নিবন্ধ

মত সব নির্বিকল্প হলে পথই বিকল্প হবে না কেন!

সরোজ দরবার Sep 2, 2024 at 9:03 am নিবন্ধ

সেই কবিতা-

পশ্চিমের আকাশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে
যেন কোনো দুর্ধর্ষ ডাকাতের মত
রাস্তার মানুষদের চোখ রাঙাতে রাঙাতে
নিজের ডেরায় ফিরে গেল

সূর্য।

তার অনেকক্ষণ পরে
সরেজমিন তদন্তে
দিনকে রাত করতে
যেন পুলিশের
কালো গাড়িতে এল

সন্ধ্যা।
...

কবিতাটি চলে আরও খানিকটা। আপাতত এখানেই থামি। এই চব্বিশ সালের পশ্চিমবঙ্গে। উদ্ধৃতির ওই শেষ ক'টা লাইনের সামনে এসে দেখতে পাই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল নাগরিক মিছিলের। মিছিল কবির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কবিতায় কী অব্যর্থ এই প্রয়োগ! কবি সম্ভবত বললেন, এবং চিরকালীন। নইলে আর আজও দিন রাত হয়ে যাচ্ছে কী করে! মিছিলটার বুকে জমে উঠেছে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন, তাকে দৃষ্টিহীন ভাবা হচ্ছে কেন? তার চোখ আছে। মাথা আছে। বিবেক আছে। বুদ্ধি আছে। মান এবং হুঁশ আছে। মিছিল তো নিরাবয়ব বায়বীয় নয়। মিছিলের আর-এক নাম মানুষ। এত এত মানুষ একযোগে দৃষ্টি হারাতে যাবে কেন? যা দেখা যাচ্ছে- অল্প কিংবা বিস্তর- কেউ কেউ এসে বলছে, ওসব কিছু না। এই দ‍্যাখো হাতে মার্কার। আর এই হল ছবি। এই হল উপস্থিত নীল জামা। এই আছে, এই নেই। এই ফেক, এই ভেক। দিনকে রাত করতে! সন্ধ্যা তো আসে যেন পুলিশের কালো গাড়ি চেপেই। কবি হাসেন। মিছিল এগিয়ে যায়। 


এগিয়ে এগিয়ে সে কতদূর যাবে? মিছিল নিয়েও প্রশ্ন কম নয়। প্রথম হল, এই যে মিছিলের গৌরব উপভোগ করতে চলেছে মিছিল, তা কি আদৌ রাজনৈতিক? দল নেই। দিশা আছে? আছে বটে। একটা হেস্তনেস্ত না করে সে ছাড়বে না। কিন্তু সাত-পাঁচ দেখেই চলতে হচ্ছে। দলে দলে এমন গিটকিরি প্যাঁচ লেগে আছে, চমৎকার সব বাইনারি সাজানো, যে, একটু এদিক ওদিক হলেই কুমিরের পেটে ঢুকে বেগুন বিক্রি করতে বসার জোগাড়! দল মাত্রই মানুষের স্বাদ ভালোবাসে। তবে মানুষও কি এখন আর ততদূর দল ভালোবাসে? দলে দলে এত অনীহা কেন? সে-কথা বরং দলেরাই ভাবুক। ভোট দিতে বিয়ার খাওয়ানোর অফার দিতে হয় নাকি? ডিসকাউন্ট দিতে হয় কেন? মানুষ, তরুণ মানুষ ডেকে ডেকে বলেছে, তোমাদের একটা কথাতেও বিশ্বাস হয় না। আজ এই শাখায়, কাল অন্য শাখায় চলে যাবে। কে যাবে তখন মৃগয়ায়? প্রতিশ্রুতিদের যে কাচের গেলাসের মতো ভাঙো সব বুড়ো খোকা, তার বেলা! তার উপর সব দলেরই ঝুলির ভিতর বেড়াল। কেন খামখা সেই মিউ মিউ শুনতে যাব? সদুত্তর নেই। অতএব বুঝিয়েসুঝিয়ে বলতে হয়, দ‍্যাখো, এই হল গণতন্ত্র। যত তুমি পালাবে, তত গণতন্ত্রের পরিসর কমে যাবে। এ মোটেও বিচক্ষণের কাজ নয়। অতএব দল একটা বাছতেই হবে। তার ভিতরও আবার সতেরো রকমের প্রশ্ন। কে লেসার ইভিল? কে ধোয়া তুলসীপাতা? কে নির্বিকল্প? আর কে-ই বা বিকল্প? 

