নিবন্ধ

কোন স্পর্শে আজ বিশ্বাস রাখব?

সৃজিতা সান্যাল Aug 18, 2024 at 5:48 am নিবন্ধ

ভিতর থেকেই ভালোবাসব ভেবে
গিয়েছিলাম সেদিন তোমার কাছে
কিন্তু এ কী আরেকরকম মুখ
জেগে উঠল দহনবেলার আঁচে।

১৯১৫ সালের এপ্রিল মাস। জার্মান বাহিনী যুদ্ধজয়ের জন্য প্রয়োগ করে একধরনের বিষাক্ত গ্যাস। সেই গ্যাস তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিলেন বিজ্ঞানী ফ্রিত্জ হাবার, যাঁর আর-এক পরিচয় তিনি অ্যামোনিয়া সারের আবিষ্কর্তাও বটে।

স্বামীর এই দ্বিতীয় পরিচয়টিকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন তাঁর স্ত্রী ক্লারা। জানতেন তাঁর স্বামীর আবিষ্কার লক্ষ লক্ষ ক্ষুধিতের মুখে অন্নের জোগান দিয়েছে, দিয়ে চলেছে। তারপর যেদিন শাসকের আদেশে নতজানু হাবারকে দেখলেন ঘৃণ্য হত্যাকারীর ভূমিকায়, সেদিন কেমন লেগেছিল তাঁর? ইতিহাস বলে, চেনা মানুষের আড়ালে থাকা অচেনাকে বাধ্যত দেখার ভবিতব্য মানতে নারাজ ছিলেন তিনি। তাই বুকে রিভলভারের নল ছুঁইয়ে শেষ করেন নিজের জীবন। 


***     ***      ***

কিন্তু আজ, এই লেখার শুরুতে কেন হঠাৎ এল ক্লারার প্রসঙ্গ? আঘাতের প্রকার এবং রকমফেরটুকু বুঝিয়ে দিতে। শারীরিক এবং মানসিক যে কোনও সীমারেখা যখন লঙ্ঘিত হয়, আইনের দৃষ্টিতে সব ব্যক্তির সম-অবস্থানের পরও, আঘাতের উৎসস্থল চেনা নাকি অচেনা সেই প্রশ্নটিও জরুরি হয়ে ওঠে অনিবার্য কারণেই। খবরের কাগজের পাতায় বিষাক্ত গ্যাস আবিষ্কারের সংবাদ পেলে ক্লারা হয়তো বা বিষণ্ণ হতেন। কিন্তু আত্মহত্যার পথে হাঁটতেন না নিশ্চিত। যে মানুষটিকে আদ্যোপান্ত চেনেন বলে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, সেই ব্যক্তির অন্য চেহারার উন্মোচনেই তছনছ হয়েছিল তাঁর পৃথিবী।

অর্থাৎ নিতান্ত মানুষী দুর্বলতার কারণেই নৈর্ব্যক্তিক হওয়া বোধহয় সর্বদা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না আমাদের। এইখানেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় ‘বিশ্বাস’ নামক অনুভূতিটি। একজন ভিকটিমের শারীরিক মৃত্যু, আরও অজস্র মানুষের মধ্যে প্রকারান্তরে যা চারিয়ে দিয়ে যায় তা হল মানসিক ক্ষয়। ভয়, সন্দেহ, অবিশ্বাসের বীজ। আর সেই অস্বস্তিসূচক হাজারগুণে বেড়ে যায়, যখন পরিচিতির আশ্বাসই বদলে যায় হিংস্র আক্রমণে। 

অতিপরিচয়ের আবহ আসলে আমাদের কাছে একধরনের নিশ্চিন্ততার বার্তা নিয়ে হাজির হয়। চেনা পরিবেশ, চেনা শহর, চেনা কর্মস্থল– ছেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে অনিচ্ছে কাজ করে, সেও তো মূলত এই কারণেই! নির্ভরতা, স্বস্তি, শান্তি– এই শব্দগুলোকেই আমরা আঁকড়ে ধরতে চাই বারবার। কখনও চেনা পরিমণ্ডল, কখনও চেনা মানুষ, কিংবা উভয়কেই ছুঁয়ে থেকে।  

