গল্প

চন্দ্রগুপ্তের আপন দেশে

অরিন্দম গোস্বামী Mar 20, 2022 at 10:33 am গল্প

সেই এতটাই দেরি করল ট্রেনটা যে নামতে নামতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলো। এমনিতে এখানে এসেছিলাম বছর পাঁচেক আগে। স্টেশনে নেমে দেখলাম এই ছোট্ট শহরটা পুরনো দিনের সাজগোজ অনেকটাই বদলে ফেলেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে না এলে হয়তো কোনো অসুবিধা হত না। কিন্তু সন্ধেবেলায় স্টেশন চত্বরে আলোগুলোর ঢাকার ভিতরে কেমন করে যেন ঢুকে পড়েছিল একগাদা শ্যামাপোকা। এখন মরা শ্যামাপোকাগুলো আলোর ঢাকনার তলায় জমে উঠে বাতিগুলোকে অনেকটাই যেন অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে। সেই অনুজ্জ্বল আলোর তলা দিয়ে আর পাঁচজন যেমন ধাক্কাধাক্কি করে এগিয়ে গেল আমি তেমন এগোতে পারলাম না। ওভারব্রিজের তলায় দাঁড়িয়ে ভিড় পাতলা হয়ে যাবার জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর যখন একে একে সবাই ওভারব্রিজে উঠছে ছোট্ট ব্যাগটাকে পিঠে নিয়ে আমিও একে একে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম।

এমনিতে এখানে আগেও অনেকবার এসেছি। সেই ছোটোবেলা থেকেই। এখানে আমার পিসির বাড়ি। পিসেমশাই ছিলো এই এলাকার একজন ডাকসাইটে খেলোয়াড়। ছোটবেলায় উয়াড়ি বা এরিয়ান মাঠে বেশ কয়েকবার তার খেলা আমি দেখেছি। এখন বুঝতে পারি, স্কিল বলতে যা বোঝায় সেটা হয়তো তার বেশি ছিল না কিন্তু গায়ে-গতরে খেলতে পারত খুব। তার সঙ্গে ছিল নাছোড়বান্দা মনোভাব। এইটুকু সম্বল করেই কলকাতা মাঠে ফার্স্ট ডিভিশনে বছর দশ-বারো দাপিয়ে খেলেছে পিসো। তারপর কলকাতা মাঠে যখন নাইজেরিয়ানরা এলো, পিসোও পিছিয়ে পড়লো। পিসির সঙ্গে তার কীভাবে পরিচয় হয়েছিল সেটা অবশ্য আমি জানিনা। তখন আমি নেহাতই শিশু। খেলা থাকলে মাঝেমাঝেই পিসিকে সঙ্গে নিয়ে পিসো আমাদের বাড়িতে উঠতো। তারপর সন্ধ্যে পেরিয়ে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ ফিরে এসে বলত সেদিনের খেলায় কী কী ঘটনা ঘটলো ।

সেই থেকেই আমি পিসোর ন্যাওটা। কলকাতার মাঠ পিসোর মতো আমাকেও শেষ পর্যন্ত জায়গা দেয়নি বটে, কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে মাঠের ধারে মঞ্চ বেঁধে যেসব নাটকের অভিনয় হয় সেখানে আমি বেশ পরিচিত মুখ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমিও পিসোর মতো ঐ মাঠেই চরে খাই। এই সন্ধের অন্ধকারে আমার দিকে কেউ তাকায়নি বটে কিন্তু আমি নিশ্চিত, যদি সময়টা হত দুপুর বা বিকেল, দু চারজন মহিলা আমার দিকে ঘুরে তাকাতেনই। এই ব্যস্ততার কারণেই হয়ত শিমুলপুরে আসতে এতটা দেরি হয়ে গেল। আসলে থিয়েটারের সঙ্গে কেউ যদি সিরিয়ালেও নাম লেখায়, তাহলে সারামাসের মধ্যে কাজ থেকে ছুটি পাওয়া বড় সহজ নয়। আবার আপনি যদি ছুটি চান হয়ত পাবেন। কিন্তু কে বলতে পারে , আপনি যে দিন ছুটি নিলেন তারপর দিনই সেখানে আপনার জায়গায় আর একজন যোগ দিয়ে দেবে না? আমাদের লাইনে এরকম প্রায়শই হয়। বিশেষ করে শীতের শুরুতে কাজের জায়গা ছেড়ে তাই বেরোন যায় না কিছুতেই।