এখন, বিকল্প কীসের? মুখের বদলে মুখ। দলের বদলে দল। বদলের বদলে বদল। আর সাচ্চা বিকল্প পাওয়া না গেলে কেউ কেউ নির্বিকল্প। সে জ্যান্ত মানুষকে ধর্মের নামে পুড়িয়ে দিতে পারে। কাউকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে পারে। তারপরে তো সেই সন্ধ্যা নামার গল্প। 


এই বিকল্পহীন জলবেলুনটা টলতে টলতে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন ফেটে গেল। প্রশ্নটা এখন হল, মানুষের বিকল্প কে? মানুষ-ই। একজন পাশের মানুষ যখন ধর্ষিতা এবং খুন হয়ে যান, তাঁরই কাজের জায়গায়, আর সেই ঘটনাকে আড়াল করতে পাঁচশোজন কোমর বেঁধে নেমে পড়ে (তাদের অবশ্য মানুষ বলা চলে না), তখন মানুষ কি নিজেকে নিজের ভিতর আটকে রাখবে! এমনিতে আটকে থাকাই তার স্বভাব। নিজের ঘেরাটোপ সহজে যদি টপকানো যেত, তাহলে কবে পুঁজির কাঁথায় আগুন দিয়ে স্বপ্নের দিন ছিনিয়ে আনা যেত। তা তো আর হয় না। খাঁচা যেটুকু ব্যক্তিগত তা বেশ আঁটোসাঁটো। তার উপর আবার নানারকম সত্তা। সেই ভিত্তিতে বদলে বদলে যাওয়া স্বার্থ। এতগুলো শিক পেরিয়ে ব্যক্তি চট করে বেরিয়ে আসতেই পারে না। তবু খাঁচার ভিতর অচিন পাখি যাওয়া আসা করে। এক-এক সময় সে মন্ত্রণা দিয়ে বলে যায়, এবার বেরিয়ে এসো। তারপর একদিন আস্ত খাঁচাটাই ভেঙে দিয়ে যায়। রাস্তা জুড়ে তখন মানুষ।  মানুষে মানুষে মিললেই রাস্তা। এই মানুষ কিছুতেই আর দলে মাথা গলাতে চায় না। তার জন্য বকুনি খায় চোখা চোখা। নির্বোধ বলে পণ্ডিতেরা কটাক্ষ করে। সত্যিই তো, দল বা সংগঠন যদি না থাকে, তাহলে একটা ক্ষমতার বদল হবে কী করে? প্রশ্ন তো অমূলক নয়। যদি দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নকেই কোনও দল সামান্যীকরণ করে সময়ের গায়ে সেঁটে দেয়, তাকে কি কতগুলো মানুষ শুধু হাল্লা বোল বলে সরাতে পারে! যুদ্ধ হলে গোলাপে আর অস্ত্রে তো লড়াই হতে পারে না। হাতিয়ারের প্রতিপক্ষ হাতিয়ার। ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী অন্য এক ক্ষমতা। এই ধারণায় ভুল নেই। হয়তো দিনের শেষে এবং শুরুতেও সেটাই সত্যি। কিন্তু এই যে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠার পরিসর, তা অবশ্যই অর্জন। যদি কেউ বা কোনও দল বা কোনও কোনও  দল ক্রমাগত তা নষ্ট হতে দেয়, গ্রহণযোগ্যতা গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেয়, তবে মানুষের হাতে আর কিছু থাকে না। বরং মানুষ পায়ে হেঁটে আর-একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে চায় এই দলের ওপারে আর কোনও বাস্তবতা আছে কি না! তা কোথায় গড়িয়ে যাবে! কেউ জানে না। শুধু ঘটনা এই যে, একটা বিকল্প বাস্তবতার জন্ম হতে পারে একটি মর্মান্তিক ঘটনা থেকে। এইখানে এসে আবার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মিছিলের। তিনি মিছিলের জেগে ওঠা প্রাণের দিকে তাকিয়ে বলেন, 

কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস অন্য-

নিভন্ত আগুনের চিতায়

জন্ম নেয়

মহিমান্বিত জীবন। 


এই অন্য ইতিহাসকে আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই। চব্বিশ সালের সেই চোদ্দো আগস্টের রাত থেকেই এর স্বীকৃতি। মানুষকে যে সবজির মতো পাল্লায় তুলে কোনও একটা থলির ভিতর পুরে দেওয়া যাবে না, তা সোচ্চারে জানান দেওয়া গিয়েছে। জনমুখী প্রকল্পের বাটখারা থেকে মানুষের ওজন কিঞ্চিৎ বেশিই। দল, সবরকমের দলই মানুষের সে ওজন বুঝতে পেরেছে। আর মানুষ বুঝেছে, এই ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়ে একটা নতুন কোনও রূপ আবিষ্কার করা যেতেই পারে। হয়তো একটু বেশিই কল্পনা। কিন্তু কল্পনা না করতে পারলে আর মানুষ কীসের! তা ছাড়া মানুষের যে ইতিহাস, তা যদি আত্মোপলব্ধির হয়ে থাকে, তবে মানুষ তার দিকেই তো ক্রমশ এগোবে। তা থেকে দূরে থাকাই আত্মচ্যুতি। ফলত সময়ের নাড়িতে যে বাস্তবতা বেজে ওঠে মানুষ তার স্পন্দন অনুভব করে। খোপে বাঁধা মানুষ থেকে এসে দাঁড়ায় বাইরে। এই বাহির-হয়ে-আসা মানুষকে তখন আর সহজে চিনতে পারা যায় না। সে দক্ষিণপন্থাকে প্রতিরোধ করছে, বামপন্থার সঙ্গে একরকম আত্মিকতা টের পাচ্ছে, আবার যে-কোনোরকম দলের কেন্দ্রিকতা যে বিপদ ডেকে আনে সে বিষয়েও সে সতর্ক। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একেবারে আলাদা একটা অবস্থান। শঙ্খবাবু বলেন, 'সংঘ গড়ে উঠবার পর, ক্ষমতা সেখানে কেন্দ্রীভূত হতে থাকবার পর, সেটাকে ভাঙা ছাড়া আর পথ থাকে না। সেই ভাঙা থেকে হয়তো আরেকটা সংঘ হবে, আবার তাকে ভাঙতে হবে, এইভাবে একটা চলার দিশা তৈরি হতে পারে।' এই যে ভাঙা ছাড়া পথ থাকে না, সেই সময়টি, সেই পথটি কেমন হবে? সেই ভাঙা-পথেরই রাঙা ধুলো এখন মিছিলে।


মিছিলের দায়িত্ব যদিও কম কিছু নয়। স্লোগান এবং গান। দাবি-দাওয়া। দফা-সনদ। সে তো থাকছেই। তবে মিছিলকে যেতে হবে গ্রামের কাছে। উপনিবেশ যে নগরকেন্দ্রিকতার ব্যাঙের রক্ত ইয়ার্কি মেরে আমাদের শিরায় ঢুকিয়ে দিয়েছে তা ঝেড়ে ফেলা জরুরি। মিছিলকে যেতে হবে সব শ্রেণির মানুষের কাছে। মিছিলকে এগিয়ে যেতে হবে দিশার দিকে। মিছিলকে প্রমাণ করতে হবে, সে অরাজনৈতিক ছিল না কখনও। দলের হলেও নয়, দল ছাড়া হলেও নয়। কেন-না মানুষ অরাজনৈতিক নয়। অতএব মিছিলের স্বর স্পষ্ট হতে হবে। সেই চোদ্দো তারিখ মাঝরাতে ক্লান্ত দম্পতির কাছে ভাড়া চাইতে লজ্জা পেয়েছিলেন যে রিকশাচালক, তাঁর জন্য মিছিলকে আরও তীক্ষ্ণ হতে হবে। চোদ্দোদিন পরেও যানজটে বিরক্ত না হয়ে বাস থেকে জমায়েতে হাততালি দিতে দিতে নেমে এলেন যাঁরা, তাঁদের জন্য মিছিলকে আরও সাহসী এবং দৃঢ় হতে হবে। প্রবহমানতা তার ধর্ম। স্থির সময়টার ভিতর সে যে আলোড়ন তুলেছে, যে কমরেডশিপ জাগিয়ে তুলেছে, তার মূল্য কম নয়। এ-ও একরকম রাজনৈতিক অনুশীলন। একটা মিছিল বাইরে চলেছে। একটা অন্তরে। যেন ভুলে না যাই! যেন অপরাধীকে ক্ষমা না করি! বাইরের মিছিল বাস্তবে ফুরোলেও মনের মিছিল ফুরোয় না। সেইটেই সবথেকে বড় কথা। মিছিল তখন আলো হয়ে ওঠে। মিছিলের মুখ দেখে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তা-ই বলেন,


আলোটা জ্বালতেই

জানলা দিয়ে বাইরে

লাফিয়ে পড়ল


অন্ধকার। 


পর্দাটা সরাতেই 

ভয়চকিত হরিণীর মতো

 আমাকে জড়িয়ে ধরল 


হাওয়া।   


অন্ধকার কেটে গেলে আসে হাওয়া। হাওয়া একদিন বদলায়। বদলে দিতে পারে বলেই মিছিল এখনও এগিয়ে যায়। 


অলংকরণে ব্যবহৃত আলোকচিত্র : বিবস্বান 


#মিছিল #কবিতা #Justice #agitation

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

19

Unique Visitors

219063