হাম দেখেঙ্গে : হার না-মানা ইকবাল বানো
এক রঙ্গা বছর আট-নয় আগে, ছোট ছোট কিছু ছাত্র-যুব সংগঠনের উদ্যোগে, চলমান ‘আরব বসন্ত’-র ওপর একটা তিনদিনের সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন হয়েছে দিল্লিতে। সে প্রায় বিশ-পঁচিশটা দেশ থেকে ছাত্র-যুবরা এসেছে। কলকাতার এক যুব ও এক ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে যথাক্রমে আমি ও আমার এক ‘তখন কবি অধুনা সাংবাদিক’ বান্ধবীও পৌঁছে গেছি গুটিগুটি পায়ে। দিল্লি ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্সের যে প্রফেসরের বাড়িতে থাকার আয়োজন, তাঁকে ছাড়া প্রায় আর কাউকেই চিনি না, কেমন একটা দিশাহীন লাগছে। এমতবস্থায় উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করতে এল পাকিস্তানের ছেলেমেয়েদের দলটা। একটা গান। মাত্র একটা গান। একটাই মাত্র গান আর পুরো প্রেক্ষাগৃহ মুহূর্তের মধ্যে যে যার মতো তিউনিশিয়া, লিবিয়া অথবা মিশরে। দিনের শেষে যথারীতি হানা দিলাম "ওদের" ঘরে। "ইয়ে... মানে গানটা... মানে গানটা আর কি... মানে কার?...মানে পাওয়া যাবে?..", ইত্যাদি দিয়ে শুরু, ও তারপর প্রায় রাতভর আড্ডা। ওদের কাছেই প্রথম শোনা ছয়ের দশকের শেষে পাকিস্তানের "খাইবার পাখতোনখোয়া" প্রদেশে জমিদার জোতদার বিরোধী কোনও এক আন্দোলনের কর্মীরা নিজেদের পরিচয় দিত "নকশাল" বলে, সেই ওদের কাছেই প্রথম শোনা ফৈজ আর ইকবাল বানো। হ্যাঁ, ইকবাল বানো। পাকিস্তানের এক প্রবাদপ্রতিম গজল ও ঠুমরী গায়িকা। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের দিল্লিতে। ভারতে জন্ম বলে যাঁকে "ভারতের গুপ্তচর" বলেও দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল পরবর্তীকালে। সেইদিন আমার আরেক প্রথম শোনা নাম ছিল ফৈজ। কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন কবি ফৈজ। তাঁর লেখা নজম্ "হাম দেখেঙ্গে" ধ্বনিত হয়েছিল ইকবাল বানোর কণ্ঠে।
দিরঙ্গা-
আটের দশকের মাঝামাঝি। জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ইতিহাস করে চলছে মিলিটারি জেনারেল মহম্মদ জিয়া-উল-হক এর জমানা। সে বড় 'আচ্ছে দিন' নয়। ১৯৭৭ সালে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তিনি দখল করেছেন তখত-ই-পাকিস্তান। চলছে একের পর এক গণতান্ত্রিক আইনের কণ্ঠরোধ, জারি হচ্ছে 'আজিব - ও গরিব' ফরমান। পাকিস্তান রেডিও ফরমান জারি করেছে সরস্বতী, শ্যামকল্যাণ বা মালকোশ রাগ গাওয়া যাবে না মোটেই, পরা যাবে না শাড়ি। ওগুলো বড় 'ভারতীয়' তথা 'হিন্দু'। এমতবস্থায় হঠাৎ শুরু হল ধরপাকড়। বুদ্ধিজীবী, কবি, নাট্যকার, রাজনৈতিক কর্মী, উকিল, মোক্তার, ভাক্তার, গেছোদাদা, কাক্কেশ্বর কুচকুচে সহ ফৈজ আহমদ ফৈজকেও ঢোকানো হল জেলে, রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে। পরের দিন ১৯৮৬ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি, লাহোরের আলহামারা আর্টস কাউন্সিলে এক প্রতিবাদ সভায় ইকবাল বানো গেয়েছিলেন ফৈজের এই গানটা। আর হ্যাঁ, পুরোদস্তুর শাড়ি পরে। সেদিন স্টেডিয়ামে উপস্থিত সকলেই যেন হয়ে উঠেছিল একটাই নাম– ইকবাল বানো। স্টেডিয়ামের আসন সংখ্যা পূরণ হয়ে যাওয়ার পর সবার জন্য সেদিন দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সোলো পারফরম্যান্স নিমেষে মিশে গিয়েছিল কোরাসে। "সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে, সব তখত গিরায়ে যায়েঙ্গে”-র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ফেটে পড়েছিল সমগ্র অডিটোরিয়াম। অনুষ্ঠান শেষে লাহোর স্টেডিয়ামে স্লোগান উঠেছিল 'ইনক্লাব জিন্দাবাদ'। লাহোর অভিযানের বেশ কয়েক বছর আগে ১৯৭৯ সালে লেখা ফৈজের এই গান সেদিন ইকবাল বানোর স্বরের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের বাতাসে ছড়িয়ে গিয়েছিল এতগুলো মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে।