স্টেশন চত্বরের বাইরে এসে দেখি যেখানে রিকশাগুলো দাঁড়াত সেখানে একটাও রিক্সা নেই বরং অনেকগুলো টোটো সেখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। তারই মধ্যে কয়েকটা টোটোতে উঠে পড়ছে দু চারজন লোক আর টোটোওয়ালাগুলো তারস্বরে নানা জায়গার নাম করে চিৎকার করে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে দু'পা নেমেছি কি নামিনি আমার কাঁধের ব্যাগে টান পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সাদা ধবধবে দাঁত বার করে লিম্বু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি বললাম, “কী রে! আগে কথা বলবি তো!” একগাল হেসে আরও এগিয়ে এসে, আমার পিঠ থেকে ব্যাগটা নিজের পিঠে তুলে নিল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালেই বোধহয় ভালো হত বলো? তাহলে তোমাকে আর কষ্ট করে ওভারব্রিজ ধরে ব্যাগটা এত ওঠাতে-নামাতে হত না”। আমি বললাম, “না না, এটা তেমন ভারি নয়।” ব্যাগটা নিজের বুকের সামনে ঝুলিয়ে নিল লিম্বু। তারপর আমাকে ইশারায় বললো, “এদিকে এসো।”

লিম্বুর সঙ্গে আমার চিরদিনই একটা আলাদা ব্যাপার আছে। ছোটো থেকেই ও আমার খুব প্রিয়। আগে যখন বছরে একবার-দুবার করে আসা হতো, তখন সব সময় লিম্বু আমার সঙ্গে ঘুরঘুর করত। বয়সে আমার চেয়ে প্রায় সাত-আট বছর ছোট কিন্তু ওর মত বিশ্বস্ত সঙ্গী আমি খুব কমই পেয়েছি। যতবারই এখানে এসেছ, ও সব কাজে আমায় সাহায্য করেছে। যখন কলকাতায় আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়, যদি ওকে বলি আরও দুদিন থেকে যেতে খুব একটা অখুশি হয় না। এমনিতে লিম্বুর মতো ছেলে হয় না। প্রখর স্মৃতিশক্তি অথচ এই ছেলেই কিনা পরপর দুবার বিএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে পরীক্ষা না দিয়ে ফিরে এলো! পরীক্ষার সময় ওর যে কী হয়! একবার আমি দেখেছি। এমন অদ্ভুত চোখে তাকায় যে মনে হয় এ যেন সে ছেলেই নয়। পরীক্ষার হল থেকে যখন ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হলো, তখন ও কেমন বিড়বিড় করছিলো। স্পষ্ট করে কিছু বলতেই পারছিল না। পরে ওকে সাইকায়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছে। বেশ কিছুদিন ওষুধপত্রও খেয়েছে। কিন্তু তারপর কি যে হলো, এরকম একটা ব্রাইট ছেলে পড়াশোনার দিকে আর এগোলই না। অথচ ওর চেয়ে অনেক কম মেরিটের ছেলে ড্যাং-ড্যাং করে এমএসসি পাস করে গেলো। ওকে দেখলে আমার খালি এই কথাটাই মনে পড়ে।

