নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে ভগবান
প্যাক আপ (প্রথম পর্ব) : ''দেহপট সনে নট সকলি হারায়''। সময়ের চেয়ে বড় সুপারস্টার কেউ নেই। তার সামনে সবাই পকেট-সাইজ। সময় কারো রোয়াব দেখে না বেশিদিন। খ্যাতি? সে তো বালির বাঁধ। আজ যে রাজা, কাল সে ফকিরেরও ফকির। সত্যজিত রায়ের কোনও এক গল্পে একটি চরিত্র বলেছিল, অভিনেতারা আক্ষরিক অর্থেই 'শুটিং স্টার'। উল্কার মতো আসেন। উল্কার মতোই চলে যান। মানুষ অল্পেই মাথায় তুলে নাচে, তার চেয়েও অল্পে অবহেলাভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় ক'দিন পর। বড় নিষ্ঠুর সেই গণ-প্রত্যাখ্যান। বড় অশ্লীল সেই গণ-বিস্মৃতি। বেঁচে থাকতে থাকতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান শতকরা নিরানব্বই ভাগ। বিরাট মাপের সুপারস্টারেরা মৃত্যুর পর দু' এক দশক অবধি টেনে দেন কোনওমতে। আসলে সময়ের চেয়ে বড় ঠগবাজ আর কে আছে! তার সাময়িক বশ্যতা- স্বীকারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ভেবে নিলেই পিঠে ছুরি খেতে হয়। সিলি পয়েন্টের এই নতুন ফিচার-সিরিজে আমরা তুলে আনব পুরনো দিনের এমন কিছু অভিনেতার গল্প, যাঁদের আমরা আজ পরিপাটি ভুলে গেছি - অথচ সময় একদিন তাঁদেরও তাঁবেদারি করেছে। প্রতি শুক্রবার সিলি পয়েন্টের ফিচার-সিরিজ 'প্যাক আপ'। আজ প্রথম পর্বে ভগবান দাদা।.....................................................................................................................
ভদ্রলোক সত্যিই জন্মসূত্রে ‘ভগবান’। পরিবারদত্ত নাম ভগবান আভাজি পালভ। বরং ‘ভদ্রলোক’ হয়ে জন্মাননি মোটেই। অনেক সংগ্রাম করে ভদ্রলোক পদবাচ্য হতে হয়েছিল। শুধু ভদ্রলোক হয়েছিলেন তাই নয়, একসময় বলিউডের তাবড় তারকাদের সঙ্গে একেবারে এক সারিতে উঠে এসেছিলেন। ‘ভগবান দাদা’ নামে ফিল্মে অভিনয় করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন, পরিচালনাও করেছেন। আশ্চর্য রোমহর্ষক সেই উত্থানের আখ্যান। সামান্য মাইনের শ্রমিক থেকে জুহুতে ২৫ ঘরের বিশাল প্রাসাদ পর্যন্ত অভাবনীয় এক যাত্রা। অচিরে হারিয়েও গিয়েছিলেন লাইমলাইট থেকে। কিন্তু বিগত শতাব্দীর চার-পাঁচের দশকের সেই স্বল্পস্থায়ী তারকাজীবন, ক্ষণকালের স্ফুলিঙ্গের মতো সেই অপরিমেয় মস্তানি নিজেই আস্ত একটা ইতিহাস হিসেবে গণ্য হবার দাবি রাখে।
নির্বাক যুগের ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক মূর্তিমান বিস্ময় ভগবান পালভের জন্ম ১৯১৩ সালে মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে এক দরিদ্র পরিবারে। বাবা ছিলেন টেক্সটাইল-কলের কর্মী। ভগবান নিজেও শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন, কিন্তু মাথায় ছিল ফিল্মের পোকা। অনেক হাতে-পায়ে ধরে কয়েকটা অখ্যাত ছবিতে ছোট ছোট নামমাত্র রোল যোগাড় করেছিলেন। শুধু ভালবাসা আর অদম্য চেষ্টাকে সম্বল করে ছবি তৈরির যাবতীয় খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে বাহাদুর কিষাণ নামে একটি ছবিতে সহ-পরিচালনার দায়িত্ব পান। এরপর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে নিজেই স্বল্প বাজেটের ছবি তৈরি শুরু করেন। ১৯৪১ সালে তাঁর তৈরি করা ‘বনমোহিনী’ নামে একটি ফিল্ম বক্স অফিসে মাঝারি ফল করে। করিৎকর্মা ভগবান পরের বছরই ‘জাগৃতি পিকচারস’ নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করে ফেলেন। সেখান থেকে পরপর ছোট বাজেটের কয়েকটি ফিল্ম রিলিজ করতে থাকেন। মূলত সহজ- সরল একরৈখিক গল্প ও