মেয়েদের লেখালিখির এলাকা
...............
নারিকেলের শস্য, স্ত্রীলোকের বুদ্ধি। করকচি বেলায় বড় থাকে না; ডাবের অবস্থায় বড় সুমিষ্ট, বড় কোমল; ঝুনোর বেলায় বড় কঠিন, দন্তস্ফুট করে কার সাধ্য? তখন ইহাকে গৃহিণীপনা বলে। গৃহিণীপনা রসাল বটে, কিন্তু দাঁত বসে না। ...
তার পরে মালা—এটি স্ত্রীলোকের বিদ্যা—কখন আধখানা বৈ পূরা দেখিতে পাইলাম না। নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না; স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়। মেরি সমরবিল্ বিজ্ঞান লিখিয়াছেন, জেন অষ্টেন্ উপন্যাস লিখিয়াছেন—মন্দ হয় নাই, কিন্তু দুই মালার মাপে।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্তের দপ্তর, মনুষ্যফল
একটি মেয়ে যেই মুহূর্তে কাগজে কলমটি ঠেকাচ্ছেন আর একটি ‘লেখা’ লিখে ফেলছেন, সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া। আজন্মকালের সামাজিক শিখে ওঠা তাঁদের বলে দেয়, মেয়েরা নিজেরা হবে না, হতেই পারবে না লেখক। কারণ সে তো লেখক-পুরুষের মিউজ হবার জন্য বলিপ্রদত্ত। নারীর রূপবর্ণনা করবেন কবি - নারী হল পুরুষের সৃষ্টিকর্মের প্রেরিকা বা প্রেরণা। শুধু লেখা কেন, আমাদের বিশ্বধারণাটাই তো এভাবে তৈরি। পুরুষ বিষয়ী, নারী বিষয়। পুরুষ জ্ঞাতা, নারী জ্ঞেয় (“স্ত্রিয়াশ্চরিত্রাঃ /দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ” এই অতি জনপ্রিয় কথনের মূলেও সে ধারণা), পুরুষ কর্ষণকারী, নারী প্রকৃতির মতো, বসুন্ধরার মতো, মৃত্তিকার মতো ভোগ্যা ও কর্ষণযোগ্যা। এই প্রাচীন দ্বৈততা ভেঙে, একজন মেয়ে নিজেকে স্রষ্টা, নিজেকে কৃষ্টির বাহিকা ভাবা মানেই তো ওই যুগযুগান্তের ভাবনাটার মূলে কুড়ুল মারা। অর্থাৎ এর ভেতরের ক্ষমতাতন্ত্রকে ভেঙে ফেলারই প্রচেষ্টা। তাই তা একটা বিপ্লব, একটা লড়াই। প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত, এর পর, সেই লড়াই জারি। কেননা, একটা কবিতা লিখে তা ছাপতে দেওয়া থেকে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে পাত পাওয়া, স্বীকৃতি, পুরস্কার, সবের গায়ে লেপ্টে থাকে, তিনি তা জানুন চাই না-ই জানুন, লিঙ্গরাজনীতি। সোজা বাংলায় জেন্ডার পলিটিক্স।
কবিতা সিংহ যখন লিখেছিলেন, "না আমি হব না মোম আমাকে জ্বালিয়ে ঘরে তুমি লিখবে না/ হব না শিমুল শস্য সোনালি নরম/ বালিশের কবোষ্ণ গরম।/কবিতা লেখার পরে বুকে শুয়ে ঘুমোতে দেব না। /আমার কবন্ধ দেহ ভোগ করে তুমি তৃপ্ত মুখ/ জানলে না কাটামুন্ডে ঘোরে এক বাসন্তী অসুখ/ লোনা জল ঝাপসা করে চুপিসাড়ে চোখের ঝিনুক।" তার ভেতরে স্বতঃপ্রকাশ ছিল, যেকোন সৃষ্টিশীল নারীর যে অশান্তি, যে বাসন্তী অসুখ নাড়াচাড়া করে দিন কাটে সেই বেদনা। এত তুখোড় ও চূড়ান্ত অব্যররথ বাক্যবন্ধে শুধু কেউ আগে বা পরে তা বলেন নি।
কবিতা সিংহের ব্যক্তিগত জীবন ঝড়ঝাপটাময় তো ছিলই, আমাদের মত পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েরা, যাদের কাছে তিনি এক আলোকবর্তিকা, রোল মডেল, তাঁদের কাছে প্রায় অমোঘ কিংবদন্তীর মতোই বলা যায় এই আশ্চর্য জীবন। আন্ডাররেটেড জীবন। পঞ্চাশের অমোঘ সব বিশালকায় কবির (অবশ্যই পুরুষ কবি, সে আবার বলতে হয় নাকি!) সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মেলানো লেখকজীবন, উপেক্ষার ইতিহাসে চাপা পড়া তবু তাঁর ভবিতব্য হয় পরবর্তীতে। খুবই হালে আবার ফিরে এসেছে এই লেখিকার প্রতি আমাদের আগ্রহ, যা খুব আশার কথা।