অথচ এই শব্দগুলো যে কতটা ভঙ্গুর, তা আরও একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম। নিজের কর্মস্থল, বিশেষ করে ভালোলাগার কর্মক্ষেত্র– পেশাদারিত্বকে সঙ্গে নিয়েই কর্মব্যস্ত মানুষের মানসিক আশ্রয় হয়ে ওঠে। কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যায় নিজের বাড়ির থেকেও প্রিয় হয়ে উঠেছে কাজের জায়গা। অনিবার্য কিছু অন্ধকার দিক থেকে যায় সব কর্মস্থলেই। তবু নিজের স্বপ্ন আর ইচ্ছে বাস্তব রূপ পায় যেখানে, যেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় সেই চেষ্টা– তাকে ঘিরে আবেগকেও অস্বীকার করার উপায় থাকে না। ইতিপূর্বে কোনও না কোনও সময়ে আর জি করে কাজ করেছেন যাঁরা, তাঁদের বয়ানেও তো একাধিকবার উঠে আসছে ‘বাড়ির মতো’ এই শব্দবন্ধ! 

ভিকটিম নিজ কর্মক্ষেত্রে অন-ডিউটি থাকাকালীন আক্রান্ত না হলেও, পরিবার-পরিজনের কাছে যন্ত্রণার অভিঘাত হয়তো একইরকম তীব্র থাকত। কিন্তু ‘নিজ কর্মক্ষেত্র’ এবং ‘অন-ডিউটি’ শব্দগুচ্ছ এই মর্মান্তিক পরিণতিতে আরও কিছু নেতিবাচক স্বর যুক্ত করেছে। কারণ তা একইসঙ্গে ছিন্নভিন্ন করেছে আরও বহু মানুষের কর্মক্ষেত্র-সংক্রান্ত নিরাপত্তার বোধ। ‘মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে অথবা নাইট-ডিউটি দেয়’– যুক্তির নিরিখে এ ঘটনা খুবই সামান্য। অথচ তার সঙ্গেই মিশে যায় অমোঘ বিপদ-সংকেত। দিল্লি-কামদুনি-হাথরস-আর জি করের তালিকায় নামের সংখ্যা বেড়ে চলে। সেইসঙ্গে মেয়েদের অতি সাধারণ নৈমিত্তিকতায় জুড়ে যেতে থাকে ভয়ের অনুষঙ্গ। 

***     ***      ***


এই বিপদ-সংকেতের আরও একটি দিক হল চেনা মানুষ, আত্মীয়-পরিজন বা প্রিয়জনের কাছ থেকে আসা শারীরিক-মানসিক বা যৌন নির্যাতন। সাম্প্রতিকতম ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিচিত কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত কি না, তা যদিও তদন্তসাপেক্ষ। তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার, ‘নির্যাতন’ শব্দে যে তীব্রতা আছে তা সবসময় প্রকটভাবে উপস্থিত নাও থাকতে পারে। দেহে সামান্যতম অবাঞ্ছিত স্পর্শ, মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা সামান্যতম লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ইদানীং বলা হয় বারংবার। কিন্তু স্পষ্টভাবে আসা আঘাত বা আক্রমণকে চিনে নেওয়া যত সহজ, পরিচিত স্পর্শে কোনও অনুচিত অভিসন্ধি আছে কি না– তা বুঝে নেওয়া তত সহজ হয় না সব ক্ষেত্রে। বুঝে নিতে নিতে; আত্মীয়-পরিচিত-পরিজন-বন্ধু বা প্রেমিকের মতো নিকটজনকে অভিযোগে বিদ্ধ করার মতো অন্যায় আদৌ ঘটেছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হতে দেরি হয়ে যায় অনেকসময়ে। তবু বোঝা মাত্র সোচ্চার হওয়া প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে, অপরিচিত এবং পরিচিত বৃত্তের মধ্যে হওয়া অপরাধের শারীরিক অভিঘাত একইরকম হলেও দ্বিতীয়টির মানসিক অভিঘাত নিঃসন্দেহে কয়েকগুণ বেশি। বিশ্বাসের ভিত নড়ে যাওয়া, প্রিয়জন-নিকটজনকে হারানোর যন্ত্রণা, তাদের চেনা মুখোশ খসে গিয়ে অপরাধী হিসেবে দেখার অসহায়তা, সবকিছু জেনেবুঝেও অস্বীকারের প্রবণতা– এরকম অজস্র জটিলতা এই জাতীয় অপরাধের প্রতিকার দূরের কথা, চিহ্নিতকরণকেই অনেকসময় কঠিন করে তোলে। 