এরপর এই মানসিক রোগের ডাক্তার দেখানোর জন্যই হোক বা পরীক্ষা না দেওয়ার জন্যেই হোক আর পাঁচজনের কাছে লিম্বুর দাম হঠাৎই এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেল। সবাই যেন ওকে বাড়তি একটা মানুষ হিসেবে ধরতে শুরু করল। ওর যেন আলাদা কোনও সম্মান নেই, কোনও গুরুদায়িত্ব ওর ওপর আর দেওয়া হয় না। এতে সব থেকে কষ্ট পেত আমার পিসিমা। আমার হাত ধরে একবার বলেছিল, “দেখ, লিম্বু হয়তো আমার পেটের ছেলে নয়। কিন্তু ওকে তো কখনই আমি আমার ননদের ছেলে মনে করে মানুষ করিনি। তাই ওর প্রতি অন্য লোকেদের এই হেলাফেলা দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে।” অথচ ওর মতো নিঃস্বার্থ ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। আমাদের সবার একটা জিনিসের লোভ আছে, যার নাম প্রশংসা। কিন্তু কী অদ্ভুত, লিম্বু এটা কাটিয়ে উঠেছে। শেষবার যখন এলাম সেটাই অবাক হয়ে দেখলাম। আমরা দুজনে মাঠতলার পুকুরে মাছ ধরতে গেছিলাম। আমি যখন প্রথম ঘণ্টায় একটা কি দুটো পেয়েছি তখন লিম্বু ধরে ফেলেছে সাতখানা মাছ। ভেতরে ভেতরে আমি খুব অস্বস্তিতে ছিলাম। বললাম, “আয় তো লিম্বু , এবার হাফ টাইম হয়ে গেছে। এবার ছিপ পাল্টাপাল্টি করি।” ও অনায়াসে রাজি হয়ে গেলো, কিন্তু সেকেন্ড হাফেও আমার একই অবস্থা। এবারেও ওর ক্যারিশমা দেখালো লিম্বু । কিন্তু এর চেয়েও বড় চমকটা ও দিল যখন দুজনের দুটো ব্যাগের মাছ একটাই ব্যাগে ঢেলে এক জায়গায় করে দিয়ে ও বলল, “আসলে দুটো ব্যাগ নেওয়া খুব অসুবিধা বুঝলে। এক জায়গাতেই থাকুক”। বাড়ি ফিরলে সবাই দেখতে চাইছিল, আমি ক’টা মাছ ধরেছি ! আমি থলেটাকে সবার সামনে উঠোনের ওপর উপুড় করতে সবাই খুব উল্লসিত হয়ে বলল, “এতগুলো মাছ সব তুমি ধরেছো?” লিম্বু কিন্তু একটা কথাও বলেনি আর আমিও মান বাঁচাতে কিছু না বলে একটা চালাক চালাক হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। পরে অবশ্য ওকে একা পেয়ে বলেছি, “সরি! কিছু মনে করিস নি তো? তোর কৃতিত্বটা সব আমি চুরি করে নিলাম”। ও যেন খুব অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বললো, “তুমি তো একদিনের জন্য ধরতে এসেছ। আমি তো মাঝেমাঝেই ধরি। আমার তো প্র্যাকটিস আছে!” ও যে রাগ করেনি সেটা বোঝাতে পরেরদিনও মরিয়া হয়ে পড়েছিল। বরং ও যে  আমার ওপর প্রচণ্ড খুশি সেটা বোঝাতেই হয়তো নিজের হাতে অনেকগুলো শক্ত তালাকুর আমাকে কেটে ও খাইয়েছিল। তালের শুকিয়ে যাওয়া আঁটিকে এখানে বলে তালাকুর, ও জানত এটা আমার খুব পছন্দের একটা জিনিস ।

