খেলা

ঈশ্বর অথবা পাশের বাড়ির ছেলে

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য April 22, 2023 at 7:06 pm খেলা

কেন এত জনপ্রিয় শচীন তেণ্ডুলকর? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দানে তাঁর অভিষেক ঘটে সেই ১৯৮৯ সালে, অবসর নিয়েছেন আজ দশ বছর হতে চলল, তবু শচীনের জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটার টান আসেনি। তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা উত্তরোত্তর কেবল বেড়েছে, কোচ হিসেবে তাঁর সমসাময়িক রাহুল, কুম্বলে সমালোচিত হলেও, এককালের কিংবদন্তী অধিনায়ক সৌরভ বোর্ড সভাপতি হিসেবে নিন্দিত হলেও কোনোরকম মালিন্য কখনও স্পর্শ করতে পারেনি শচীনকে। যে প্রজন্ম তাঁর খেলা দেখেছে মাঝবয়সের পর তাদের কাছে তিনি অসীম স্নেহের পাত্র, যারা তাঁর খেলা দেখে বড় হয়েছে (যেমন এই অধম) তাদের কাছে তিনি ভগবান, যারা তাঁকে সেভাবে খেলতে দেখেনি সেই বর্তমান স্কুলগামী প্রজন্মের কাছেও তিনি এমন এক উচ্চতায় অবস্থিত, যার নাগাল পাওয়া দুষ্কর। কি করে সৃষ্টি হল এই সর্বজনগ্রাহ্য আবেদন, এই অসামান্য স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার জোয়ার?


প্রথম কারণ অবশ্যই ক্রিকেটীয় প্রতিভা। তাঁর খেলার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পান কিংবদন্তী ডন ব্র্যাডম্যান, আগের প্রজন্মের নয়নের মণি সুনীল গাভাসকার নিজেই খোলাখুলি জানান, ‘ও আমার থেকে অনেক ভালো।' গ্লেন ম্যাকগ্রা থেকে ওয়াসিম আক্রম, শেন ওয়ার্ন থেকে মুথাইয়া মুরলীধরন, তাঁর প্রজন্মের সমস্ত শীর্ষস্থানীয় বোলার দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে। তাঁর সময়কার সেরা দল দোর্দণ্ডপ্রতাপ অস্ট্রেলিয়া বারবার প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। ম্যাথু হেডেনের মুখে শোনা গিয়েছে, ‘আমি ভগবানকে দেখেছি। তিনি ভারতের হয়ে চার নম্বরে ব্যাট করেন।' একের পর এক মায়াবী ইনিংসে শচীন বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যাটিং দক্ষতা, দুর্দান্ত রিফ্লেক্স, শটের বৈচিত্র্য। এর সঙ্গে যোগ করুন অসামান্য দায়বদ্ধতা। মাত্র ষোল বছর বয়সে জীবনের দ্বিতীয় টেস্টে ওয়াকারের বলে মুখে চোট খেয়েও আবার ব্যাট করতে নেমে স্ট্রোকের ফুলঝুরি, হিরো কাপ ফাইনালে সংকটজনক অবস্থায় নিজেই ‘ম্যায় ডালেগা’ বলে বল হাতে নিয়ে দলকে জিতিয়ে দেওয়া, চেন্নাই টেস্টে অসহ্য পিঠের যন্ত্রণা নিয়ে শেষ মুহূর্ত অবধি লড়াই করে যাওয়া, বাবা মারা যাবার পরেও বিশ্বকাপ খেলতে ফিরে এসে কেনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি- শচীনের নিখুঁত কমিটমেনটের তালিকা করতে বসলে গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা হয়ে যাবে। গড়াপেটায় কলঙ্কিত আজহারের দলের প্রধান খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও তাই ভুলেও আঙ্গুল ওঠে না তাঁর দিকে, সঞ্জয় মঞ্জরেকর তাঁর বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুললে সঙ্গে সঙ্গে পাশে এসে দাঁড়ান অধিনায়ক ধোনি, বর্তমান প্রজন্মের আইকন বিরাট কোহলি ইনিংসের মধ্যেই মাথা নিচু করে অভিবাদন জানান দর্শকাসনে বসে থাকা তাঁর অনুপ্রেরণাকে। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন ব্রায়ান লারাও, কিন্তু শচীনের সঙ্গে একসাথে দৌড় শুরু করেও তিনি ক্রমশ পিছিয়ে পড়েন শৃঙ্খলা এবং দায়বদ্ধতার অভাবে।

