হরিপ্রভা তাকেদা-র ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ : একটি অসাধারণ সামাজিক-ঐতিহাসিক দলিল
বই : বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা ও অন্যান্য রচনা লেখক : হরিপ্রভা তাকেদা সংকলন ও সম্পাদনা : ড মঞ্জুশ্রী সিংহ প্রকাশক : ডি এম লাইব্রেরি
..................
১৯০৭ সালের কথা। ইতিহাসে এই প্রথম কোনও বাঙালি মেয়ে বিয়ে করলেন এক জাপানি পুরুষকে। শুধু তাই নয়, যে সমাজে কালাপানি পার হওয়া মানুষ মারার চেয়েও বড় অপরাধ বলে গণ্য হত, সেই সমাজের এক মহিলা বিয়ের বছর পাঁচেক পর স্বামীর সঙ্গে জাপান যাত্রাও করলেন। ৩ নভেম্বর, ১৯১২ সালে ঢাকার স্টিমার ঘাট থেকে স্বামী ওয়েমন তাকেদার সঙ্গে হরিপ্রভা রওনা হয়েছিলেন প্রথমে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে, সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা, কলকাতা থেকে জাহাজে জাপান। এর আগেও কোনও কোনও বঙ্গনারী কালাপানি পেরিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন। কিন্তু হরিপ্রভা তাকেদা ইতিহাসে থেকে গেলেন অন্য একটা কারণে। তিনিই প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি জাপানে গেছিলেন। আর জাপানের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে ক্ষুদ্রায়তন বইটি তিনি লিখেছিলেন, সেটিই সম্ভবত জাপান বিষয়ে প্রথম বাংলা বই। রবীন্দ্রনাথের ‘জাপান যাত্রীর ডায়েরি’ বেরোনোর চার বছর আগে প্রকাশিত হয় তাঁর সেই বই। বহুদিন ছাপা না থাকার পর ২০০৯ সালে ডি এম লাইব্রেরি আবার এই বইটি প্রকাশ করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।
হরিপ্রভার জন্ম ১৮৯০ সালে ঢাকার খিলগাঁও গ্রামে এক প্রগতিশীল উদারনৈতিক পরিবারে। বাবা শশীভূষণ মল্লিক ও মা নগেন্দ্রবালা। চার সন্তানের মধ্যে হরিপ্রভা ছিলেন সবার বড়। ব্রাহ্ম-আদর্শে বিশ্বাসী শশীভূষণ ছিলেন সে সময়ের একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। নিরাশ্রয় মহিলা, শিশু ও দুঃস্থদের জন্য প্রায় একার চেষ্টায় তিনি ‘উদ্ধারাশ্রম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান (পরে নাম পাল্টে হয় ‘মাতৃনিকেতন’) গড়ে তুলেছিলেন। এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন হরিপ্রভাও। পরিবারে এই উন্নত মানসিকতার আবহ ছিল বলেই নিজের পছন্দে এক বিদেশিকে বিয়ে করতে বেগ পেতে হয়নি হরিপ্রভাকে। ওয়েমন তাকেদা ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত ‘বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরি’-র প্রধান কারিগর। বিশেষ কোনও সূত্রে মল্লিক পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, যা ধীরে ধীরে আত্মীয়তার দিকে গড়ায়।
১৯০৭ সালে ওয়েমনের সঙ্গে বিয়ের সময় হরিপ্রভার বয়স ছিল ১৭ বছর। প্রথমবার জাপান যাত্রার সময় তাঁর বয়েস ২২। দীর্ঘ যাত্রাপথের বিভিন্ন অনুভূতি এবং সেবার মাস চারেকের জন্য জাপান বাসের অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর এই বইতে। টোকিওর অদূরে নাগোয়া শহরে ওয়েমনের পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে খুব ভালো লেগেছিল তাঁর। বিশেষত, শাশুড়ির আন্তরিক ব্যবহার তাঁকে আপ্লুত করেছিল। ষাট বছর বয়সেও তাঁর পরিশ্রম করতে পারার ক্ষমতা দেখে হরিপ্রভা অবাক হয়েছিলেন। তাকেদা-দম্পতি ভারতবর্ষ থেকে এসেছেন শুনে স্থানীয় মানুষজন খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। হরিপ্রভা লিখেছেন– “আমাদের আসার সংবাদ শুনিয়া অনেক লোক সর্বদাই আমাদের দেখিতে ও ভারতের কথা শুনিতে আসিতেন। আমাদের দেশের আহারাদি পরিচ্ছদ, আচার, রীতি, ধর্ম, আমার আত্মীয়বর্গ ইত্যাদি অনেক বিষয় সম্বন্ধে অনেকে জিজ্ঞাসা করে জানিলেন। তাকেদাসান বুদ্ধদেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং অন্যান্য ভারতীয় মহাপুরুষ, ভারতের সতীধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে গল্প বলিতেন। গল্প শোনার জন্য সন্ধ্যাকালে পাড়ার ছোট ছোট মেয়েরা দিবসের কাজ শেষ করিয়া আসিয়া জড় হইত।” জাপানের মন্দির, নববর্ষের উৎসব, মেয়েদের স্কুল, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিকতা, আচার-অনুষ্ঠান, গৃহস্থালির খুঁটিনাটি ইত্যাদি নানা বিষয়ের পরিচয় তিনি দিয়েছেন। তিনি দেখেছিলেন, জাপানে মেয়েরা ভারতবর্ষের মতো পর্দানশিন বা গৃহসীমায় আবদ্ধ নয়। “বাজারে, দোকানে, স্টেশনে, পোস্টাফিসে সর্বত্র মেয়েরা কাজ করে। আমোদ প্রমোদ স্থলে যেখানে অত্যন্ত জনতা হয়, মেয়েরা সেখানে তত্ত্বাবধান করে। তামাশা দেখার জন্য টিকিট বিক্রয়াদি মেয়েরাই করে। মেয়েদের অবরোধ নাই; তাহারা পুরুষের সঙ্গে একত্রে কাজকর্ম করে, চলে ফেরে, তাহাতে কোন বাধা বা সঙ্কোচ নাই।”
জাপানের মানুষজনের ব্যবহারে নম্রতা ও শিষ্টতা হরিপ্রভার ভালো লেগেছিল। তিনি লিখেছেন, “অভিবাদন, ধন্যবাদ প্রদান যেন প্রতি কথায় লাগিয়াই রহিয়াছে। একটু অনুগ্রহ পাইলেই মাথা নীচু করিয়া ধন্যবাদ প্রদান করিতে থাকে। কথা বলিবার এরূপ রীতি যে, তাহাতে নিজের ক্ষুদ্রতা প্রকাশ পায় ও অপরকে যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হয়।” জাপানে বৌদ্ধ ও সিন্তো (হরিপ্রভার বানানে ‘ষিন্তো’) ধর্ম সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল। জন্ম-মৃত্যুতে সামাজিক অনুষ্ঠান থাকলেও বিয়েতে কোনও অনুষ্ঠানের বালাই নেই।
সেবার চার মাস জাপানে কাটিয়ে ১৩ এপ্রিল ওয়েমনের সঙ্গে হরিপ্রভা দেশের উদ্দেশে রওনা হন এবং ২৫ মে ভারতবর্ষের মাটিতে পা রাখেন। এই চার মাসের অভিজ্ঞতা নিয়েই ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’। এর বাইরেও জাপান বিষয়ক আরও দুটি নিবন্ধ তিনি লিখেছিলেন, যা ডি এম লাইব্রেরির এই সংস্করণটিতে যুক্ত হয়েছে। ‘জাপানে সন্তান পালন ও নারী-শিক্ষা’ এবং ‘যুদ্ধ-জর্জরিত জাপানে’। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকেদা-দম্পতি এরপর আরও দুবার জাপান যান। দ্বিতীয়বার ১৯২৪ সালে, তৃতীয়বার ১৯৪১ সালে। এই তৃতীয়বারের অভিজ্ঞতার নির্যাস রয়েছে ‘যুদ্ধ-জর্জরিত জাপানে’ নিবন্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালে ও যুদ্ধ শেষ হবার পর কয়েক বছর মিলিয়ে মোট ৭ বছর সেবার তিনি জাপানে ছিলেন। যোগাযোগ হয়েছিল সে সময় জাপানে থাকা রাসবিহারী বসু ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের সঙ্গে। নেতাজীর অনুরোধে হরিপ্রভা টোকিও থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষে বেশ কিছুদিন নিয়মিত রেডিও প্রচার পরিচালনা করেছিলেন। যুদ্ধ জাপানের সাধারণ জনজীবনে যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছিল, তার আতঙ্কময় আখ্যান তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন এই নিবন্ধে। ১৮৪৪ সালের ২৪ নভেম্বর নেতাজীর আমন্ত্রণে জাপানে থাকা কিছু বিশিষ্ট ভারতীয়ের সঙ্গে তিনিও