কবিতা সিংহের কাছে আমাদের ঋণ এই যে, তাঁর লড়াই তিনি সবিস্তারে নিজের লেখাগুলির মধ্যে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যেমন গেছেন সম্পূর্ণা দেবীর মতো একদা অজানা, আজ পুনরাবিষ্কৃত এক ব্যক্তিত্ব - ইদানীং যাঁকে পড়তে পেরে আমরা হতবাক হয়েছি। সৃষ্টির পথ কত যে বেদনার তা আশাপূর্ণা দেবীর মতো স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় লেখক লিখে গিয়েছেন। অথচ তাঁরই বোন সম্পূর্ণা দেবী নিজের জীবন দিয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং বেদনায় রক্তাক্ত হয়েছেন, কিন্তু জনপ্রিয়তা জোটেনি। মেয়েদের লেখালেখিকে পুরোদস্তুর পেশাগতভাবে গ্রহণ করা? ওরে বাবা। সে তো তাঁর ব্যক্তিগত দায়, সংসার ও পরিবার প্রতিপালনকে ‘চুলোয় তুলে দেওয়া’, এ কথা আজও আমাদের মধ্যেই ঘোরে-ফেরে। পুরুষরা কেন শুধু, মেয়েরাও তো বলেন এসব কথা।
সুতপা ভট্টাচার্য মনে করিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত কীভাবে জানিয়েছেন, মেয়েরা আদৌ কবিতা লিখতে পারে কিনা তা নিয়ে নিজেদের সংশয়ের কথা, আর নিজেই দিয়েছেন তাঁর উত্তর : “সত্যিই তো মেয়েরা কল্পনা করতে পারেই না। কবিতা লিখতে চায় যদি কোনো মেয়ে, তবে হয়তো তার বালিকা বয়সেই সে অনুভব করে নিজের কল্পনাশক্তির সীমা...। কিন্তু এমনটাই তো হবার কথা । কল্পনা যে করে সেই বিষয়ীকে নিজের মধ্যে চিনে নেওয়া মেয়েদের পক্ষে কি সহজ? যে ভাষা দিয়ে সে কল্পনা করবে, যে ছবি দিয়ে সে কল্পনা করবে , সেই ভাষা সেই ছবি পুরুষ –পেষিত সমাজের, তার সাহিত্যের। সে ভাষা সে ছবি মেয়েদের শেখায় পুরুষ নির্দেশিত এক ভুল ঐকাত্ম্য। সাহিত্যের পরম্পরা থেকে মেয়েরা সাধারণত সেই ভুল ঐকাত্ম্য গ্রহণ করে এবং প্রতিফলিত করে। নিজেকে বিষয়ী হিসেবে জানতে গেলে কোনো মেয়েকে ঘুরে দাঁড়াতে হয় সেই পরম্পরার বিপরীত মুখে। (সুতপা ভট্টাচার্য, ‘কবিতায় নারী, নারীর কবিতা’, মেয়েলি পাঠ, পৃঃ ৪৪)
২
এই বাংলার জল-মাটিতেই যে-সব মেয়েরা প্রবল লড়াই লড়েছিলেন, কলমের ডগায় তুলে এনেছিলেন মেয়েদের চেতনাকে; সেই কবে, যখন মেয়েরা সত্যি সত্যিই রান্নাঘরের বাঁদী, রাতের অন্ধকারের শয্যাসঙ্গিনী, এবং সন্তানপালিকা মাত্র। এই চিরাচরিত, স্টিরিওটাইপ ভূমিকাগুলির বাইরে গিয়ে, বা যেতে চেয়ে, একদল মেয়ে কিন্তু তখনই শিক্ষায়, স্বদেশচেতনায় অন্য এক মাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের লেখালেখিকে।
ভাগ্যক্রমে, সেই সময়টা ছিল ১৯৪৭ পূর্ববর্তী। তাই হয়ত বা, তাঁদের বয়ানের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বা স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষী দেশপ্রেমের দেশাত্মচেতনার বয়ান মিলেমিশে যায়, যাতে তাঁদের কন্ঠস্বরে একটা আলাদা জোর দেখা যায়। উল্লেখ করা দরকার যে এই সময়টাতেই কিন্তু সেই সব মেয়েদের একাংশ সক্রিয়ভাবে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামেও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এমনকি সশস্ত্র সংগ্রামের দিকেও ঝুঁকেছেন। জেল খেটেছেন।