চিহ্নিতকরণ যদি বা হয়, প্রশ্ন ওঠে, এরপর বিশ্বাস করতে পারব কি অপর লিঙ্গপরিচয়ের কোনও ব্যক্তিকেই? আমার অন্য অন্য কাছের মানুষেরা, আমার সন্দেহের তির বিদ্ধ করবে না তো তাদের অপরাধহীন আচরণকে? নারী-পুরুষ এই দুই বিপরীত পক্ষ হয়ে, একপক্ষের সন্দেহ আর অন্যপক্ষের সংকোচ নিয়ে তো বাঁচার কথা ছিল না আমাদের! কথা ছিল না ‘রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে’ অস্বস্তির কাঁটা নিয়ে একলা ছটফট করার।   

ভবিষ্যতেও যাতে তা না থাকে, সে কথা নিশ্চিত করার দায় শেষ পর্যন্ত লিঙ্গপরিচয় নির্বিশেষে মানুষেরই ওপর বর্তায়। অপরাধকে পুরোপুরি নির্মূল করা হয়তো কোনও সমাজের পক্ষেই সম্ভব নয়। কলকাতা শহরের বুকে চলতে ফিরতে কোনও দিন কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষ-স্পর্শ পায়নি, এমন মেয়েকে খুঁজে বার করা, পুত্রহীন মায়ের মৃত্যুস্পর্শহীন বাড়ি থেকে সর্ষে খুঁজে আনার মতোই অসম্ভব কাজ। কিন্তু লাঞ্ছনা সহ্য করা তো জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর মতো কোনও স্বাভাবিক পরিণতি নয়। তাই যা স্বাভাবিক নয়, যেখানে আমার স্বাচ্ছন্দ্য নেই— তার বিপক্ষে প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে প্রতিমুহূর্তে। সতর্ক হতে হবে। কিন্তু অন্যের অপরাধ আমার বা আমার প্রিয়জনের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে তুলতে পারে, এই সম্ভাবনায় ভীত হয়ে, জীবনকেই খারিজ করে দেওয়া যায় না! বরং অপরাধের সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টাই একমাত্র যুক্তিযুক্ত পথ। ধর্ষণ কিংবা অত্যাচারের পরিণতিতে ভয়াবহ মৃত্যু ঘটার দৃষ্টান্ত কম নয়। কিন্তু ভয়ের প্রকোপে তিলে তিলে নিজের স্বপ্ন আর ইচ্ছেকে হত্যা করা– সে মৃত্যুও কি সমান মর্মান্তিক নয়?  


ঋণস্বীকার: তারই কিছু রং, জয়দীপ ঘোষ, ধানসিড়ি, ২০২১।     

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান

আরও পড়ুন :   যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান

                    যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ

                    আমাদের মিছিল/ জুঁই নিয়োগী

                    অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী

                    আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত

                    চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

                    পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

                     মিছিলে পা মেলান, তবে মনে রাখুন…/মুনিয়া দেবলীনা

                     অন্ধকার পথে একলা হাঁটার স্বাধীনতা চেয়ে…/অঙ্কিতা ভট্টাচার্য


#R G Kar medical College #justice for rg kar #স্পর্ধা #reclaim the night

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

14

Unique Visitors

214879