গুরুদেবের গুরুগিরি
শ-খানেক বছর আগের কথা প্রায়। রাজনৈতিক ক্ষোভ থেকে প্রেমজীবনে কোপ, সবকিছুর আপডেট জনসমক্ষে লটকে দেওয়ার জন্য তখন ফেসবুকের দেওয়াল ছিল না। দেওয়ালের অভাব ছিল না তা বলে। গুরুপল্লীর সামনের বাঁশঝাড়ের গায়ে এক বুধবারের সমাচারে দেখা গেল এই ‘ব্রেকিং নিউজ’:
এর ওপরেও কলম চালিয়ে, আগাগোড়া ‘গরু’-র বদলে ‘গুরু’, এবং ‘গুরু’-র জায়গায় ‘গরু’ বসিয়ে খবরের খোলনলচে পালটে দিয়েছিল কোনও এক রসিক ছাত্র। তারপরেও কোনও গুরু মানহানির মোকদ্দমা করেছিলেন বলে শোনা যায়নি।
যে পাড়ায় গুরু-শিষ্য সম্পর্কে এমন খোলা হাওয়ার চলাচল, তার কারিগর ছিলেন খোদ রবি ঠাকুর। গতে বাঁধা সিলেবাস আর চার দেওয়াল ঘেরা স্কুলবাড়ির আতঙ্ক ছোটবেলায় তো কম নাকাল করেনি তাঁকে! সেসবের শোধ নিতে ঠাকুরবাড়ির রেলিংগুলোর ওপর কী প্রবল গুরুগিরি ফলাতেন তিনি, কিংবা নিরীহ বেড়ালছানাকে শাসনের ঠেলায় কীভাবে অস্থির করত তাঁর কবিতার ‘কানাই মাস্টার’, সে-কথা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বড়বেলায় যে ক্লাসরুম তিনি তৈরি করলেন সেখানে রইল না বদ্ধ ঘর বা মাস্টারের বকুনির ভয়। বিলকুল মুছে গেল ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যেকার ‘গুরু’গম্ভীর পাঁচিল। নিয়মমতে চলার শিকল ঘুচিয়ে একেবারে নতুন-ছাঁচে গড়ে তোলা সেই ক্লাসে মাস্টারমশাই হিসেবে কখনও কখনও হাজির হতেন স্বয়ং গুরুদেব! শান্তিনিকেতনের ক্লাসঘর কীভাবে পেয়েছিল তাঁকে? কারাই বা নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা করেছেন তাঁর ক্লাস করার স্মৃতি?
১৯৩৮ সাল। মহাশ্বেতা দেবী শান্তিনিকেতনে ক্লাস সেভেনের ছাত্র। শোনা গেল অনেক বছর বাদে ছোটদের একটা বাংলা ক্লাস নেবেন রবীন্দ্রনাথ। মহাশ্বেতার ভাষায় – ‘আমাদের ভাগ্যেই শিকেটি ছিঁড়েছে। অর্থাৎ আমাদের ক্লাসটিই নেবেন। খবরটা শোনার পর… পা আর মাটিতে পড়তে চায় না।’
উত্তরায়ণের ক্লাসরুমে সেদিন রবীন্দ্রনাথ পড়িয়েছিলেন নিজেরই লেখা ‘বলাই’। মাস্টারসুলভ লেকচার বিতরণের চাইতে ছাত্রদের নিজস্ব ভাবনাকে উসকে দেওয়ায় বিশ্বাস ছিল বলেই বোধহয় গল্পের খানিকটা পড়ার পরই বলার সুযোগ দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের। গুরুদেবের আশ্বাসে সে সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছিলেন মহাশ্বেতারা। পড়ানোর গুণে ক্লাসের একঘেয়েমি আর ভারিক্কি চাল কাটিয়ে দেওয়ার কথা বলে গেছেন কবি-পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও। তিনি পড়ালে ‘ছাত্রদের মনে হতো না সেটা ক্লাস।’ – এমনই অনায়াস ছিল তাঁর শেখানো।
এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা যায় রবীন্দ্রনাথের করা প্রশ্নপত্রের কথা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালীন যখন দেশীয় রীতিতে শিক্ষাদানের জন্য গড়ে উঠেছিল National Council of Education, ১৯০৬-০৭ নাগাদ কাউন্সিলের পঞ্চাশ নম্বরের বাংলা প্রশ্নের পেপার-সেটার ছিলেন Babu Rabindra Nath Tagore। প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বেশ কটি নমুনা