আরও পড়ুন
‘নতুন দিনের আলো’- বাজেয়াপ্ত বই
তেরঙ্গা-
কাশ্মীর, শ্রীনগর, ১৫ আগস্ট, গতবছর। ডাল লেকের পাড়ে "নমকিন চায়" সহযোগে বিড়ি ফুঁকছি। সাথে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সেই সেমিনার ও ওয়ার্কশপে আলাপ হওয়া বন্ধু। আমি খানিক নিরাশ। আমি খানিক 'অ্যাকশন' আশা করেছিলাম (১৫ আগস্ট + কাশ্মীর)। একটু আগে লালচক চত্বর ঘুরে এসেছি। কজন জওয়ান ও ১৪৪ ধারা সহযোগে একটা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক পতাকা উড়ছে মাত্র। "অনন্তনাগের দিকে যাওয়াটা কি একটু রিস্কি হয়ে যাবে?" এইসব আলোচনা করতে করতেই হঠাৎ খবর এল সোপোরে ভারতীয় পতাকা পোড়ানো হচ্ছে। বন্ধু বলল, "যাস না গুজব"। আমি, "শ্রীনগরে তো তোরা কিছুই করতে পারলি না, সোপোরে গিয়ে দেখাই যাক না..." বলে তার হাত ধরে ছুটলাম বাস টার্মিনাসের দিকে। টার্মিনাসে পৌঁছে দেখি সারি দিয়ে বসে আছে লোকে। ভিড়ের মধ্যেও একদম সোজাসুজি ঠিক দেখতে পাচ্ছি পরশু বিকেলে আলাপ হওয়া আপেল বেচা বুড়োটাকে, যে তার নাতির নাম রেখেছে বুরহান, প্রথম দুটো সারিতে বসে আছে ছররা বন্দুকে সদ্য চোখ খোয়ানো দেবশিশুরা, আর লাউড স্পিকারে বেজেই চলেছে ফৈজ, ইকবাল বানো। বন্ধু কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল, "do you remember comrade? do you still remember? জয় হিন্দ..."
"হম দেখেঙ্গে"
এক বছর আগেই জামিয়া মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশি হানার প্রতিবাদে গেয়ে উঠেছিল এই গান। যা হয়ে উঠেছিল জামিয়া মিলিয়া থেকে ধর্মতলার মোড়ের ফ্যাসিবিরোধী সব মিছিলের একমাত্র স্লোগান। আগেই সেন্সর বসানো হয়েছিল এই গানের উপর। ফৈজের সমগ্র থেকেও বাদ পড়েছিলেন এই গান। ইকবাল বানোর সেই কনসার্টের পর ইকবাল বানোর গানের অনেক রেকর্ড বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। এবং বর্তমানে কোক স্টুডিও এ গানের যে এক নতুন ভার্সন প্রকাশ করে সেখান থেকেও বাদ দেওয়া হয় এই গানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এতগুলো কণ্ঠরোধের পরেও যে গান স্লোগান হয়ে উঠতে পারে, সে গান যে আর কেবল কণ্ঠবন্দি নয়, সে গান রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, সে গান অনায়াসেই কেবল তর্জনী দিয়ে শাসকের প্রতিটা পদক্ষেপ রুখে দেওয়ার শক্তি রাখে। "জব আর্জ-এ-খুদা কা কাবে সে, সব বুট উঠায়ে যায়েঙ্গে / হাম আহলে-এ-সফা মরদুদ-এ-হারাম, মসনদ পে বিঠায়ে যায়েঙ্গে / সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে, সব তখত গির যায়েঙ্গে.." ঈশ্বরের স্থান থেকে যখন দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের সরিয়ে দেওয়া হবে, তাদের মুকুট খসে পড়বে মাটিতে, যারা নির্দোষ তাদের বসানো হবে উঁচু বেদিতে, সেই দিনের অপেক্ষায় আজও আমরা। সেন্সর বোর্ডের শান দেওয়া কাঁচির সামনে দাঁড়িয়ে, ফ্যাসিবাদের চোখরাঙানিকে নস্যাৎ করে দেবার মন্ত্র আস্তে আস্তে শিখে নিচ্ছি আমরা সবাই। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি..
"হম দেখেঙ্গে
হম ভি দেখেঙ্গে"
[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#বাংলা #ফিচার #ফ্যাসিবাদ #Fascism # রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #ইকবাল বানো #জুজু #তিউনিশিয়া #লিবিয়া #মিশর #খাইবার পাখতোনখোয়া #ফৈজ #নজম্ #হাম দেখেঙ্গে #জুলফিকার আলি ভুট্টো #মহম্মদ জিয়া-উল-হক #আলহামারা আর্টস কাউন্সিল