প্লাস্টিক থেকে আইসক্রিম : সৌজন্যে ব্যাকটেরিয়া
প্লাস্টিক দূষণ – এই ব্যাপারটা সম্পর্কে সম্ভবত কোনও নান্দীমুখ দরকার পড়ে না। আমাদের নীল গ্রহের স্বাস্থ্যের জন্য এ এক মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ। জল এবং স্থল, এই দুই ধরনের পরিবেশকেই সোজা ভেন্টিলেশনে পাঠিয়ে দেওয়ার এমন ক্ষমতা বোধকরি আর কারো নেই। সমতল জমি থেকে এভারেস্টের শৃঙ্গ, রিসর্টের গা-ঘেঁষা সমুদ্রসৈকত থেকে সমুদ্রের গভীরে প্রবাল প্রাচীর – সর্বত্র ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে গেছে প্লাস্টিক। আর এই প্লাস্টিকের বেশির ভাগটাই আমাদের ফেলে দেওয়া বোতল, খাবারের প্যাকেট, ব্যবহৃত ডায়াপার, অকেজো খেলনা ইত্যাদি। তাই নিজেদের পাপের স্খালন করতে আমরা দ্বারস্থ হয়েছি বিজ্ঞানের, তার হাত ধরেই খুঁজে বের করেছি প্রকৃতির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এমন কিছু অণুজীব যারা প্লাস্টিককে ভেঙ্গে, খেয়ে, হজম করতে সক্ষম।
প্রকৃতির ভাঁড়ারে এত সহজ সরল খাবার থাকতে এরা খামোখা প্লাস্টিক খেতে যায় কেন? তার জন্যও আমরাই দায়ী; পৃথিবীতে দূষণের পরিমাণ যত বেড়েছে, এই অণুজীবদের স্বাভাবিক খাদ্যে ততই অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্লাস্টিকের। নানা প্রকার অণুজীবদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াদের আধিপত্য স্বভাবতই বেশি, তাদের মধ্যেও কুলীন হল সিউডোমোনাস গোত্রের ব্যাকটেরিয়া। সেই যে সুকুমার রায় লিখেছিলেন, “আহা, ব্রাহ্মণের সে তেজ নাই, খাদ্যাখাদ্য ভেদ নাই”, তা সিডোমোনাসদের খাদ্যাখাদ্য ভেদ না থাকলেও তেজ আছে ষোলো আনা। বাঙালি বিজ্ঞানী আনন্দমোহন চক্রবর্তী দেখিয়েছিলেন সিউডোমোনাস পেট্রোলিয়াম খেয়ে হজম করতে পারে, আর এখন জার্মানির একদল বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন একজাতের সিউডোমোনাস পলি-ইথিলিন টেরেফথ্যালেট (PET) খেয়েও সুখের ঢেঁকুর তোলে। এই ‘PET’ হল যাবতীয় বোতল, প্যাকেট, সস্তার খেলনা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক উপাদান। আগেও এমন ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে যারা PET-কে ভাঙ্গতে পারে, তাহলে এই নতুন জাতের সিউডোমোনাস আলাদা কোথায়? তার কারণ অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া PET ভাঙ্গলে বেশ কিছু ক্ষতিকারক রাসায়নিক অবশেষ তৈরি হয়, নতুন সিউডোমোনাস প্রজাতিটি সেগুলোকেও দিব্যি খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।
তবে বিজ্ঞান তো আর অল্পেই থেমে থাকে না, তার ধর্মই হল উন্নতির পথে এগিয়ে চলা। সিউডোমোনাসের থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী কাউকে পাওয়া গেলে অনেকটা পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য একলপ্তে সাফ করে ফেলা যায়, কোনোরকম দূষণের ঝঞ্ঝাট ছাড়াই। চাহিদা অনুযায়ী মাটির জীববৈচিত্র্য থেকে পাওয়াও গেল এক ব্যাকটেরিয়া – আইডিওনেলা (Ideonella sakaiensis)। এদের এককোশী শরীরে দুখানা আলাদা আলাদা উৎসেচক তৈরি হয় – একটি PET-কে ভেঙ্গে উৎপন্ন করে মনো-হাইড্রক্সি-ইথাইল টেরেফথ্যালেট (MHET) আর অন্যটি MHET-কে ভেঙ্গে টেরেফথ্যালিক অ্যাসিড বা টেরেফথ্যালেট বানায়। যেহেতু দুটো আলাদা উৎসেচক PET-এর মতো জটিল যৌগ ভেঙ্গে সরল যৌগে পরিণত করে, তাই আইডিওনেলা অনেকটা খাবার গোগ্রাসে গিলতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, প্রতিবার আইডিওনেলার উপর ভরসা করে থাকার চেয়ে কোনোভাবে যদি উৎসেচক প্রোটিন দুটো নিজেরাই বানিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তো প্লাস্টিক পচানো আরোই সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া গবেষণাগারে বা শিল্পে, বিজ্ঞানের যাবতীয় কারিগরি দেখানোর অন্যতম হাতিয়ার দুই ব্যাকটেরিয়া – ব্যাসিলাস (Bacillus) এবং ই. কোলাই (E. coli)। এরা প্রকৃতিতে সহজলভ্য ও অধিকলভ্য; তার উপর এদের জিনগত কারিকুরি করার কৌশল আমাদের জানা। তাই যে