পাখিদের শহরে
'রুমাল থেকে বেড়াল' বললে বাড়িয়ে বলা হয় না বোধহয়।
মাস্টার ডিগ্রির পর খানিকটা অবসর পেয়ে যখন নিজের সঙ্গে একটু সময় কাটাচ্ছিলাম, অজান্তেই কীভাবে যেন পাতিয়ে ফেলি পাখিদের সঙ্গে সখ্য। বিষয়টা আমার নিজের কাছেও আশ্চর্যের। চড়াই, কাক ছাড়া কোনো পাখির অস্তিত্ব আছে কিনা এ নিয়ে ভাবারও প্রয়োজন বোধ করিনি যে আমি, ধীরে ধীরে সেই আমারই চোখে ধরা দিতে থাকল বুলবুল, দোয়েল, হাঁড়িচাচা, টুনটুনি। যে পাখিদের সঙ্গে পরিচয় ছিল এতদিন শুধু বইয়ের পাতায়। তারপর যেন খুলে গেল এক নতুন দিগন্ত। একটু পড়াশুনো, খোঁজ খবর, আর সমমনস্ক কিছু মানুষের থেকে উৎসাহ পেয়ে আমার এই পাখি দেখার নেশা চেপে বসে। মাত্র বছর চারেক বয়েসের এই নেশাটি আমাকে বেশ কয়েক জায়গায় টেনে নিয়ে গেছে। আজ সেসব গল্প ভাগ করে নেব সবার সঙ্গে।
কলকাতায় আমার পাখি দেখার হাতেখড়ি চিন্তামণি কর বার্ড স্যাংচুয়ারি দিয়ে, স্থানীয়দের কাছে যা পরিচিত ‘কয়ালের বাগান’ নামে। তবে ঘুরে ঘুরে পাখির ছবি তোলার নেশা চেপে বসলেও আমার প্রতিবন্ধকতা ছিল দু’টো – প্রথমত, আমার DSLR ক্যামেরা তখনও ছিল না, একটা জুম লেন্সের পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা ছিল বলেই তাও এই নেশাটাকে প্রশ্রয় দিতে পেরেছি। দু’ নম্বর সমস্যাটা করুণতর। সৃষ্টিকর্তা আমার মাথায় জিপিএস বা কম্পাস কোনওটাই দিয়ে পাঠাননি। আমার রাস্তা বা দিকসংক্রান্ত কোনো ধারণার জন্ম আজ অবধি হয়নি। তাই প্রত্যেক যাত্রায় আমার কোনো না কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। চিন্তামণিতে গেছিলাম দুই বন্ধুকে বগলদাবা করে, কোন এক শীতের কাকভোরে। গড়িয়া থেকে অটোয় চেপে নরেন্দ্রপুর রথতলা, বাকিটা ১১ নম্বর বাসই ভরসা!
কলকাতার ইট-কাঠে ভরা মিথ্যে কথার জঞ্জালে যে পাখিদের এমন লাল-নীল সংসার থাকতে পারে তা আমার ভাবনাচিন্তার অতীত ছিল। জঙ্গলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এ পাখিরালয়। পাখিদের অভয়ারণ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে। তখনও সব পাখি ভালো করে চিনি না। দেখলাম একটা জলপাইরঙা পাখি এক মন কাঠ ঠুকরে চলেছে। পরে পড়াশুনো করে জেনেছিলাম সেটা Streak Breasted Woodpecker বা দাগী-বুক কাঠকুড়ালি। এরপর একে একে এশিয়ান স্ত্রী কোকিল, নীলগলা বসন্তবৌরী, বাঁশপাতি, Bronzed Winged Drongo, অনেক রকম প্যাঁচা, White browed, Verditer Flycatcher বা অম্বরচুটকির দেখা মিলতে লাগল। প্রায় একটা গোটা দিন ঘুরেছি, তাও সবটা দেখে শেষ করতে পারিনি। ছোট ছোট অনেক জলাশয় গোটা জায়গাটা জুড়ে। তাই ভোরবেলা পাখি দেখার আদর্শ সময় হলেও এখানের মজাটা অন্য