এঁদের কলম সত্যিই তখন বিপ্লবী, সর্ব অর্থেই। কেননা সেই সমাজে, যেখানে মেনস্ট্রিম বা সংখ্যাগুরু মেয়েদের বই পড়ার, লেখাপড়া করার, লেখালেখি করারও অধিকার প্রায় নেই (যার প্রমাণ আশাপূর্না দেবী তাঁর ‘সুবর্ণলতা’-য় রেখে গেছেন), তখনই এই মেয়েরা নিজেরা পড়াশুনো করছেন, লিখছেন এবং পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করছেন।
তখন ‘মেয়েদের লড়াই’ শব্দবন্ধটি এখনকার মতো এমন জলে-ভেজা পাঁউরুটি হয়ে ওঠেনি। তখনও ‘মানুষের লড়াই’ কথাটিও ক্লিশে নয়। নিপীড়িত নিষ্পেষিত ভারতবাসী যেমন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র আর সমাজকে নতুন চোখে দেখছে, তেমনি দেখছে মেয়েদের নিজেদের দেখতে চাওয়াকেও। বিপ্লবী মেয়েদের কাগজে, কংগ্রেসি মেয়েদের কাগজ, মুসলিম মেয়েদের কাগজ, কমিউনিস্ট মেয়েদের কাগজ, সব ধরনের কাগজই এসেছে, এই সময়কালে।
একেবারে গোড়ায় কারা রচনা করেছেন? আমরা মনে করতে পারি ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব’ নামে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রবন্ধ, প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯৫ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায়। এই প্রবন্ধটি বাংলা আলোচনা জগতে প্রথম পশ্চিমী নারীবাদ এবং নারী আন্দোলনের কথা হাজির করে।
কৃষ্ণভাবিনী দাসের ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষ’ নামক প্রবন্ধটিও ১২৯৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।
এর বেশ কিছুদিন পরে, বিংশ শতকের দুই বা তিনের দশকে জয়শ্রী, মন্দিরা, সওগাতের মতো পত্রপত্রিকার পথ খুলে দেয় অনেক মহিলার লেখার। যাঁদের উদ্দেশ্য, বিশেষভাবেই, নারী বিষয়ক প্রশ্নগুলিকে তুলে ধরা।
সরলা দেবী ১৯৩১ সালে প্রস্তাব আনেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির ভেতরে পৃথক মহিলা কংগ্রেস তৈরির। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছিলেন : “এই কংগ্রেস বঙ্গনারীর আত্মচেতনার মূর্ত বিকাশ, বাংলার পুরুষের আত্মচেতনার সহিত তাহার সম্পর্ক নাই।… বাংলার নারী তাহার জীবনের বিভিন্ন বিভাগে যে বৈষম্যমূলক ব্যবহার পাইয়া আসিতেছে তাহার ফলেই এই আত্মচেতনার উদ্ভব।”
এই সময়ের মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে যদি তাকাই, দেখব আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা অনেক বিষয়েই একমত ছিলেন না। বহু বিষয় নিয়ে দুই নারী দুই আলাদা প্রেক্ষিত থেকে আলাদা যুক্তি সাজিয়েছিলেন, এই বিভ্রান্তি বোধ হয় প্রথম যুগের নারী আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পথ খুঁজতে খুঁজতে ধোঁয়াশার ভিতরে হারিয়ে যেতে যেতে পথ গুলিয়ে ফেলা, এ তো খুবই স্বাভাবিক।
যেমন, মেয়েদের শিক্ষা কেমন হবে? তারা কি পুরুষের সমান শিক্ষা পাবে? নাকি তাদের জন্য আলাদা একটা পাঠ্যক্রম তৈরি হবে? এ বিষয়ে দুই নারীর সম্পূর্ণ ভিন্ন মত ছিল।