কোনও প্রোটিনকে একবার এদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। এরা সেই প্রোটিন বেশি বেশি করেও বানাবে, যেখানে দরকার সেখানে বংশবিস্তার করে প্রোটিনের ক্ষমতাও দেখাবে। বিজ্ঞানীরা তাই আইডিওনেলার ডিএনএ থেকে ওই দুইরকম উৎসেচক বানানোর সংকেত ধার করলেন, তাদের একসঙ্গে জুড়ে বসিয়ে দিলেন ই. কোলাই-এর ডিএনএ-তে। সেখান থেকে তৈরি হল সংকর-প্রোটিন বা কাইমেরা-প্রোটিন, যার কর্মক্ষমতা ঐ দুই প্রোটিনের আলাদা কর্মক্ষমতার মিলিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন : জিন নিয়ে কারিকুরি, খোদার উপর খোদকারি? / সায়নদীপ গুপ্ত
এত ভাঙ্গাভাঙ্গির শেষে যে টেরেফথ্যালেট তৈরি হয়, তা নিজে কিন্তু খুব একটা সরল প্রকৃতির নয়! তাকে যদিও পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবু অতিরিক্ত টেরেফথ্যালেট দিয়ে কী করা হবে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত ছিলেন না। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের দুই বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত উৎসেচক দিয়ে, পাঁচটি ধাপে, টেরেফথ্যালেট থেকে ভ্যানিলিন তৈরি করা সম্ভব। ভ্যানিলা ফলের গন্ধ এবং স্বাদের মূল কারণ হল এই ভ্যানিলিন। আমরা যে ভ্যানিলা এসেন্স কেক-মিষ্টি-আইসক্রিমে ব্যবহার করি তা মূলত ভ্যানিলিন-সমৃদ্ধ মিশ্রণ। শুধু খাদ্যজাত শিল্পে নয়, ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পেও ভ্যানিলিনের যথেষ্ট চাহিদা। ২০১৮ সালে ভ্যানিলিনের বার্ষিক চাহিদা ছিল প্রায় ৩৭,০০০ টন, যা কিনা ২০২৫ সাল নাগাদ প্রায় ৬০,০০০০ টন অবধি যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে গাছগাছড়া এবং কৃত্রিম রাসায়নিক পদ্ধতি মিলিয়ে ভ্যানিলিনের মোট উৎপাদন এই চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম। তাই জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে এর সমাধান করা আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় স্কটিশ বিজ্ঞানীদের দেখানো পথ প্রায় অযাচিত আশীর্বাদ। এক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধাপের রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যবহৃত পাঁচটি আলাদা উৎসেচকের ডিএনএ সংকেত ই. কোলাই-তে জুড়ে সেখানেই তাদের বেশি করে উৎপন্ন করা হয়। স্বাভাবিক ঘরোয়া উষ্ণতায় মোটামুটি ৮০% PET-কে পুরোপুরি ভ্যানিলিনে পরিণত করা যায়। সামান্য পরিশোধনের পরেই তা হয়ে ওঠে শিল্পে ব্যবহারের উপযুক্ত।
আরও পড়ুন : অন্ত্রবাসী অণুজীব : এমন বন্ধু আর কে আছে! / টিম সিলি পয়েন্ট
এই ধরনের গবেষণার মূল লক্ষ্য হল sustainable development বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন, যে উন্নয়নের জোয়ারে জীবজগৎ খাবি খাবে না, বাতাস ভারী হবে না, পৃথিবীটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে না। এমন উন্নয়নের শরিক হতে চাইলে আমাদেরও তার যোগ্য হওয়ার দায় থাকে। আইসক্রিম খেয়ে প্লাস্টিকের বাটিটা রাস্তায় ফেলে দেওয়ার সময় মাথায় রাখবেন, ঐটিই কিন্তু নানা রাস্তা ঘুরে আপনার জিভে ঠাঁই পাবে। আর কিছু না হোক, নিজের কথা ভেবেই না হয় একটু সংযত হলেন! প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের আবর্জনা না ফেলা, প্লাস্টিকের পরিবর্তে যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব কোনও বিকল্প ব্যবহার করা – এইটুকু যদি আমরা কঠোর ভাবে পালন করি, পৃথিবীটা হয়তো আগামী শিশুদের জন্য সত্যি বাসযোগ্য করে রেখে যেতে পারব।
........................
তথ্যসূত্র :
১) Toward biorecycling: Isolation of a soil bacterium that grows on a polyurethane oligomer and monomer, 2020, Frontiers in Microbiology
২) Characterization and engineering of a two-enzyme system for plastics depolymerization, 2020, PNAS
৩) Microbial synthesis of vanillin from waste poly-ethylene terephthalate, 2021, Green Chemistry