জায়গায়। জলাশয়গুলোয় পাখির দল স্নান করতে নামে বেলা বাড়লে। ফলে সেই সময় জলাশয়ের কাছাকাছি ঘুরঘুর করলে অনেক পাখিরই দেখা মিলবে। তবে পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা শাল, বাঁশ আম কাঁঠাল, ফার্ণের জঙ্গলের আলো- আঁধারিতে খুব একটা কার্যকরী ছিল না। তবে ক্যামেরার চেয়ে অনেক জরুরি যে জিনিসটা, সেটা হল চোখ, তার অতৃপ্ত থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই এখানে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, চিন্তামণি কর বার্ড স্যাংচুয়ারি কিন্তু শুধু পাখি নয়; প্রায় শতাধিক প্রজাতির পতঙ্গ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, গোসাপ, বনবেড়াল ইত্যাদিরও সংসার।
২০১৯ এর শুরুতে গেছিলাম বসিপোঁতা। ততদিনে আমার DSLR জুটেছিল, কিন্তু তার লেন্স আবার পাখির ছবি তোলার উপযুক্ত নয়। উপরন্তু বাঁ পায়ের লিগামেন্ট খুইয়ে তখন সঙ্গী আমার ক্রাচ। উত্তরপাড়া থেকে অটোয় রঘুনাথপুর বাজার ১০-১২ মিনিটের পথ। রঘুনাথপুর বাজার থেকে সামনে গিয়ে ডানদিকের পাকা রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই পৌঁছে যাবেন দিগন্তবিস্তৃত ঘাসজমির রাজ্যে। তবে নগরসভ্যতা দাঁত নখ বের করে যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে কতদিন এই শহর পেরিয়ে আসা অগোছালো সৌন্দর্যটুকুকে ধরে রাখা যাবে জানি না। এখানে ঘাসজমির এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক ছোট ছোট জলাশয়, তাতে শামুক-গেঁড়ি-গুগলি খেয়ে বেড়াচ্ছে এশিয়ান ওপেন বিল স্টর্ক বা শামুকখোল। ঘাসজমিতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ভরতপাখি, যাকে চড়াই বলে ভুল করে ফেলতে পারেন অনেকেই। বড় ঘাসের ডগায় বসে দোল খাচ্ছে কালো-মাথা কসাই। কপালে শিকে ছিড়লে দেখা যাবে সাইবেরীয় চুনীকন্ঠী, ভোমরা ছোটন, তিলে মুনিয়া, শিলাফিদ্দা, নীল-গলা ফিদ্দা ইত্যাদি ছোট্ট ছোট্ট দেড়-আঙুলে পাখি। Pied harrier এর ঠাট-ঠমকে যদি ছিটকে না যান তবে বসিপোঁতা যাওয়া বৃথা। Ghost of Grassland এর সঙ্গে সাক্ষাৎ আমার সে যাত্রায় হল না। বসিপোঁতা আমাকে সেদিন একটু হতাশই করেছিল যখন বাড়ি এসে দেখেছিলাম ওখানে মোট ১৯৭ রকম প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া গেছে, আর আমার কপালে জুটেছে আমার দেখা মাত্র ৪টে নতুন প্রজাতির। কপাল ছাড়া কাকেই বা দোষ দেব।