বাড়িতে পৌঁছনোর পর  সন্ধেবেলাতেই একেবারে হুলুস্থুল বেঁধে গেল। একেই বাড়িতে তখন অন্তত  জনা পনেরো ছেলের রিহার্সেল চলছে পুরোদমে। পরশু দিন নাটক। আমার কাজ হচ্ছে এই দেড় দিনের মধ্যে তালিম দিয়ে ওদের ঘষেমেজে জেল্লাদার করে তোলা। আমি কীভাবে এসব করব জানি না। এ বিষয়ে আমার কোন আইডিয়াই নেই। তবু আমার ওপর পিসোর অগাধ আস্থা। তাই এই ভরা মরশুমেও আমাকে তিন দিনের জন্য ছুটি নিয়ে আসতে হয়েছে। এইটা শুধু আমি জানি ডি. এল. রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ হবে। যাই হোক, নাটকের দলের কাছে আর সিরিয়ালের প্রযোজকের কাছে এটাই বলেছি যে আমার পিসতুতো বোনের বিয়ে। যেটা আসল কথা সেটা হচ্ছে বোনের বিয়ে হয়ে গেছে গত বছরেই। এখন সেই এক বছর আগের হয়ে যাওয়া বাসি বিয়ে উপলক্ষে আমার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে।

মহলার জায়গায় পৌঁছে দেখি চারিদিকে হৈ হৈ কান্ড। হারমোনিয়াম নিয়ে, ঢোল নিয়ে এবং ফুলুট বাঁশি নিয়ে বসে আছে তিনজন। সময়ে সময়ে তারা লাইভ মিউজিক দিচ্ছে। আমার ব্যাগটা বেহাত হয়েছিল স্টেশনেই। এখন জুতো খুলে মহলার জায়গায় ঢুকতে না ঢুকতেই গোটা আমিটা পড়ে গেলাম এদের খপ্পরে। জামা-কাপড় খোলা, চোখে-মুখে জল দেওয়া এসব শিকেয় উঠলো। সামনের একটা চেয়ারে জোর করে আমায় বসিয়ে দিয়ে পিসো বললো, “দেখে নে ভালো করে, কাদের কোন জায়গাটায় অসুবিধা হচ্ছে। এই হচ্ছে বিল্টু, এতোদিন এদের তালিম দিয়েছে। তোর যা যা অসুবিধা মনে হবে বিল্টুকে বলবি। তারপর এদের দিয়ে সেগুলো তুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বিল্টুর”। বিল্টুকে আমি আগেই দেখেছি। তখন আরেকটু ছোটো ছিল। হাত-পা নেড়ে অভিনয় খারাপ করে না তবে একটু যাত্রার টেন্ডেন্সি আছে। একটু অতিনাটকীয়। অবশ্য মূল পর্ব পর্যন্ত টিকে থাকতে হলে এসব একটু লাগে বটে। বেশি আন্ডার অ্যাকটিং এখানে লোকে বুঝতে পারেনা। 

এরই মধ্যে লিম্বু ফিরে এসেছে। এসেই ধরে ফেলেছে একটা স্ক্রিপ্ট। হালকা হালকা করে একে-ওকে শুরুর দিকটা ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি বললাম, “সে কি! এদের এখনও মুখস্থই হয়নি?” বিল্টু বলল, “হয়নি যে তা নয়, অনেকেরই মুখস্থ। তবে বুঝতেই পারছেন তো, এখনও পর্যন্ত কয়েকটা চরিত্রে বারবার বদল করতে হয়েছে। তাই তাদের নিয়ে একটু সমস্যা আছে। আর এখনও একটা শিশু চরিত্র যোগ করতে হবে। সে এসে যাবে কাল সকালে। অবশ্য তার মুখে কোনো ডায়লগ নেই”। আমি বললাম, “কে, আত্রেয়ী?” বিল্টু একগাল হাসল শুধু। এর মধ্যে ভেতর বাড়ি থেকে পিসি থালা ভর্তি ফল পাঠিয়ে দিয়েছে। নিজেও একবার এসে বলল, “একি চেহারা হয়েছে রে তোর? খুব ডায়েট করছিস নাকি?” তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “সবটা খাবি। পাশের দোকান থেকে বড়ো রসগোল্লা আনতে বলে রেখেছি। ফল ক’টা খেতে খেতেই চলে আসবে”। পিসি চলে যেতেই আমি ইশারায় লিম্বুকে ডেকেছি, ও হাত তুলে আমাকে আশ্বস্ত করেছে।

