নারীচরিত্রে পুরুষের বদলে চাই নারী : মধুসূদনের শর্তেই ভেঙেছিল বাংলা থিয়েটারের সংস্কার
১৮৭২ সালের শেষ দিক। মাইকেল তখন শয্যাশায়ী। জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। ঋণে আপাদমস্তক ডুবে। সেই সময় নতুন একটি নাটক লেখার প্রস্তাব পেলেন। একটি নতুন থিয়েটার পথ চলা শুরু করবে তাঁর লেখা নাটক দিয়ে। অশক্ত শরীরেও মাইকেল রাজি হলেন। কারণ পারিশ্রমিকটুকু তাঁর বড়ো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু লেখার শর্ত হিসেবে মাইকেল পাল্টা একটি প্রস্তাব দিলেন। সে-সময়ের নিরিখে, বিস্ফোরক প্রস্তাব। কিন্তু শেষমেশ এই দুঃসাহসিক প্রস্তাবই যুগান্তকারী বলে সাব্যস্ত হল।
বাংলা থিয়েটারের গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছিল এই ১৮৭২ সালেই, ন্যাশনাল থিয়েটারের হাত ধরে। একইসঙ্গে বাংলা থিয়েটারের মধ্যে এক লাওভজনক ব্যবসারও সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ফলে ন্যাশনাল থিয়েটার নিজে দীর্ঘস্থায়ী না হলেও পাকাপোক্ত রাজপথ তৈরি করে দিয়ে গেল পেশাদার থিয়েটারের জন্য। বাংলার প্রথম পেশাদার থিয়েটারের দেখা পাই ১৮৭৩ সালে। বেঙ্গল থিয়েটার। উদ্যোক্তা ছিলেন কলকাতার ধনকুবের সাতুবাবুর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর সুহৃদ বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা ঠিক করেছিলেন, মাইকেলের লেখা নতুন নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের পথ চলা শুরু হবে। কিন্তু মাইকেল দাবি করলেন, মহিলাচরিত্রে নিতে হবে মহিলাদেরই। অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন - "মাইকেল মধুসূদনের পরামর্শে থিয়েটরে অভিনেত্রী লওয়া স্থির হইল। তিনি বলিলেন তোমরা স্ত্রীলোক লইয়া থিয়েটর খোল; আমি তোমাদের জন্য নাটক রচনা করিয়া দিব; স্ত্রীলোক না লইলে কিছুতেই ভাল হইবে না।"…
শর্ত রক্ষা করা সহজ ছিল না একেবারেই। মহিলাচরিত্রে ইতোপূর্বে পুরুষ অভিনেতারাই অভিনয় করতেন। অনেক ক্ষেত্রেই বিসদৃশ হত সে-অভিনয়। কিন্তু উপায় ছিল না। উনিশ শতকের রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ তথাকথিত 'ভদ্র' ঘরের মহিলাদের তো আর জনসমক্ষে মঞ্চে উঠতে দেবার কথা ভাবতেই পারে না। তাহলে অভিনেত্রী আসবে কোত্থেকে? পতিতাপল্লি থেকে। সেটাও কি মেনে নেওয়া যায়? ১৮৩৫ সালে নবীন বসুর থিয়েটারে 'বিদ্যাসুন্দর' পালা অভিনয়ের সময় নায়িকা চরিত্রে এক বারাঙ্গনা মহিলার অভিনয় নিয়ে নিন্দা আর কুৎসার বন্যা বয়ে গেছিল। তারপর দীর্ঘ প্রায় অর্ধ শতক বাংলা থিয়েটার নারীবর্জিত থেকেছে। নারী মঞ্চের অধিকার পায়নি। সেই দীর্ঘ অভিশাপ শেষ হয়েছিল কার্যত মাইকেলের এই শর্তের সূত্র ধরেই। এই প্রস্তাবে শরৎচন্দ্র ও বিহারীলালের পুরোপুরি সমর্থন ছিল। নারীচরিত্রে নারীকে দিয়েই অভিনয় করানো হোক, এমন দাবি যে কোনও কোনও মহল থেকে উঠে আসছিল না, তা নয়। কিন্তু সনাতনপন্থীদের ভ্রুকুটির সামনে তা নেহাতই কমজোরি ছিল। নারীমুক্তি-আন্দোলনের পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি। শরৎচন্দ্র ও বিহারীলাল বেঙ্গল থিয়েটারের সার্বিক সাহায্য ও পরামর্শের জন্য একটি কমিটি তৈরি করেছিলেন, যাতে বিদ্যাসাগর, মাইকেল ছাড়াও ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত, সত্যব্রত সামশ্রমী, হরিদাস দাস, প্রিয়নাথ বসু প্রমুখ। কমিটির সদস্যদের মধ্যেই এই নিয়ে তীব্র মতভেদ হল। বিদ্যাসাগর এই 'বেমক্কা' প্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে শুধু কমিটিই ত্যাগ করলেন না, অতঃপর বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে সমস্তরকম সংশ্রবই ত্যাগ করলেন। অন্যদিকে অভিনেত্রী-নিয়োগের সপক্ষে মত দিলেন উমেশ দত্ত ও সত্যব্রত সামশ্রমী। বিদ্যাসাগর নারীমুক্তির সামাজিক আন্দোলনের নিতান্ত ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকে ব্যাপারটাকে ক্ষতিকর বলে মনে করেছিলেন। তাঁর এই মতামত বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় ঠিকই, কিন্তু সে-সময়ের রক্ষণশীল বাঙালির বক্তব্যের সঙ্গে এক করে দেখলে তাঁর বক্তব্যের যথার্থ মূল্যায়ন হবে না। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। আসল কথা হচ্ছে, তীব্র বিতর্ক সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র ও বিহারীলাল অভিনেত্রী-নিয়োগের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিলেন। চারজন অভিনেত্রী নেওয়া হল। বলাই বাহুল্য, পতিতাপল্লি থেকে। জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী, শ্যামাসুন্দরী। মাইকেলও হাত দিলেন নতুন নাটকে। 'মায়াকানন'। 'কৃষ্ণকুমারী'-র পর আবার নাটক লেখায় প্রবৃত্ত হলেন তিনি। মায়াকানন ছাড়াও আরও একটি নাটক লিখতে শুরু করলেন। 'বিষ না ধনুর্গুণ'।