             মনে রাখতে হবে, শচীন যে সময়ে উঠে আসছেন, ঠিক সেই সময়েই উদারনৈতিক অর্থনীতির দরজা খুলে দিচ্ছে ভারতবর্ষ। ভারতের টিভিতে আগমন ঘটছে রুপার্ট মার্ডকের স্টার নেটওয়ার্কের, ভারতীয় বাজারে পা রাখছে মার্কিন নরম পানীয়ের ব্র্যান্ড। এবং বিপণনের ক্ষেত্রে তারা সেরা বাজি হিসেবে সহজেই বেছে নিচ্ছে শচীনকে। শুধুমাত্র শচীনের খেলা দেখবে বলে বাড়তি পয়সা খরচ করে কেবল লাইন নিচ্ছেন পাড়ার কাকু, শচীনের ছবি দেওয়া কার্ড ফ্রি পাবে বলে অখাদ্য চুইংগাম চিবোচ্ছে তাঁর ছেলে। মিথ হয়ে উঠছে একদল গ্রামের ছেলের সঙ্গে শচীনের ক্রিকেট খেলার গল্প নিয়ে তৈরি পেপসির বিজ্ঞাপন, টিভির পর্দায় পাশাপাশি নরম পানীয়ের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে ভারতে উদার অর্থনীতির দুই সেরা ব্র্যান্ড- শচীন ও শাহরুখ। শচীনের বিপণনযোগ্যতাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন মার্ক মাসকারেনহাস। আবার উল্টোটাও সমান সত্যি। এই ক্রমবর্ধমান গোলকায়নের যুগে আইটি আর কল সেন্টারের বাজারে গুচ্ছ গুচ্ছ কর্মী জোগান দেওয়া ছাড়াও যে মৌলিক কিছু পৃথিবীকে দেবার আছে ভারতের যুবসমাজের, সেই ভরসা দিচ্ছে শচীনের ব্যাট। অচিরেই ইংরেজি শিক্ষিত স্মার্ট নতুন প্রজন্মের আইকন হয়ে উঠছেন তিনি। তাঁর হেলমেটে লাগানো তেরঙ্গা থেকে নবীন ‘ইন্ডিয়া’ খুঁজে পাচ্ছে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা। গোলাগুলির গল্প ভুলে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান মুগ্ধ হয়ে বলছে, ‘শচীন দে দো, কাশ্মীর লে লো।' আপাদমস্তক সাধারণ ঘরের একজন ছেলে, খ্যাতির শিখরে উঠেও যার পা ভীষণভাবে মাটিতে, যিনি কোনদিন তাঁর উত্থানের পিছনে বাবা মা এবং দাদার অবদান সম্বন্ধে বলতে ভোলেননা, নিজের উজ্জ্বল ডাক্তারির কেরিয়ার ছেড়ে তাঁর পাশে থাকার জন্য বারংবার কৃতজ্ঞতা জানান স্ত্রী অঞ্জলিকে। মুম্বইতে এলেই ছুটে যান ছোটবেলার কোচ আচরেকরের পরামর্শ নিতে, দেখা হলেই ‘মা’ বলে ডেকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরকে। সুদীর্ঘ কেরিয়ারে বারবার সমালোচকদের তিরে ক্ষতবিক্ষত হলেও কোনোদিন অপ্রীতিকর মন্তব্য শোনা যায়নি তাঁর মুখে, কোনোরকম বিতর্ক ছুঁতে পারেনি তাঁকে। কিন্তু এই আপাত শান্ত, নিরীহ শচীনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরেকটা ভয়ানক আগ্রাসী শচীন, কৈশোরেই যে পাকিস্তানি স্পিনার আব্দুল কাদিরের স্লেজিংয়ের জবাবে বলে, ‘তোকে মারার জন্য আমার বলের পালিশ ওঠার অপেক্ষা করতে হবে না রে’, তারপর সোজা তাঁকে ফেলে দেয় গ্যালারিতে। আজকের স্কুলপড়ুয়া প্রজন্ম কেস্রিক উইলিয়ামসের নোটবুক সেলিব্রেশনের জবাবে কোহলির মারা ছয় দেখে আত্মহারা হয়েছে, আমরা স্কুলে পড়বার সময় দেখেছি তাঁকে আউট করে অঙ্গভঙ্গি করবার পরের ওয়ান ডেতে হেনরি ওলোঙ্গাকে বেধড়ক পিটিয়ে শচীন মোটামুটি তাঁর কেরিয়ারই শেষ করে দিয়েছিলেন। সেঞ্চুরিয়নে চূড়ান্ত উত্তেজনাপূর্ণ বিশ্বকাপের ম্যাচে রান তাড়া করতে নেমে শেহবাগ যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বস, কেয়া করনে কা হ্যায়?’ তখন উল্টোদিক থেকে জবাব আসে, ‘মার ডালনে কা হ্যায়!’ ছয়বার বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনি, আর ভাগ্যদেবী প্রথমে বারবার খালি হাতে ফিরিয়েছে তাঁকে। কখনও ছিয়ানব্বইয়ের ইডেনে বিতর্কিত ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্তে ভরাডুবি হয়েছে দলের, কখনও সুপারসিক্সে উঠে বিদায় নিয়েছে ভারত, কখনও ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার হাতে দুরমুশ হয়েছে, কখনও আবার বাংলাদেশের কাছে হারের পর গ্রুপ লিগেই টিম বিদায় নেবার পর দেশে পুড়েছে তাঁর কুশপুতুল। শচীন হাল ছাড়েননি, প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছেন, একদিনের ক্রিকেটে প্রথম দ্বিশতরান করেছেন। ধোনির নবীন টিমের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে দুর্দান্ত ব্যাট করে দলকে ট্রফি এনে দিয়েছেন, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে এসেও উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে নতুন শট খেলতে দেখা গেছে তাঁকে। অবশেষে ২০১১ সালে ঘটেছে স্বপ্নপূরণ, কাপ জেতার পর তাঁকে কাঁধে নিয়ে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ করেন সতীর্থরা, বিরাট কোহলির মুখে শোনা যায়, ‘উনি একুশ বছর ধরে নিজের কাঁধে এই দেশের ভার বহন করেছেন, তাই আজ আমরা ওঁকে কাঁধে তুলে ঘুরলাম।‘ এমন একজন ভারতবর্ষের যুবসমাজের আইকন হবেন না তো কে হবেন?