বিরামপুর স্পোর্টিং ক্লাবের নাম একসময় এই জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরত। সারাবছর অ্যাথলেটিকস, ফুটবল, ক্রিকেট নানা কম্পিটিশন লেগেই থাকতো এদের মাঠে। এখন খেলাধূলায় গ্রামবাংলাতেও একটু ভাঁটা। কম বয়সী ছেলেরা বড়ো একটা সময় পায়না। তার ওপর পকেটে পকেটে মোবাইল। ক্লাব কর্তারা তাই বছর পাঁচেক আগে থেকেই শুরু করেছেন নাটক প্রতিযোগিতা। আশেপাশের বেশ কয়েকটা ব্লক থেকে তো বটেই, এমনকি সাঁইথিয়া, আমোদপুর থেকেও এই প্রতিযোগিতায় নাম দিতে অনেক নাটকের দল আসে। দশ-পনেরো দিন ধরে চলে এই প্রতিযোগিতা। পিসোও এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোচিং সেন্টার ছেড়ে একটা নাটকের দলের অধিকারী। 

বিপদ এলো পরদিন সকালে। এখনও পর্যন্ত যাঁর সিকান্দার শাহের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল সেই ভদ্রলোক হঠাৎ জানিয়েছেন যে , খুব অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য তিনি অভিনয় করতে পারবেন না। সিকান্দার শাহের মাত্র এক সিনের পার্ট। যদিও চরিত্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই অবস্থায় পরবর্তী সিনগুলোতে অভিনয় করছেন, এমন কোনো অভিনেতা সিকান্দার শাহ হয়ে প্রথম সিনটা করে দিতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে আমার প্রথম পছন্দ ছিল লিম্বু। কেননা ও শুরু থেকেই এই নাটকের সঙ্গে যুক্ত আছে। নাটকের অনেকটা অংশ ওর প্রায় মুখস্থ। সেইজন্য এই ব্যাপারটায় আমি খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না বরং অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চলাফেরা, তাদের বাচনভঙ্গি, তাদের অ্যাকশন এইগুলো ঠিকঠাক করে দিতেই আমি বেশি ব্যস্ত ছিলাম। আকারে ইঙ্গিতে আমি বরং লিম্বুকে বলে রেখেছিলাম, তোর ওপর একটা বড়ো দায়িত্ব আসতে পারে। তুই কিন্তু তৈরি থাকিস। হয়ত এ কথা বলে রাখার খুব একটা দরকার ছিল না, কেননা আমি দায়িত্ব দিলে সেটা ও করবে না, এমন কথা শুধু আমি কেন আমাদের পরিবারের মধ্যে কেউই বিশ্বাস করতে পারবে না।

যাইহোক,  দু একটা জায়গা খুব গভীরভাবে মেরামত করতে হলো। একজনের উচ্চারণে সমস্যা ছিল। তার জন্যে কয়েকটা সংলাপ থেকে সমস্ত রকমের ‘স’-কে বাদ দিতে হল। এছাড়াও একটা দৃশ্যে চন্দ্রগুপ্ত বারবার চাণক্যর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। তাকে মেঝেতে চকের দাগ টেনে বোঝাতে হলো, এর পিছনে যাতে সে কখনই না যায়। তাহলে স্পট দিয়ে তাকে ফলো করা যাবে না। নন্দরাজার মুন্ডু হাতে কাত্যায়নের হাসিটা বড়ই বিসদৃশ লাগছিল, সেটাও আগাগোড়া পাল্টে দিতে হলো। এইসব করে দুপুর বেলা যখন বাড়িতে ফিরে এলাম পিসো আমার ওপর খুব খুশি হয়েছে বলেই মনে হল। পিসি আমার পাতে দুখানা পাবদা মাছের পিস আগেই চাপিয়েছিল। পিসোর হুকুমে আরও একখানা সেখানে চলে এল। খেয়েদেয়ে ওঠার মুখে পিসো বলল, “তোকে একটা অনুরোধ করবো বুঝলি। একটু রাখতে হবে”। আমি বললাম “সে আবার কী, তুমি যা বলবে সেটাই ফাইনাল”।

