আমার ঘরে, ভারতবর্ষে
Ruskin Bond-এর ‘At Home, In India’ গদ্যের অনুবাদ
বন্ড। রাস্কিন বন্ড। তাঁর জন্য আলাদা কোনও পরিচিতি বা ভূমিকা সংযোজনের প্রয়োজন পড়ে না। এই ছোটো লেখাটি রাস্কিনের ‘Notes From A Small Room’ বই থেকে নেওয়া একটি ব্যক্তিগত গদ্য। এখানে দেশ নিয়ে তাঁর অন্তরতম অনুভূতিমালা স্বভাবসিদ্ধ স্বাদু ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। এই আশ্চর্য আলোকিত গদ্য, স্বীকার করে নিতেই হয়, অনুবাদ করা আপাতভাবে যতটা সহজ বলে মনে হয়, ঠিক ততটাই কঠিন।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যাদের ভারত ছেড়ে অন্যত্র যাবার সুযোগ করে দিলে খুশি মনে সেই সুযোগ লুফে নেবে। কিন্তু আমার যখনই সে সুযোগ এসেছে, আমি পিছিয়ে এসেছি। অথবা বলা ভালো, কিছু একটা আমায় পিছনে টেনে ধরেছে।
কী নাম দেওয়া যায় এই বিষয়টাকে, যেটা আমার কাছে এতটা জরুরি অথচ অন্যদের ওপর তার তেমন প্রভাবই নেই? কারণ অন্যেরা শুধু যে যখন ইচ্ছা চলে যাচ্ছে তা-ই নয়, অনেকে আর ফিরছেও না।
বছরকয়েক আগে হংকং-এর একটা ম্যাগাজিন আমাকে বেশ মোটা মাইনের চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি ভাবার জন্য দু-এক সপ্তাহ সময় নিলাম, সারাদিন ধরে ভাবনাচিন্তা করলাম এবং শেষে তাদের নাকচ করে দিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।
আমার বন্ধুরা আমাকে পাগল ভেবেছিল। এখনও ভাবে। এমন একটা চাকরি পেলে ওদের প্রায় সকলেই হামলে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বলে দিত, সে চাকরি এই পামে ঢাকা উপত্যকা বা পাইনভরা পাহাড়ের দেশ থেকে যতদূরেই হোক না কেন। আমার অনেক বন্ধু চলেও গেছে এখান থেকে। আর কোনওদিন হয়তো ফিরবেও না তারা। হয়তো বিয়ে করার জন্য কোনওমতে ঝটিকা সফরে আসবে, আবার বিয়েটা সেরেই তড়িঘড়ি চলে যাবে। দেশের জন্য কি ওদের একটুও মনখারাপ হয় না? কী জানি।
আমার তো দেশ ছেড়ে যাবার কথা ভাবলেই একটা আতঙ্ক বোধ হয়। যদি ফিরে আসতে না পারি? কম বয়েসে একবার ইংল্যান্ড গিয়ে এরকম হয়েছিল। ইংল্যান্ডে গেছি, ভারতে ফিরে আসতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে, কিন্তু ফেরার মতো টাকা নেই। প্রায় দু বছর কাজ করে, ভয়ানক খাটাখাটনি করে (এমন খাটনির কাজ আমায় সারাজীবনে আর কখনও করতে হয়নি) তবে বাড়ি ফেরার ভাড়া জোগাড় করতে পেরেছিলাম।
আর ‘বাড়ি’ মানে কিন্তু মা-বাবা-ভাই-বোন না। তারা কেউই এখানে ছিল না। বাড়ি মানে আমার কাছে ভারত।
তাহলে আমি এখানে থেকে গেলাম কেন? কীসের টানে? আমার জন্ম এখানে বলে? আমার চেহারা আমার নর্ডিক পূর্বপুরুষদের মতো। এ দেশের ভূমিপুত্রদের সঙ্গে আমার দৃশ্যত কোনও মিল নেই। হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রায়ই আমার পাসপোর্ট দেখতে চান।
“আমার কি নিজের দেশে ঘুরে বেড়াতেও পাসপোর্ট লাগবে?” আমি জিগ্যেস করি।
তারা ভুরু কুঁচকে বলেন, “কিন্তু আপনাকে তো ভারতীয়দের মতো দেখতে না।”
আমি উত্তর দিই, “আমি রেড ইন্ডিয়ান।”
আমি ভারতেই জন্মেছি, স্কুলে গেছি, বড় হয়েছি। আমার বাবাও এখানেই জন্মেছিলেন, বড় হয়েছিলেন, মারাও গেছিলেন এখানে। আমার দাদু অনেকদিন এখানে ছিলেন, তাঁরও মৃত্যু এ দেশেই। এ-ই তো আমার ভারতীয়ত্বের যথেষ্ট প্রমাণ। না হলে তো আমায় আমার মায়ের বংশের দিক থেকে পরিচয় দিতে হয়, অথবা পিছিয়ে যেতে হয় তৈমুর লঙ-এর সময় পর্যন্ত। নিজের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে কত দূর পিছিয়ে যেতে হবে আমাকে?
হয়তো এই মাটিই আমায় টানে। কিন্তু বহু ভারতীয় এখানে জন্ম (এবং পুনর্জন্ম) নেওয়া সত্ত্বেও দেশ ছাড়ার ব্যাপারে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না। তারা সমতলের জন্য পাহাড় ত্যাগ করতে রাজি, শহরের জন্য গ্রাম ত্যাগ করতে রাজি, অন্য দেশের জন্য নিজের দেশ ত্যাগ করতেও রাজি। অন্যান্য দেশগুলো যদি অভিবাসনের ব্যাপারে আরও বেশি উদার হত, তাহলে আমাদের দেশকে আর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হত না। গণঅভিবাসন এমনিই সে সমস্যার সমাধান করে দিত।
কিন্তু আমাকে যা টানে সেটা বোধহয় মাটির চেয়েও বেশি কিছু। অন্য কিছু। আমার কাছে ভারত মানে একখণ্ড ভূমির চেয়ে অনেক বেশি। ভারত একটা আবহ। হাজার হাজার বছর ধরে বহু জাত, বহু ধর্মের মানুষ এখানে এসেছে। তাদের সবার দানে তৈরি হয়েছে ভারতবর্ষ নামের এই বিস্ময়, যাকে কোনও সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। নানারকম মানুষের ভিড়ে ভারত ওষ্ঠাগতপ্রাণ। কিন্তু সেই বৈচিত্র্যের মধ্যেই নিহিত তার জাদু। সেই ভিড়েই তার আত্মার সৌন্দর্য।
আমার ক্ষেত্রেও সে কথা খাটে। এদেশের একজন পিয়ন বা পানওয়ালা অথবা লোকসভার কোনও একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি যতটা ভারতীয়, আমিও ততটাই।
জাতিপরিচয় আমায় ভারতীয় করেনি। ধর্মও না। আমাকে ভারতীয় করেছে ইতিহাস। আর শেষ কথা সবসময় ইতিহাসই বলে।