষের আত্মোৎসর্গের পুরস্কার?



ঋণ : ১। ‘প্রতিবাদে প্রতিরোধে জনবিরোধী উন্নয়ন ও দূষণ’, তরুণ বসু, নাগরিক মঞ্চ, কলকাতা। ২। Wikipedia ৩। www.netra.news


#হিরাকুদ বাঁধ #Hirakud Dam #Odisha #Sambalpur #Protest #বাঁধ-বিরোধী আন্দোলন #Jawaharlal Nehru #বন্যা #জলবিদ্যুৎ #উচ্ছেদ #গণ-আন্দোলন #Mass Movement #Eviction #পরিবেশ #Environment #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

214989