সার্নে 'ঈশ্বরকণা' আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন হাওড়ার শ্রমিকেরা : অন্যরকম বিশ্বকর্মাদের গল্প
২০১২ সালে জেনেভার সার্নের গবেষণাগারে ‘ঈশ্বর কণা’ হিগ্স-বোসনের আবিষ্কারে তোলপাড় হয়েছিল গোটা বিশ্ব। ওই বিপুল কর্মকাণ্ডের কিছু যন্ত্রাংশ তৈরিতে অবদান ছিল হাওড়ার বাঁকড়ার বলরাম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের। এই অসামান্য আবিষ্কারের সঙ্গে যে পাকেচক্রে হাওড়ার তিন-চারজন শ্রমিকের নামও জুড়ে আছে, তা অনেকেই জানেন না।
সার্নে মাটির নিচে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল। মহাবিশ্বের সৃষ্টি-রহস্য জানার জন্য সেই সুরঙ্গের মধ্যে দু-দিক থেকে ধেয়ে আসা অতি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণার সংঘর্ষ বা কলিশন ঘটানো হয়েছিল। এ কাজের জন্য পরীক্ষাগারে বসানো হয়েছিল মিউয়ন ডিটেক্টর। বিগ ব্যাং মানে সৃষ্টির সময়কালের মতো শক্তিসম্পন্ন বিস্ফোরণ হলে অতি শক্তিধর অব-পারমাণবিক কণা মিউয়নের নির্গমন হবার কথা। কিন্তু পৃথিবীতে, ভূগর্ভে বা অতি শক্তিধর মহাজাগতিক মিউয়ন, যারা প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের আগমনে পরীক্ষার ব্যাঘাত যাতে না ঘটে, তাই ডিটেক্টরের আগে লাগানো হয়েছিল এক বড়সড় অ্যাবজ়র্বার, যা মূলত পার্থিব মিউয়নকে আটকে দেবে। এ কাজের একটি অংশের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স। প্রতাপ ভট্টাচার্য ছিলেন সেখানে প্রজেক্ট লিডার। পরামর্শদাতা হিসেবে ছিলেন বিল্বদল বন্দ্যোপাধ্যায়। অ্যাবজ়র্বার বানানোর সূত্রেই দুর্গাপুরের অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্টের উদ্যোগে এই প্রজেক্টের সঙ্গে ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েন রজনী মুখোপাধ্যায় আর তাঁর ছেলে অর্জুন মুখোপাধ্যায়। তাঁদের প্লেটের ডিজ়াইন আর অটোক্যাড ড্রয়িংয়ের নকশা সার্নের বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করলেন। স্থির হল, পাত তৈরির কাজ হবে রজনীবাবুর হাওড়ার কারখানায়। সেই সময় বড় কোম্পানির সিএনসি বা ‘কম্পিউটার এডেড নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোলড মেশিন’ না নিয়ে হাওড়ার কারখানায় কেন কাজটা করার কথা হল? সমস্যা ছিল দু’মিটার মানে ছ’ফুটেরও বড় ব্যাসের সিএনসি মেশিন পাওয়া। অবশ্য বড় সিএনসি ভার্টিকাল মেশিনিং সেন্টার ছিল রাঁচির এইচইসি-র মতো কয়েকটি সংস্থায়। কিন্তু কাজটার জন্য আসলে প্রয়োজন ছিল হাতের নৈপুণ্য, অর্থাৎ দক্ষ কারিগর। রজনীবাবুর নেতৃত্বে কাজের ভার পড়ল কারখানার কারিগর বিফল রায়, বাবান ঘোষ, কালীপদ প্রামাণিকদের ওপর। কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট নিয়মিত সার্নে পাঠানো হত। সার্নের পক্ষ থেকে বিজ্ঞানী ক্রিস ফ্যাবিয়ার আর হান্স ট্যুরেগ সরেজমিনে হাওড়ার কারখানায় কাজ দেখতে এসে খুব একটা ভরসা করতে পারেননি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সার্নের মাটির নীচে ৫৭৪ ফুট গভীরে লাগানোর সময় দেখা গেল যে, বিপুলায়তন যন্ত্রাংশগুলিতে মাপের এক ইঞ্চিও এদিক-ওদিক হয়নি। নিজের সমস্ত পুঁজি নিয়ে এই প্রজেক্টে বাজি ধরেছিলেন রজনী মুখোপাধ্যায়। এই সাফল্য তাঁর। তবে সাফল্যের আসল কারিগর রজনীবাবুর বিশ্বকর্মারা। বিফল রায়, বাবান ঘোষদের নাম কেউ জানে না। কিন্তু 'ঈশ্বরকণা'-র সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তাঁরাও।
ঋণ : জিষ্ণু বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা
....................