মিস আছিয়া মজিদ বলেছিলেন, “আমাদের স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় এমন সমস্ত বিষয়ের অবতারণা করা হইয়াছে যাহা নারীর পক্ষে সম্পূর্ণ অবাস্তব। … অঙ্ক জড়বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিষয়গুলি সাধারণ মেয়েদের পরবর্তী জীবনে কোন কাজেই আসেনা, সুতরাং ঐ সমস্ত বিষয়ে মেয়েরা বৃথা সময়ক্ষেপ করিয়া থাকে। ... মেয়েদের মনে স্পষ্ট চিন্তা এবং ধারণা করিবার শক্তি জাগরিত হইলেই যথেষ্ট। … দেশীয় ভাষায় সুন্দভাবে বলিবার ও লিখিবার অভ্যাস করিতে হইবে।” (১৩৪০)
অন্যদিকে শান্তিসুধা ঘোষ লেখেন, “অন্তরজীবনের সমৃদ্ধিসাধনের জন্য জ্ঞানের যে সর্বতোমুখী বিস্তারের আবশ্যকতা, মেয়েদের বেলায় তাহাতে এত কার্পণ্য ও কুন্ঠা কেন? মনের সমৃদ্ধির জন্য পুরুষের পক্ষে যে যে পাঠ অবশ্যশিক্ষণীয় বলিয়া বিবেচিত হইতেছে, মেয়েরা তাহা হইতে বঞ্চিত হইতে কোনমতেই রাজি নয়। ... ছেলেরা অংক পারে আর মেয়েরা পারে না, অভিজ্ঞতায় জানি, ছেলেদের মধ্যে অঙ্ক সম্বন্ধে এমন নিরেটমূর্খ অনেক আছে, যাহারা কমপালসারি অঙ্ক উঠিয়া গেলে নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিত”। অথচ মেয়েদের জন্য পৃথক পাঠ্যপ্রণালীর চল তো এই সেদিন অব্দিও ছিল। ছোটবেলায় মেয়ে ইশকুলে পড়তে পড়তে দেখেছি “হোম সায়েন্স” নামে একটা বিষয় , ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক বোর্ড তৈরি হবার আগে অব্দি ছিল। ভাগ্যক্রমে কালের গর্ভে চলে গেছে হোম সায়েন্স, কিন্তু আমরা মেয়ে ইশকুলে তখনো সেলাই শিখতাম ওয়ার্ক এডুকেশনে।
ঘুরতে ঘুরতে, বাঁক নিতে নিতে, উঠে এল নারীর বাচন। প্রথম যুগের প্রবাসীতে মেয়েদের নিয়ে নানা প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখিয়েছেন তার পুরুষ সম্পাদক। কয়েক দশকের ভেতরেই, মেয়েদের সম্পাদিত মেয়েদের কাগজ “জয়শ্রী” বা “মন্দিরা” কূটতর্কে জড়িয়ে পড়েছে, পুরুষদের বাদ দেবার সম্পাদকীয় নীতি কতটা ঠিক, তা নিয়ে।
জয়শ্রীর জন্ম ১৩৩৮ বাংলা সনে। ‘জয়শ্রী’-র পুরুষ-বিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিষ্ঠাত্রী-সম্পাদিকা লীলা নাগ লেখেন, “কোনো প্রয়াসের অভিনবত্ব চিরকালই সমালোচনার বিষয়ীভূত হইয়া থাকে।” মেয়েদের কাগজ বলতেই সাংসারিক ব্যাপার, সেলাই রান্না উলবোনা নয়, এই ধারণা থেকেই জয়শ্রীর জন্ম। লীলা নাগই মৈত্রেয়ী দেবীর মত সদ্য-লেখিকাকে নিয়ে আসেন সাদরে।
এর আট বছর পরে আসে মন্দিরা, বিপ্লবী মেয়েদের জেল থেকে বেরিয়ে এসে কাগজ করার প্রেরণায়। কমলা চট্টোপাধ্যায় বা কল্যাণী দাসের মত বিপ্লবীদের হাত গড়া এই কাগজ।
১৯৪৮ সালে ‘ঘরে বাইরে’ পত্রিকা প্রকাশ করেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মেয়েরা। তার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন মঞ্জুশ্রী দেবী। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ঘোষিত হয়, কোনো জেনানা মহল বানান এই পত্রিকার উদ্দেশ্য নয়, সমান অধিকারই এর একমাত্র লক্ষ্য।