এরপরের গন্তব্য কলকাতার অনতিদূরে বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী। ভোররাতের ট্রেনে চাপলে সকাল সকাল পৌঁছে যাওয়া যাবে। পরিযায়ী পাখিদের এই স্বর্গরাজ্য সেজে ওঠে মোটামুটি নভেম্বরের শুরু থেকেই। মাঝিভাইদের নৌকায় ঘুরে দেখতে হয় এই চুপির চর। যদিও এখানকার নৌকাবাহকদের মাঝি বললে অর্ধেক বলা হয়। এঁরা একেকজন যেন পাখির এনসাইক্লোপিডিয়া। ঠিক কোনদিকে গেলে কোন পাখির দেখা পাওয়া যাবে, সব এঁদের নখদর্পনে। Red Crested Pochard (রাঙামুড়ি), বেগুনী কালেম, জলপিপি, পান ডুবিরি, পাতি সরাল, Pheasant tailed jacana, Glossy Ibis-এর মতো জলচর পাখিরা চুপির চরকে ওই ক’মাসের জন্য ঘরবাড়ি বানিয়ে নেয়। এখানে জলপথের একটা বিশেষ বাঁককে মাঝিভাইরা নাম দিয়েছেন ‘গরীবের আমাজন’। জলের আশেপাশে ডাঙায় পোকামাকড়, মাছের আশায় বসে থাকে বাঁশপাতি, মেঘহও মাছরাঙা , Barn Swallow, নানা প্রজাতির হট্টিটি।
কথায় বলে ‘এক জঙ্গলে একটাই বাঘ থাকে’। পাখিদের রাজ্যেও কোথাও কোথাও এ কথা খাপ খেয়ে যায়। পূর্বস্থলীর সেই ‘বাঘ’ হল Osprey বা মাছমুড়াল। তার ঔদ্ধত্য, শিকার করা, এবং শিকারকে আত্মসাৎ করা দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন পাখিপ্রেমীরা। আমিও তার দেখা পেয়েছি বটে, তবে আমাকে দেখেই সবিশেষ বিরক্ত হয়ে উনি শিকার ধরেই রওনা দিয়েছিলেন দূরে। নিরালায় কোথাও বসে আহার সেরেছেন।
‘বিষ বিশ’ ২০২০-তে এখন পর্যন্ত আমার পাখি দেখতে যাওয়া একবারই। সকলের অতিপরিচিত রবীন্দ্র সরোবরে। পড়ন্ত শীতেও দেখা মিলেছে Indian Paradise flycatcher , Black naped Monarch এর। ভোররাতের দিকে গেলে দেখা মিলতে পারে প্যাঁচার। বিভিন্ন ধরনের ফ্লাইক্যাচারেরও দেখা মিলবে একটু ধৈর্য ধরলেই।
মনে রাখতে হবে, পাখি দেখতে গিয়ে উৎসাহের আতিশয্যে হৈ-হল্লা করে তাদের নিজস্ব জীবনছন্দে ব্যাঘাত ঘটানোর কোনও মানে হয় না। পাখি দেখা আর পিকনিক করার মধ্যে একটা ন্যূনতম পার্থক্য রাখা দরকার। নিজেদের আনন্দের জন্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি না তোলাই বাঞ্ছনীয় এবং নেস্টিং-এর সময়ের ছবি তোলার ক্ষেত্রে সচেতন থাকা প্রয়োজন। এখনও রাজারহাটের ওয়েস্ট ল্যান্ড বা সাঁতরাগাছির ঝিলের মতো জায়গা আমার ঘুরে দেখা বাকি। যে জায়গাগুলো গেছি সেগুলোরও বুড়িছোঁয়া হয়েছে মাত্র। লকডাউনে শহরের সীমানায় যেভাবে পাখিরা ফিরে আসতে শুরু করেছিল, সেটাই প্রমাণ করে আমরা কতটা বিপর্যস্ত করে তুলেছি ওদের। সভ্যতা এখন নিজস্ব ছন্দে ফিরে আসছে, আবার ওদের গা ঢাকা দিতে হবে। গোটা পৃথিবীটাকে শুধুমাত্র নিজেদের মৌরসিপাট্টা ভেবে বসে থাকা মানবসভ্যতা কি পাখিদের ঠিকানাগুলোকে মানচিত্র থেকে মুছেই ফেলবে?
জানি না। ভাবলে অসহায় লাগে শুধু।
[কভারে ব্যবহৃত ছবিটি ফিঙে বা Black Drongo পাখির।]
#পরিবেশ ও প্রাণচক্র #পাখি #ওয়ন্তিকা দাশগুপ্ত #চিন্তামণি কর পাখিরালয় #রবীন্দ্র সরোবর #বসিপোঁতা #পূর্বস্থলী