প্রশ্ন তৈরি করেন তিনি। অজস্র রবীন্দ্র-কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ যেমন তার সিলেবাসের আওতায় ছিল, তেমনি ছিল রামায়ণ, মহাভারত, মধুসূদনের ‘বঙ্গভাষা’, নজরুলের ‘দেখব এবার জগৎটাকে’, যতীন্দ্রনাথের ‘হাট’, সত্যেন্দ্রনাথের ‘চম্পা’, সুকুমার রায়ের ‘গোঁফচুরি’-র মতো অরাবীন্দ্রিক কবিতাও। ছিল ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ। বলাই থেকে দেওয়া প্রশ্নটি ছিল এরকম –
‘কাবুলিওয়ালা’ নিয়ে তাঁর প্রশ্ন ছিল –
প্রশ্নগুলি দেখেই বোঝা যায়, এখানে মাস্টারির চিরচেনা রীতিতে ছাত্রের দিকে প্রশ্নের তির ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিটি সচেতনভাবেই দূরে সরানো হয়েছে। খেয়াল করলে চোখে পড়ে, প্রশ্নের শেষে বাদ গেছে জিজ্ঞাসাচিহ্নও। আসলে, এ যেন প্রশ্ন নয়, ছাত্র-শিক্ষকের নির্বাধ কথোপকথন। কোনও কোনও প্রশ্ন শুরুই হয়েছে ‘এই গল্পটার মানে একটু ভেবে দেখা যাক’ – এই ভঙ্গিতে।
আবার বিবাহ কবিতাটির প্রশ্নে আসার আগে তিনি বলে নেন –
বেশিরভাগ সময়ে তাঁর করা প্রশ্নের এই নমুনাগুলোই যেন হয়ে উঠেছে ছোট ছোট এক-একটা ক্লাসনোট। তোতাকাহিনির তোতার মতো তথ্য মুখস্থের ভার যাতে ছোটদের ওপর এসে না পড়ে, সেজন্য প্রশ্নপত্রেই প্রায়শই বলে দিয়েছেন গল্পের সারাংশ। জ্ঞানমূলক প্রশ্নের চেয়ে জোর দিয়েছেন বোধমূলকের ওপর। শুধু তাই নয়, সিলেবাসের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ পড়ে যাতে ছাত্রদের নিজেদের লেখার ক্ষমতাও তৈরি হয় আস্তে আস্তে, সেদিকেও নজর ছিল তাঁর। তাই ‘অসম্ভব কথা’ গল্পের কোনটুকু অসম্ভব তা জানতে চাওয়ার পর – ‘যদি পারো এ গল্পটিকে বদল করে দিয়ে সম্ভবপর করে দিয়ে লেখো’-র মতো দুঃসাহসী দাবি জানাতেও পিছপা হননি রবীন্দ্রনাথ।
‘ছোটনাগপুর’-এর প্রশ্নে লিখেছেন –
আরও মজার ব্যাপার এই যে, বন্দীবীর বা পদ্মা-র মতো কবিতার বেলায় স্পষ্টাস্পষ্টি বলেই দিয়েছেন, ‘এই শ্রেণীর কাব্যে পরীক্ষাপত্রে প্রশ্নোত্তর করিবার কিছু নাই।… পড়িয়া যদি রস পাও সেই যথেষ্ট।’ জিজ্ঞেস করার কিছু না থাকলেও ছাত্রদের অহেতুক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করা যে তাঁর ঘোর অপছন্দ ছিল, প্রশ্নের ভাষাতেই তা দিব্যি মালুম হয়। কীভাবে পড়ালে আগ্রহ পাবে ছাত্ররা, তা বুঝিয়ে দিতে মাঝে মাঝে শিক্ষকদের নিয়েও চলত তাঁর ‘টিচার্স ট্রেনিং’-এর ক্লাস।
আরও পড়ুন
কেবল বাংলা পড়ানোই নয়, তিনি রীতিমতো গবেষণা করে ফেলেছিলেন ক্লাসরুমে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ইংরাজি পড়ানোর পদ্ধতি নিয়েও। কীভাবে ছাত্রকে ইংরাজি শেখানো উচিত, তার প্র্যাকটিকাল উদাহরণ দিয়ে লেখালিখিও করেছিলেন। ছাত্রদের দিয়ে একইরকম গঠনের নানা বাক্য বারবার তৈরি করিয়ে পোক্ত করতে চেয়েছিলেন সিনট্যাক্সের ধারণা। মোটের ওপর গ্রামার-ট্রান্সলেশন মেথডই নিয়েছিলেন তিনি। বিদেশি ভাষা আর মাতৃভাষাকে পাশাপাশি রেখেই গড়তে চেয়েছিলেন ইংরাজি শিক্ষার ভিত। পড়ানোর সময় জোর দিয়েছিলেন অনুবাদের ওপর। যে অনুবাদ করছে তার কাছে সোর্স আর টার্গেট দুটো ভাষার নিজস্বতাই আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে – এরকমটাই মনে করতেন তিনি। সহজ পাঠের মতো প্রাইমারের সঙ্গে সঙ্গে ‘ইংরাজি-সহজশিক্ষা’, ‘ইংরাজি সোপান’, ‘ইংরাজি পাঠ’, ‘সংস্কৃত-শিক্ষা’, ‘অনুবাদ-চর্চা’ এগুলোও ছিল তার ছাত্র-পড়ানোর ফসল। এদের পাতায় পাতায় চিনে নেওয়া যায় ক্লাসরুমের রবীন্দ্রনাথকে।