কিন্তু এই কাগজ ছিল অন্যভাবে ব্যতিক্রমী। হকার নয়, যাঁরা লিখবেন তাঁরাই বিক্রি করবে , নিজেরা বিক্রয় করে পাঠিকাদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এই কাগজ - এই ছিল প্রকল্প। নিজেরাই ছাপার কাজ দেখবেন মেয়েরা, বিজ্ঞাপনও আনবেন। একেবারে নিম্নবিত্তদের কাছে পৌঁছতে চান তাঁরা, এক কৃষক মহিলার চিঠি ছেপে তা প্রমাণও করেন। তবে এমন সব নিম্নবিত্ত মেয়েরা অভিযোগ জানিয়ে পত্রিকায় চিঠিও দেন, যে, খাবার তৈরির নির্দেশগুলি ঠিক নিম্নবিত্তের সাধ্যের মধ্যে নয়।
আবার ‘সওগাত’ নামক পত্রিকার পুরুষ-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন দোরে দোরে ঘুরেছিলেন, লেখিকাদের রচনা ও ছবি সংগ্রহের আশায়, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে। সেই কাগজে বেগম রোকেয়া লেখেন, ‘অলংকার না ব্যাজ অফ স্লেভারি’-র মত প্রবন্ধ। একজন ফজিলতুন্নেসা, বোরখা ছেড়ে শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য ইটপাটকেল সহ্য করেছেন।
গোটা দুশো বছরের একটা গমনপথ। খুব সোজা ছিল না লড়াইটা। সবচেয়ে বড় লড়াই তো লড়েছিলেন মেয়েরাই। কয়েকজন প্রগতিশীল, পরিবর্তনকামী পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে, বা তাঁদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়ে। আমরা জানি যে দীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দু সমাজ মেয়েদের ঘরের কোণায় ঠেলে রেখেছিল। আর সেই পুরু দেওয়ালের ভেতরকার জমাট বাঁধা অন্ধকারের সঙ্গে লড়াইতে রামমোহন রায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত গমনপথটুকু আমরা হয়তো সোনার আখরে লিখে রেখেছি। মেয়েদের ইশকুলের প্রবর্তন করার জন্য ইংরেজ বেথুন সাহেবের লড়াই, অথবা ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে পিয়ারিচরণ সরকারের বারাসাতে মেয়েদের ইশকুল খোলার কাহিনি, যে-স্কুল পরে কালীকৃষ্ণ গার্লস হাই স্কুল নামে বিখ্যাত হয়, এই সবটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে সেই সব অসংখ্য মেয়েদের, যারা বিদ্যাশিক্ষার দিকে ধাবিত হয়েছিলেন শত বাধা উপেক্ষা করেও। যেমন করে গাছের চারার মুখ অন্ধকার ঘরে একটিমাত্র খোলা জানালা থেকে আসা সূর্যের আলোর দিকে ফেরে। ঘুরে যায়।
আজ যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জিনিসটা আমাদের সকলের কাছেই প্রায় অনায়াসলভ্য, তখন দুশো বছর আগেকার মেয়েদের বেদনা আমরা কী করেই বা বুঝব। আর সে কারণেই ইতিহাস-বিচ্যুত বিস্মৃত আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি বিপরীত দিকে। পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছি যেন অন্ধকারের দিকেই। সিনেমায়, সিরিয়ালে, পছন্দে-অপছন্দে বেছে নিচ্ছি পশ্চাৎপদতাকে। মানসিকতায় গোঁড়া অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি।
৩
এই গোঁড়ামি অনেকটা কেটে যেতে পারে যদি আমরা পড়ি এক নারীর লেখা আত্মজীবনী। মেয়েদের আত্মকথায় কতভাবেই না আলো এসে পড়ত এই সমাজের একটা বড় অংশের ওপরে। সে অংশের মুখে প্রায়শই ভাষা থাকত না। বাংলাভাষা এমনই এক ভাষা, যে ভাষার প্রথম আত্মজীবনীই এক নারীর লেখা - রাসসুন্দরী দেবীর ‘আমার জীবন’। আমরা কৃতার্থ, আমরা ধন্য যে, এই আত্মজীবনীতে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে পুববাংলার এক গ্রামে জন্ম নেওয়া মেয়ের কলম কাজ করে