অ্যাকশন- নির্ভর এই ছবিগুলি শ্রমিক শ্রেণির মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। স্ক্রিপ্ট বেশিরভাগই ভগবানের নিজের লেখা। নায়কের চরিত্রেও তিনি নিজেই অভিনয় করতেন। ভগবানের এই ধরনের ছবির নায়ক সবসময়েই হতেন একজন সাধাসিধে খেটে খাওয়া মানুষ, যার সঙ্গে নিম্নবিত্ত জনগণ খুব সহজেই একাত্ম বোধ করতে পারতেন। ভগবান দাদা নিজেও তখন বক্স অফিসে একটি ফ্যাক্টর। রাজ কপুর, গুরু দত্ত, দেব আনন্দ, বলরাজ সাহনি, ভারত ভূষণের মতো তারকাদের সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিচ্ছেন। তবে সমাজের একেবারে নিচের স্তর থেকে উঠে আসা ভগবান কিন্তু নিজের শিকড়কে ভোলেননি। নিজে এককালে যা ছিলেন, তাদেরই লক্ষ্য রেখে তৈরি করে গেছেন একের পর এক মনোরঞ্জনমূলক ছবি।
১৯৪৭ সালে চেম্বুরে জাগৃতি পিকচারসের নিজের স্টুডিও তৈরি হয়। ১৯৫১ সালে রাজ কাপুরের পরামর্শে ভগবান সামাজিক গল্পে হাত দেন। তৈরি করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি ‘আলবেলা’। নায়িকার ভূমিকায় গীতা বালি। ছবিটি ছিল এখনকার ভাষায় ব্লকবাস্টার হিট। ছবির চেয়েও সম্ভবত বেশি হিট হয়েছিল ‘সোলা জো ভড়কে’ নামে একটি গান। মুম্বইয়া শ্রমিক শ্রেণির কাছে ভগবান দাদা তখন অবদমিত বাসনার মুক্তির মতো। ততদিনে তিনি জুহুর সমুদ্রসৈকতের একেবারে কাছে বিশাল এক বাড়ির মালিক। সে বাড়িতে পঁচিশটা ঘর। গ্যারাজে সাতটা গাড়ি। শোনা যায়, সপ্তাহের সাত দিন নাকি আলাদা আলাদা এক- একটা গাড়ি ব্যবহার করতেন। ইন্ডাস্ট্রিতে লোকের মুখে মুখে ছড়াত ভগবানের দাদাগিরির রোমাঞ্চকর সব কিসসা।
কিন্তু আর সবকিছুর মতো ভগবানেরও এক্সপায়ারি ডেট নির্ধারিত ছিল। আলবেলার দু’ বছর পর অবিকল একই ছকে তৈরি করা ‘ঝামেলা’ বক্স অফিসে তেমন চলল না। এরপর মোটামুটি হিট বলতে কিশোর কুমারকে মুখ্য চরিত্রে নিয়ে তৈরি করা ‘ভাগম ভাগ’ (১৯৫৬)। কিন্তু তাতে নিজের পালে বাতাস ফেরত পেলেন না। তখন প্রবল বেগে উঠে আসছেন দিলীপ কুমার। ওই পাঁচের দশকের গোড়াতেই রাজ কাপুর বা দেব আনন্দের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোও আমরা পাচ্ছি। গুরু দত্তের ‘আর পার’ বা ‘পিয়াসা’ দর্শককে আবিল করে দিচ্ছে। এঁদের পাশে ভগবান দাদার একমেটে ফর্মুলা আর দাঁড়াতে পারল না। পরবর্তী সমস্ত প্রয়াস পরপর ফ্লপ হল। দেনার দায়ে গাড়ি-বাড়ি সব বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আস্তে আস্তে এমন সময় এল, ছোটোখাটো যা ভূমিকা আসছিল, পেটের দায়ে তা-ই করতে হল তাঁকে। কে না জানে, জনস্মৃতি বড়ই বেইমান। যাকে একবার ছুঁড়ে ফেলে, তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না আর। গুরুত্বহীন দু’ একটা রোল করতে করতে একটু একটু করে হারিয়ে গেলেন বলিউডের সাব-অলটার্ন নায়ক। এরপর অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ বন্ধুরাও তাঁকে ছেড়ে চলে গেছিল। সি. রামচন্দ্রের মতো দু’ একজন মাত্র পাশে থেকে গেছিলেন আমৃত্যু। ২০০২ সালে ৮৮ বছর বয়সে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকে বিদায় নেন ভগবান আভাজি পালভ।
চেনা পৃথিবীর আনাচে-কানাচেই আচমকা এমন এক-একটা অপার্থিব গল্প তৈরি হয়ে যায়। সব গল্প মনে রেখে দেবার মতো সত্যনিষ্ঠ আমাদের ইতিহাস কোনওদিনই ছিল না।
[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস]
#Indian actor #Bhagwan Dada #Film Director #Bhagwan Abhaji Palav #প্যাক আপ #Pack Up #Feature Series #Entertainment #Bollywood #Actor #ভগবান দাদা #ভবান আভাজী পালভ #রোহন রায়