দুপুর বেলা পিসো এক ভদ্রলোককে নিয়ে এল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। ওঁর মুখেই শুনতে পেলাম ভদ্রলোকের নাম শশধর ভান্ডারি। কাছে এসেই আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, “একসময় অনেক যাত্রা থিয়েটার করেছি। আপনি আমাকে একটা দুপুরে তৈরি করে দিন। একটা তো মাত্র সিন। এরমধ্যে নিশ্চয়ই তৈরি করে ফেলতে পারব”। সকালবেলায় কানাঘুষো শুনতে পাচ্ছিলাম সিকান্দারের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য অনেকেই নাকি আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে যাবে সেটা বুঝতে পারিনি। এমনিতে শশধরবাবু মিথ্যে কিছু বলেননি। ওঁর অভিনয়ের সেন্স আছে। একবারও দেখিয়ে না দেবার পরেও, নিজের থেকে উনি দেখে দেখে সবকটা সংলাপ যেভাবে বললেন, তাতে খুব বেমানান লাগছিলো না। যে কোনো কারণেই হোক, আমি বারবার পেছন দিকে তাকাচ্ছিলাম। ভদ্রলোকের সংলাপ বলা শেষ হলেই পিসোর স্পষ্ট অভিব্যক্তি আমার চোখে পড়ছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, এই ভদ্রলোককে যদি আমি মেনে নিই , তবে এদের বিশেষ কিছু সুবিধা হলেও হতে পারে। কিন্তু যখন ওঁকে অন্যের আগের সংলাপটা শুনে পরের সংলাপটা বলতে বলা হলো ঠিক তখনই মুশকিলটা হল। যদিও মাত্র একদিনের মধ্যে এটা করে দেখানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। বেশ কয়েকবার ধরতে গিয়ে উনি মিস করলেন। তারপর একবার উনি বললেন যে, “আচ্ছা! সিকান্দার শাহ কি উইংস-এর কোনো একটা ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন? ধরুন, আপনি সেখানে ওঁর একটা সিংহাসন তৈরি করলেন”।

আমি বুঝতে পারছিলাম , আমরা নাটকে যেভাবে দৃশ্য সাজিয়েছি উনি তার চেয়ে আলাদা একটা পদ্ধতি নিতে বলছেন। আমি বললাম, “এভাবে তো মঞ্চে কোন সিংহাসন রাখার কথা ভাবা হয়নি। এক্ষেত্রে যদি আমি রাজিও হয়ে যাই, এই এক বেলার মধ্যে সিংহাসন বানিয়ে দেবে কে?” উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “সিংহাসন রাখা যাবে? তাহলে এইটা আপনি মেনে নিচ্ছেন তো? এবার ব্যাপারটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন”। আমি বললাম, “সিংহাসন কিন্তু ব্যাকস্টেজ এর মাঝামাঝি থাকবে। উইংস এর ধারে নয়”। উনি বললেন, “নিশ্চয়ই!” তারপর দ্রুত হাতে স্ক্রিপ্টের কয়েকটা পাতা নিজের মোবাইলে স্ক্যান করে তুলে নিলেন।

পরদিন অভিনয় সন্ধে সাতটায়। প্রথম দৃশ্যের অভিনয় নিয়ে আমি একটু টেনশনে ছিলাম। সে দিন সকালেও বেশ খানিকক্ষণ রিহার্সাল হল। শশধরবাবুকে লিম্বুর একদম কাছে কাছে রেখে সংলাপ বলানো হলো। উনি অভিনয়টা বন্ধ করলেন না। কিন্তু লিম্বুকে ওনার কাছে রাখা যাবে কিভাবে আমি বিল্টুর সঙ্গে সেসব নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা করলাম। অভিনয়ের খানিকটা আগে, বিকেলের মধ্যেই বেশ বড় সাইজের একটা সিংহাসন চলে এলো। আগাগোড়া লাল সাটিনের কাপড় দিয়ে ঢাকা। এত বড়ো একটা সিংহাসন এত কম সময়ের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে এটা আমি ভাবতেও পারিনি।