গেছে কেবলই নিভৃতে। গৃহের সব কাজ শেষ করে, প্রতিটি অনুপুঙ্ক্ষ সংসারধর্মের কর্তব্যকর্ম করার পর, দিনশেষে, বা মধ্যাহ্নের নীরব নির্জন ক্ষণে খাতা খুলে ছোটবেলায় ভাইয়েদের পাশে বসে পন্ডিতমশায়ের কাছ থেকে শেখা সামান্য অক্ষরজ্ঞানের সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে লিখে রাখা মনের কথা। একান্তে সখীদের বলার কথাগুলি, দিনান্তে নিজের আয়নার সামনে বসে নিজেকে বলার কথাগুলি, শব্দে আর অক্ষরে প্রকাশ করে রাখা। এই তো মেয়েদের আত্মকথার পরিসর। তাঁদের শ্রোতা থাকে না, পাঠক থাকে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ জানতেও পারে না তাদের এই লেখার কথা। ভয়ে, সংশয়ে, কুন্ঠায় তাঁরা নিজেদের এই লেখা কারুকে দেখান না। অন্যেরা হাসবে, মজা করবে ভেবেও হয়ত বা। অন্য মানে শিক্ষিত পুরুষ, অন্য মানে স্বামী-শ্বশুর-ভাশুর , যাঁরা সমাজে লেখালেখির জন্য নির্বাচিত, ক্ষমতায়িত। যাঁদের কোনো বাধা নেই কোথাও, পড়তে আর লিখতে। তাঁদের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, এসবকে উপেক্ষা করে এই যে বিছানার নিচে বা বালিশের তলে রাখা রুলটানা খাতার নিজস্ব জার্নি - একে যখন আমরা ছাপার অক্ষরে পড়তে পাই, অনেকখানিই দেখি অনুল্লেখের তলায় চাপা পড়ে থাকা কথাদের। নীরবতাগুলিই তখন অনেকটা বলে দেয়। বলা কথার থেকে না-বলা কথাই তখন সাক্ষ্য দেয় অনেকখানি।
আরও পড়ুন : স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা সংবাদপাঠক সাইদা বানো / পূরবী রায়
নিজের পরিপার্শ্বকে লিখে রাখেন মেয়েরা এই সব আত্মজীবনীতেই। আবার একইসঙ্গে নিজেকেও লেখেন বইকি। তাই পড়তে হয় নটী বিনোদিনী নামে বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর ‘আমার কথা’। অথবা সাহানা দেবীর ‘স্মৃতির খেয়া’। পড়তে হয় স্টিরিওটাইপের ভিতরে থাকা মেয়েদের কথা, আবার স্টিরিওটাইপ ভাঙতে চাওয়া মেয়েদের কথাও।
সংসারী মেয়েরাই মেয়েদের স্টিরিওটাইপ, তাই বিনোদিনী যখন সংসারহীনতার কথা বলেন, অথবা সাহানা বলেন “সংসার করতে ভাল লাগত না” - তখন আমরা পাই ছাঁচভাঙা এক অন্য জগতের কথাই।
অথবা মনীষা রায়ের ‘আমার চার বাড়ি’ এক অর্থে কোনো মেয়ের নিজস্ব বাড়ি খুঁজে পাওয়ার যাত্রা যেন।
৪
অসম্ভব জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, মেয়েলি কথা লেখার দোষে আশাপূর্ণা দেবীকে শুনতে হয়েছিল তিনি ‘ঘরেলু’ লেখক, ঘরোয়া গল্প লেখেন। মেয়েরাই লেখেন মেয়েরাই পড়েন এসব বাড়ির বউ-ঝিদের গল্প। অথচ কী আশ্চর্য দক্ষতায় আশাপূর্ণা দেবী তছনছ করে ভেতর অব্দি খুলে দেখিয়ে দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের কাঠামোকে। গল্পের শেষ মোচড়ে উল্টে দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের খেলাটাকে। আমরা ছোটবেলার পাঠাভ্যাসে শিখেছিলাম উল-বোনার মতই আশাপূর্ণা দেবীর গল্প পড়াও গৃহবধূদের কাছে দিবানিদ্রার বিকল্প। এই ভুল শিক্ষা ভাঙতে প্রয়োজন হয়েছিল একজন নবনীতা দেবসেনের। তথ্যটি প্রথম পাই তাঁরই এক লেখায়, পাক্ষিক দেশ পত্রিকায় (বই সংখ্যা ২০০৯)। জ্ঞানপীঠ বাংলাভাষার মনোনয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে নবনীতা দেবসেন আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসের নাম প্রস্তাব করলে অপর দু-জন পুরুষ সদস্য আপত্তি তোলেন। মজার কথা, এই দুই সম্মানিত সদস্যের কেউই কিন্তু তখনও অব্দি ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ বইটি পড়েননি। কেনই বা পড়বেন। মেয়েলি লেখা তো। যা-ই হোক, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নবনীতা দেবসেন অন্য সদস্যদের মত পাল্টাতে সমর্থ হন। আশাপূর্ণা দেবী ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কারে ভূষিতা হন। নবনীতা লিখেছেন, “জ্ঞানপীঠের আলোকে এক ওজনদার মহৎ লেখিকাকে অবশেষে আবিষ্কার করলেন বাংলার উন্নাসিক বিদগ্ধ সমাজ।” নবনীতা রুখে না দাঁড়ালে ‘নারীর সাহিত্য’ আজও ততটাই ব্রাত্য থেকে যেত।
এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে, তবে উল্লেখ্যগুলিই বলি। সুচিত্রা ভট্টাচার্য একবার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে, যে, কোনো সভাটভায় কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাঁরা বলেন - আপনি তো বিখ্যাত, আমার স্ত্রী আপনার খুব ফ্যান। মেয়েদের লেখা কেবল মেয়েরাই পড়বেন এই অলিখিত নিয়ম একদিকে মানসিক বেড়ি পরায় মেয়ে লেখকদের, অন্যদিকে পুরুষের সঙ্গে একসঙ্গে নাম উচ্চারিত না হবার সমস্যা তো থেকেই যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন একটি লেখায়, বর্তমান কবিতার প্রবণতা আলোচনা করতে করতে, সারিবদ্ধভাবে পুরুষদের নাম করতে করতে এক সময়ে থেমে তিনি বলেন - এই রে, মেয়েদের নাম না বললে আবার নবনীতা খুব রাগ করবে। এবং পরের অনুচ্ছেদে পর পর মেয়েদের নাম আসে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘They also ran..’। যে কোনো ক্ষেত্রের মত লেখালেখিতেও পুরুষের একচেটিয়া আধিপত্যের ব্যাপারটা এই অসাড়ে অচেতনে আমাদের ভেতরে আত্মীকৃত যে, মেয়েদের নামোল্লেখ করতে ভুলে যাওয়া যায় ও তারপর শুধরে নিয়ে সসম্মানে, "এঁরাও আছেন, এঁরাও লেখেন" বলা হয়। এতেই যেন আরো পরিস্ফুট হয়, মোটা দাগে দেগে যায় পুরুষতন্ত্রের সূক্ষ্ম ও ততটা-সূক্ষ্ম-নয় রাজনীতি।
এইসবের মধ্যে দিয়েই আজকে যে পরিমাণ মেয়েরা লিখে চলেছেন সেই সংখ্যাটা আশাপ্রদ। আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের চেয়ে প্রায় কয়েক গুণ বেশি। ৩৩% সংরক্ষণের প্রয়োজন কবিতা বা গদ্যের ক্ষেত্রে আছে কিনা তা নিয়ে হাসাহাসি করলেও, এই সংখ্যাবৃদ্ধির ঘটনাটা লক্ষ করার মতই। যে-কোনো পত্রপত্রিকায় চোখ বোলালে তা বোঝা যায়। আবার একইসঙ্গে এ-ও ঠিক যে, মান্য পত্রিকাগুলির শারদ সংখ্যায় একটি জেন্ডার অডিট বা সোজা কথায় মেয়ে-শুমারি করলেই দেখা যাবে এখনো গল্প-উপন্যাস-কবিতায় সংখ্যালঘুই আছেন মেয়েরা। তাঁদের স্বর হয়তো আগের চেয়ে স্পষ্ট ও সংহত। আত্মসচেতনও।
আরও পড়ুন : আগুনের ফুলকি, খোলা চুলের নিশান আর প্রতিবাদের নতুন ভাষ্য / রণিতা চট্টোপাধ্যায়
৫
