ফিচার

সুখী দাম্পত্যে ভাঙন ধরাচ্ছে বিশ্ব-উষ্ণায়ন

সায়নদীপ গুপ্ত Mar 31, 2023 at 6:34 pm ফিচার

একই পাড়ায় বেড়ে ওঠা, কৈশোরে আলাদা থাকলেও যৌবনে আবার কাছে ফিরে আসা, আর তারপর থেকে একে অপরকে চোখে হারানো; একেবারে আদর্শ জুটি বলতে যা বোঝায়, তারা ছিল ঠিক তাই। সাধের ঘর বানানো থেকে সন্তানকে বড়ো করে তোলা, সবকিছুই তারা করেছিল হাতে হাত রেখে। অন্য সমাজে তারা ছিল প্রেমের প্রতীক, তবু শেষ অবধি সে প্রতীকেও দাগ লাগল। বার্ধক্য নয়, যৌন অতৃপ্তি নয়, এমনকি মতের অমিলও নয়, তাদের আলাদা হওয়ার একমাত্র কারণ – বড্ড গরম।

মানুষের নয়, কথা হচ্ছে অ্যালবাট্রস পাখিদের নিয়ে। আক্ষরিক অর্থেই এরা 'লভ বার্ডস'। শুধু ভালোবাসার প্রকাশেই নয়, সম্পর্কের বিশ্বস্ততার নিরিখেও এরা মনুষ্যজাতিকে দশ গোল দেবে। পর্তুগালের এক গবেষক পাউলো কার্টি অ্যালবাট্রস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, একই পক্ষী দম্পতি ষোলো-সতেরো বছর ধরে সুখে ঘরকন্না করে চলেছে। মনুষ্যেতর জগতে প্রকৃতির ঝড়ঝাপটা সামলে টিকে থাকতে গেলে নিয়মিত বংশবিস্তার প্রয়োজন; মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তারা পায়নি, সবল এবং বহুসংখ্যক সন্তানই তাদের একমাত্র সহায়। বহুগামিতা তাই পশুপাখিদের সমাজে খুবই স্বাভাবিক পছন্দ। অ্যান্টার্কটিকাবাসী এম্পারার পেঙ্গুইন, যারা রীতিমতো গোষ্ঠীবদ্ধ জীব, তাদের মধ্যেও অন্তত ৮৫-৯০% ক্ষেত্রেই একগামিতা বিশেষ দেখা যায় না। সেই তুলনায় অ্যালবাট্রস কিন্তু সারা বছর সমুদ্রে একাই কাটায়, জুটি বাঁধে শুধু প্রজনন ঋতুতেই, অথচ তখনও তারা ফিরে যায় তাদের পুরনো প্রেমাস্পদের কাছেই। এক সঙ্গীর সাহচর্য পছন্দ হয়ে গেলে আমৃত্যু একসঙ্গেই থাকতে পছন্দ করে তারা।

অন্তত এতদিন অবধি তাই জানা ছিল। পাউলো কার্টি ও তাঁর সহকর্মীদের ষোলো বছরের টানা গবেষণায় দেখা গেছে অধিকতর উষ্ণ বছরগুলোতে অ্যালবাট্রসদের মধ্যে প্রায় ৮% ক্ষেত্রে দাম্পত্য বিচ্ছেদ ঘটে, যেখানে সাধারণত এই হার খুব বেশি হলে ১% বা তারও কম। পাখিদের জগতে যৌনসঙ্গীদের মধ্যে বিচ্ছেদ মূলত প্রজননের সাফল্যের চাবিকাঠি। যদি কোনও দম্পতি জুটি বাঁধার পরেও সন্তান উৎপাদনে বা ঘর বাঁধতে অক্ষম হয়, সাধারণত পরবর্তী প্রজনন ঋতুতে তারা অন্য সঙ্গী খুঁজে নেয়। কিন্তু অ্যালবাট্রসরা এই নিয়মের ব্যতিক্রম বললেই চলে; তাদের সুখী সংসারে ফাটল ধরাচ্ছে সমুদ্রের জলস্তরের বেড়ে চলা উষ্ণতা। বাড়তি উষ্ণতার কারণে সামুদ্রিক মাছেরা বাসস্থান পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে তাদের জীবনচক্র। ফলে অ্যালবাট্রসদের খাদ্যের জোগানে ঘাটতি বাড়ছে। খাদ্যের সন্ধানে অধিক শক্তি খরচ হচ্ছে বলে নির্দিষ্ট প্রজনন ঋতুতে পাখিরা অনেকসময়েই তাদের বাসায় ফিরতে পারছে না, যুগলের একজন এসে অপেক্ষা করে করেও অন্যজনের দেখা না পেয়ে শেষে বেছে নিচ্ছে নতুন সঙ্গী। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে উড়ে বেড়ানো পাখিদের মধ্যে স্ট্রেস হর্মোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে তার সঙ্গী নির্বাচনে। 

সন্তানের বড়ো হয়ে ওঠায় অ্যালবাট্রস দম্পতির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মা ও বাবা অ্যালবাট্রস পালা করে আড়াই মাস ধরে ডিমে তা দেয়, এবং তারপরে আরও চার মাস ধরে ছানাকে খাইয়েদাইয়ে বড়ো করে। এই অভিভাবকত্বের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে মা-বাবার ঠিকঠাক খাবার খুঁজে সময়মতো বাসায় ফিরে আসার উপর। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে খাবার খুঁজতে ব্যর্থ অ্যালবাট্রস দম্পতির ছানাও পুষ্টি পায় না। অসুখী দাম্পত্যের প্রভাব পড়ে তাদের বংশবিস্তারে। এমনিতেই আমাদের নানাবিধ কর্মকান্ডে ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র এবং তাকে কেন্দ্র করে টিকে থাকা প্রাণীজগত, তার উপরে প্রকৃতির এই বদল তাদের একটু একটু করে আরও খাদের কিনারে ঠেলে দিচ্ছে। অ্যালবাট্রসকে বলা হয় নাবিকদের বন্ধু, আমরা নিজেদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন না হলে সেই বন্ধুকে আর বেশিদিন আকাশে দেখা দেখা যাবে না। 

.....................

#Albatrosses #seabirds #Global Warming #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

33

Unique Visitors

216083