প্রথম দৃশ্যে ওঁর অভিনয় নিয়ে উনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আমাকে শুরুটা ধরিয়ে দিলেই আমি শেষটা পুরো বলতে পারছি। শুরুটা ধরিয়ে দেওয়া নিয়েই প্রশ্ন। আর শুরুটা ধরতে পারলেই সারাক্ষণ সিংহাসনে বসে থাকব না আমি। উঠে একটু হাঁটাচলাও করতে পারবো। আপনি শুরুটা ধরিয়ে দিন, আমি আপনাকে এখনই করে দেখাচ্ছি”। আমি বললাম, সে আমি নয় বিশ্বাস করলাম। কিন্তু নাটক চলাকালীন আপনাকে সেই ধরিয়ে দেওয়াটাই বা হবে কিভাবে? উনি হাসলেন। তারপর বললেন, “সেটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন”। লিম্বুকে দিয়ে এই রোলটা করানো গেলে আমার বেশ ভাল লাগত। বেচারির পুরো নাটকটা প্রায় মুখস্থ। অথচ ওকে কী জানি কেন , কেউ কোনো চরিত্রে অভিনয় করানোর কথা ভাবতেই পারছে না। মনে মনে ভাবলাম, একবার আগের থেকে এসে ওকে একটা চরিত্রে আমি নিয়োগ করে তবেই যাব। এবারে তো প্রায় ভেবেই ফেলেছিলাম। কিন্তু শশধরবাবুর এত আগ্রহ আর পিসোর এত সমর্থনের জন্য আমাকে একটু পিছিয়ে আসতে হল।

সন্ধ্যেবেলা সেট সাজানো শেষ। আজ শুধু পিসেমশাইয়ের দলেরই নাটক। সেই জন্যে সময়ের ব্যাপারে ততটা বাঁধাধরা ব্যাপার নেই। সাতটার মধ্যে নাটক শুরু করলেই চলবে। শশধরবাবু লিম্বুকে একদম চোখে চোখে রেখেছেন। আমার সঙ্গে ওকে কথা বলতেই দিচ্ছেন না। ওকে কীভাবে ব্যবহার করবেন সেটা যেন ওঁর নিজস্ব ব্যাপার। ততক্ষণে আমি বিষয়টা খানিক আঁচ করতে পেরেছি। বিল্টুকে বলে দিলাম, থার্ডবেল পড়লেই যেন মিউজিক শুরু করে পর্দায় টান দেওয়া হয়। নাটক শুরু হল। আমি লিম্বুকে দেখতে পাচ্ছি না। অথচ আমি জানি ও সেখানেই আছে যেখানে আমি আন্দাজ করছি। উইংগসের ফাঁক দিয়ে সিংহাসনের পেছনে উঁকি দিতে আমার আর প্রবৃত্তি হল না। খুব একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছিল গলার কাছটায়। স্টেজের বাইরে ঠিকমতো শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা পরখ করার অছিলায়, আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। অনেক দর্শকের সমাগম হয়েছে। তাদের পেছনে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। নাটক শুরু হল। সিংহাসনে বসে আছেন সেকান্দার শাহ। বিশাল সিংহাসন। আমি বুঝতে পেরে গেছি, ওই সিংহাসনের তলায় গুটিসুটি মেরে বসতে বাধ্য করা হয়েছে লিম্বুকে। দুপাশ থেকে জোরালো স্পট এসে পড়েছে সিকান্দার শাহের মুখে। তাঁর মুখে স্মিত হাসি। গম্ভীর স্বরে তিনি তার বাঁ হাত প্রসারিত করে বলে উঠলেন, “সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”


#সিলি পয়েন্ট #গল্প #চন্দ্রগুপ্ত #অরিন্দম গোস্বামী #লিম্বু #বাংলা পোর্টাল #silly point

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219123