Imperial হোটেলে যান এবং সেদিনই ৭০টি প্লেন টোকিও বন্দরে আক্রমণ হানে। এরপর থেকে জাপানে শুধুই বিশৃঙ্খলা আর মৃত্যুর মিছিল। ডিসেম্বরের এক বিকেলের বিবরণ হরিপ্রভার কলমে দেখা যাক – “বিকেল সাড়ে তিনটায় Raid বন্ধ হওয়া মাত্র বেরিয়ে পড়ি, raid-এর পর একা পথ চলা আমার পক্ষে দুষ্কর বিধায় আমি ঐ বাড়ির ১৩ বৎসর বয়স্কা মেয়েটিকে নিয়ে রওনা হই। রেললাইন নষ্ট হওয়ায় গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েটি আমায় তাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চায়। আমাদের বাড়ি ও স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তায় আমার বাড়ি যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। … ট্রেন পথ ছেড়ে অন্য রাস্তার লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রামে অতিকষ্টে উঠে যতটা সম্ভব এগিয়ে অতঃপর মধ্য পথ থেকে হেঁটে বাড়ি চললাম। রাস্তার দুপাশে বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, জল কাদা ছাই ইলেকট্রিক তার ছড়াছড়ি। আমাদের বাড়ির এলাকায় এই কাণ্ড দেখে আমি ত মৃতপ্রায় হয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে পথ চলছি। গাড়ি বোঝাই মড়া, ট্রেচারে আহতদের নিয়ে চলেছে। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে রাত্রি ১০ টায় বাড়ির দিকে কিছুটা যেয়ে দেখি, এই পাড়া বেঁচে গ্যাছে।’’
১৯৪৫ এর অভিশপ্ত ৬ আর ৯ আগস্ট হরিপ্রভা জাপানেই ছিলেন। হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আণবিক বোমা পতনের ঘটনা নিয়ে অবশ্য তিনি বেশি শব্দ খরচ করেননি তিনি। সম্ভবত এই অভাবনীয় ধ্বংসলীলা নিয়ে বেশি কিছু লিখতে কলম সরেনি তাঁর। “জাপানে প্রজার ঘরে ঘরে শোকের হাহাকার - স্বামীপুত্র নিহত, সন্তান অনাহারে মৃত, অন্ন নাই, বস্ত্র নাই, মাথা রাখার গৃহ নাই, তবু তারা রাজাদেশ মেনে নিয়েছে। কিন্তু সকলেই যেন হতবাক মুহ্যমান।” ‘রাজাদেশ’ অর্থাৎ যুদ্ধে আত্মসমর্পণ। এরপরেই হরিপ্রভা লিখেছেন ২০ আগস্ট ব্যাঙ্কক থেকে ফেরার পথে নেতাজীর নিহত হবার খবর।
আরও পড়ুন : মূলস্রোত চেনেনি যে মাটিকে : সামাজিক-সাংস্কৃতিক বীক্ষণে অভিমন্যু মাহাতর কাব্যগ্রন্থ ‘মাটি’
১৯৪৮ সাল নাগাদ হরিপ্রভা ও ওয়েমন ভারতে ফিরে আসেন। ওয়েমন সে বছরই জলপাইগুড়িতে মারা যান। হরিপ্রভা মারা যান আরও অনেক পরে, ১৯৭২ সালে, কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।
‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা ও অন্যান্য রচনা’ বইটি নিঃসন্দেহে এক মূল্যবান সামাজিক-রাজনৈতিক দলিল। ড মঞ্জুশ্রী সিংহের সুসম্পাদনায় এই সংস্করণটিতে হরিপ্রভার সংক্ষিপ্ত জীবনী, তাঁর স্বামী ও বাবার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং পরিশিষ্ট অংশে হরিপ্রভার বোনপো সুরজিৎ দাশগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জু দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণা যুক্ত হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য কয়েকটি ছবি।
....................................
#হরিপ্রভা তাকেদা #শশীভূষণ মল্লিক #ওয়েমন তাকেদা #বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা #ডি এম লাইব্রেরি #japan #জাপান #Hariprobha Takeda #Book Review #বই রিভিউ #বিকাশ সাহা #সিলি পয়েন্ট #নেতাজী #টোকিও #দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