শুধু পড়ার ক্লাসেই নয়, ছাত্রদের নাটকের রিহার্সালের সময়েও শিক্ষকের পোস্টে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁরই প্রশ্রয়ে শিশুবিভাগের বাচ্চারাও স্টাডির জন্য বাঁধা সময়ে রিহার্সাল দেখতে আসার পারমিশন পেয়ে গিয়েছিল। রিহার্সালের শেষে আবার বরাদ্দ ছিল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়ার পর্ব। তখনকার কথা বাদ দিলেও, ইন্সটিটিউশনের রাশভারী জগদ্বিখ্যাত ‘হেড’ একেবারে নিচু ক্লাসের ছাত্রদের পাশে বসে খাওয়া সারছেন – এমন কাণ্ড আজকেও আমরা খুব একটা ভাবতে পারি কি?
শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়েছিল মুজতবা আলীরও। রাণী চন্দকে লেখাপড়ার চেয়ে আঁকায় হাত-পাকানোতেই জোর দিতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মুজতবা আলীর বেলায় কিন্তু ঘটেছিল ঠিক এর উল্টোটা। বিশ্বভারতীতে ভর্তির সময়ে যে কোনও একটা বিষয় খুব ভালোভাবে শিখতে চাইলে তাঁকে নানারকম জিনিস একসঙ্গে জানার জন্য উৎসাহ জোগান কবিগুরু। তাঁর জহুরির চোখ হয়তো সেদিনই চিনে নিয়েছিল বহুভাষাবিদ, পড়াশোনার বহু ক্ষেত্রে অলৌকিক সহজতায় যাতায়াত-করা আগামীদিনের ‘সৈয়দ’ মুজতবা আলীকে।
মুজতবা আলীদের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিতেন শেলি, কিটস আর বলাকার ক্লাস। ছাত্রদের হোমওয়ার্ক দেওয়ার সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের নিজের হোমওয়ার্ক করাটাও যে সমান জরুরি, রবীন্দ্রনাথ এ কথা কখনও ভোলেননি। তাই শেলি কিটস পড়াতে আসার আগে তো বটেই, মায় নিজের লেখা বলাকা পড়ানো আগেও রীতিমতো পড়াশোনা করে রেডি হয়ে ক্লাসে ঢুকতেন তিনি। জানতেন ভালো শিক্ষক হওয়ার প্রথম ধাপ একজন ভালো ছাত্র হয়ে ওঠা।
এই কারণেই রাণী চন্দকে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘My University Days’ পড়াতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন “তোকে পড়াতে পড়াতে আমারও পড়া হয়ে যাবে।” আর একই কারণে পণ্ডিত লেভির ক্লাসে মাস্টার থেকে ছাত্র বনে যেতে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না তাঁর। রবিবার শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন নয় বলে রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে লেভির বক্তৃতার আয়োজন করেছিলেন যাতে কলকাতার ছাত্ররাও শোনার সুযোগ পায়। এত কিছুর পরেও সেদিনকার আসরে দেখা গেল, বিশ্বভারতীর জনাচারেক সংস্কৃতের ছাত্র ছাড়া শ্রোতার দলে আছেন কলকাতার মোটে দুটি ছাত্র। কিন্তু তাতে কী? ক্লাসের সামনের দিকে খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ!
#রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #শিক্ষক #Teacher