                   শচীন মানেই তাই একরাশ মুগ্ধতা, অবিমিশ্র শ্রদ্ধা, অপরিসীম আবেগ। তাঁর সঙ্গে তুলনা টানলে তাই হেসে উড়িয়ে দেন কোহলি, ‘উনি সর্বশ্রেষ্ঠ, আমার সঙ্গে তুলনা টেনে ওঁর অসম্মান করবেন না।‘ একের পর এক ব্র্যান্ড এন্ডোর্স করবার পাশাপাশি তিনি নিঃশব্দে কাজ চালিয়ে গেছেন ‘আপনালয়’ এনজিওর সঙ্গে, ছুটে গেছেন ক্যান্সার আক্রান্ত যুবরাজ সিংহের সঙ্গে দেখা করতে। বীরেন্দ্র শেহবাগ থেকে রোহিত শর্মা, মনোজ তিওয়ারি থেকে পৃথ্বী শ- সবার জন্য তাঁর দরজা খোলা। বছরের পর বছর ধরে তিনি ব্যাট হাতে নেমেছেন, আর তাঁকে দেখে আশায় বুক বেঁধেছেন অমিতাভ বচ্চন থেকে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানদার। তাঁর একেকটা শট আছড়ে পড়েছে বাউন্ডারিতে, আর গর্জে উঠেছে আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত নানা দেশ নানা মত নানা পরিধানের ভারতবাসী। একশোটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির এক একটার পরে তিনি ব্যাট তুলেছেন আর শচীনে বুঁদ তৃতীয় বিশ্বের এক গরিব দেশের মানুষ ভুলে থেকেছে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, সাম্প্রদায়িক বিরোধ। ইডেনে শোয়েব আখতারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিনি রান আউট হয়ে গেলে এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গ্যালারিতে যে শচীনকে নিজে এসে শান্ত করতে হয়েছে দর্শকদের। মারিয়া শারাপোভা তাই যখন বলেন ‘হু ইজ শচীন তেণ্ডুলকর?’ তখন আগাপাশতলা না ভেবেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে দেশের জনসাধারণ। পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে গেল, খেলা ছেড়ে দিয়েছেন সেই ২০১৩ সালে, কিন্তু আজও যখনই লেজেন্ডস লিগ বা আইপিএলে তাঁকে মাঠে দেখা যায়, গ্যালারিতে বেজে ওঠে চিরপরিচিত সেই শব্দব্রহ্ম- ‘শ-চী-ন! শ-চী-ন!’

............... ...


#Sachin Tendulkar #শচীন তেণ্ডুলকর #Indian Cricket #Little Master #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

23

Unique Visitors

208846