'বিষ না ধনুর্গুণ' অসমাপ্ত রেখে মাইকেল মারা যান। অনেকের মতে, মাইকেল 'মায়াকানন'-ও নিজে শেষ করে যেতে পারেননি। এই নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তাদের যাত্রা শুরু করতে পারেনি। মাইকেল মৃত্যুবরণ করেন ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন। বেঙ্গল থিয়েটার তার মাস দেড়েক পর ১৬ আগস্ট যাত্রা শুরু করে মাইকেলের প্রথম নাটক 'শর্মিষ্ঠা' দিয়ে। প্রথম রজনীর অভিনয় উৎসর্গ করা হয় মাইকেলেরই নামে। পেশাদার থিয়েটারে মঞ্চাবতরণ ঘটল দুজন অভিনেত্রীর। নিন্দার ঝড় বয়ে গেল পত্রপত্রিকায়। 'ভারত সংস্কারক' পত্রিকা ২২ আগস্ট লিখল, "আজি কালি কলিকাতায় বড় নাটকের প্রাদুর্ভাব দেখা যাইতেছে। একদল সাতুবাবুর বাড়ির সম্মুখে একটি নাট্যশালা নির্মাণ করিয়াছেন। গত শনিবার তথায় মৃত মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রণীত 'শর্মিষ্ঠা' নাটকের অভিনয় হইয়াছিল। অভিনেতাদিগের মধ্যে দুইজন বেশ্যাও ছিল। এ পর্যন্ত আমরা যাত্রা, নাচ, কীর্তন, ঝুমুরেই কেবল বেশ্যাদিগকে দেখিতে পাইতাম, কিন্তু বিশিষ্ট বংশীয় ভদ্রলোকদিগের সহিত প্রকাশ্যভাবে বেশ্যাদিগের অভিনয় এই প্রথম দেখিলাম। ভদ্রসন্তানেরা আপনাদিগের মর্যাদা আপনারা রক্ষা করেন, ইহাই বাঞ্ছনীয়।" অমৃতবাজার পত্রিকা লিখল, "রঙ্গভূমিতে স্ত্রীলোকের অংশ স্ত্রীলোকের দ্বারা অভিনীত হইলে অভিনয় সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। কিন্তু এই স্ত্রীলোকের অংশ সকল সমাজপরিত্যক্তা ধর্ম-ভ্রষ্টা স্ত্রীলোকদিগের দ্বারা অভিনীত হইলে জনসমাজে পাপ ও অমঙ্গল বৃদ্ধি হয় কিনা, তাহা পরীক্ষাসাপেক্ষ। 'বেঙ্গল-থিয়েটার' কোম্পানী এই দুরূহ পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ... নাটকাভিনয়ে উন্নতি করিতে গিয়া যদি সমাজের একজন লোককেও আমাদের পরিহার করিতে হয়, তাহা হইলে সে ক্ষতির আর পূরণ করা হইবে না।"
আরও পড়ুন : সম্পাদক মধুসূদন / আহ্নিক বসু
বেঙ্গল থিয়েটার কিন্তু পিছিয়ে এল না। পরের বছরই গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনেতা হিসেবে যোগ দিলেন পাঁচজন নারী। রাজকুমারী, ক্ষেত্রমণি, যাদুমণি, হরিদাসী আর কাদম্বিনী। রক্ষণশীল বাঙালি মুখে 'বয়কট' ধুয়ো তুললেও থিয়েটারের টিকিট-বিক্রির অঙ্ক কিন্তু উল্টো কথা বলল। বাঙালির দুমুখোপনাকে বেপরদা করে থিয়েটারে টিকে গেলেন গোলাপ, এলোকেশীরা।
মাইকেলের অসম্পূর্ণ নাটক 'মায়াকানন' অন্য লেখককে দিয়ে সম্পূর্ণ করিয়ে ১৮৭৪ সালের ১৮ এপ্রিল মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। সম্ভবত সংবাদ প্রভাকরের সহ-সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নাটকটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিছু জায়গায় পরিমার্জনাও করেছিলেন। মাইকেল তাঁর কাঙ্ক্ষিত দিনটি দেখে যেতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর শর্ত আর বেঙ্গল থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের সাহসের কারণেই বাংলা থিয়েটারে নতুন যুগ এল। গোলাপ, এলোকেশীদের পথ ধরে এসে পড়লেন প্রমদাসুন্দরী, বিনোদিনী, তিনকড়ি ও আরও অনেকে। অপমান, লাঞ্ছনার পঙ্কিল জীবন পেরিয়ে বেঁচে থাকার নতুন রসদ খুঁজে পেলেন ব্রাত্য নারীরা। এ-বছর বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রী-নিয়োগের ১৫০ বছর পূর্ণ হবে। আর ঘটনাচক্রে এ-বছরই ২০০ বছরে পা রাখলেন মাইকেল।
..................
ঋণ : ১) আশার ছলনে ভুলি , গোলাম মুরশিদ
২) রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী, অমিত মৈত্র
#bengali theatre #Michael Madhusudan Dutt #আহ্নিক বসু