কোথাও যেন বড় অসম্পূর্ণ মনে হয় মেয়েদের লেখার জীবন। সাফল্য এলে সঙ্গে সঙ্গে তার পিছে আসে সন্দেহ - ও কাকে ধরেছিল? কোন কোন সম্পাদকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে লেখা ছেপেছে? কীভাবে পুরস্কার পেয়েছিল? নিখাদ গুণের জন্য স্বীকৃতি কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করা হয় না মেয়েদের ক্ষেত্রে। স্বার্থোদ্ধার করতে নারীত্বের দাঁত-নখ ব্যবহারের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে মানুষের কথায়, ঠারে-ঠোরে।
অন্যদিকে, আজো রবীন্দ্রনাথের ‘খাতা’ গল্পের উমার মতো ভয়াবহ বেদনার না হলেও, অনেক মেয়ের লেখা গোপন খাতাতেই থেকে যায় বন্ধু-দাদা-বাবা-জ্যাঠা-স্বামী-পার্টনার বা অন্য পুরুষ সদস্যদের কাছে হাস্যাস্পদ হবার ভয়ে। অন্তত বছর চল্লিশেক আগে আমার যে গোপন কবিতার খাতা ছিল তা আমি অন্তত জানি। আত্মপ্রকাশের জন্য কোন ফেসবুক-টুইটার ছিল না তখন। সেলফ পাবলিশিং দূর অস্ত ছিল।
আর কে না জানে যে পিছু ফেরার জন্য আমরা মুখিয়ে আছি, তাই আজ আর রবীন্দ্রনাথের লেখার এই লাইন কটি অস্বাভাবিক কিছু মনে হয় না -
প্যারীমোহন এই সংবাদ অবগত হইয়া বিশেষ চিন্তিত হইল। পড়াশুনা আরম্ভ হইলেই নভেল-নাটকের আমদানি হইবে এবং গৃহধর্ম রক্ষা করা দায় হইয়া উঠিবে।
তা ছাড়া বিশেষ চিন্তা দ্বারা এ বিষয়ে সে একটি অতি সুক্ষ্ণতত্ত্ব নির্ণয় করিয়াছিল। সে বলিত, স্ত্রীশক্তি এবং পুংশক্তি উভয় শক্তির সম্মিলনে পবিত্র দাম্পত্যশক্তির উদ্ভব হয়; কিন্তু লেখাপড়া শিক্ষার দ্বারা যদি স্ত্রীশক্তি পরাভূত হইয়া একান্ত পুংশক্তির প্রাদুর্ভাব হয়, তবে পুংশক্তির সহিত পুংশক্তির প্রতিঘাতে এমন একটি প্রলয়শক্তির উৎপত্তি হয় যদ্দ্বারা দাম্পত্যশক্তি বিনাশশক্তির মধ্যে বিলীনসত্তা লাভ করে, সুতরাং রমণী বিধবা হয়। এ পর্যন্ত এ তত্ত্বের কেহ প্রতিবাদ করিতে পারে নাই।
প্যারীমোহন সন্ধ্যাকালে ঘরে আসিয়া উমাকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করিল এবং কিঞ্চিৎ উপহাসও করিল--বলিল, 'শামলা ফরমাশ দিতে হইবে, গিন্নী কানে কলম গুঁজিয়া আপিসে যাইবেন।'
বিচিত্ররূপে হাসির খোরাক, ইয়ার্কি ও চোখ ঠারাঠারির বিষয় হয়েও যে মেয়ের সুবুদ্ধি হয়না, ভেতরের তাগিদে ওই উমার মত তারা লিখেই চলে লিখেই চলে, জীবন তাদের জন্য বাদামি লেফাফায় পত্র পাঠায়। কোন বিখ্যাত পুরুষ কবির সঙ্গে মেয়েটি রতিক্রিয়া করেছেন, তার কাল্পনিক বিবরণ ভুল বানানে ও বীভৎস ডিটেলিং এ পেশ হয় সে পত্রে। পড়ে, রবীন্দ্রনাথের উমার মতই বলতে ইচ্ছে করে, "তোদের দুটি পায়ে পড়ি ভাই--আমি আর করব না, আমি আর লিখব না।
ধরে নেওয়া যাক, এই সব সত্ত্বেও কোন মেয়ে লিখতেই লাগলেন, লিখেই চললেন। প্রথমটা তাঁকে সুসভ্য সমাজ পিঠ চাপড়ায়, বলে - বাহ তোমার কলমটা খুব পুরুষালি তো! কিন্তু দিনের পর দিন নিজের মেয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভর্তি হতে হতে একদিন তিনি লিখে ফেলেন মেয়েদের বাস্তবতাই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘নারীবাদী’ বলে তাঁকে বর্জন করা হয়। অথবা খন্ডিত, বদ্ধ বাস্তবতার কথা লেখেন বলে ঠারে-ঠোরে ইঙ্গিত করা হয়। কল্পনাশক্তির অভাবেই এসব হয় কিনা!
আসলে, মেয়েরাও কখনো কখনো বাধ্য হন একমাত্র নিজেদের এই ভয়াবহ বাস্তবতার কথাই লিখে যেতে। আর চারিপাশের উদারমনা সাহিত্যমনা পুরুষ বন্ধুরা চুক-চুক করে বলেন - ধুস, তোমরা বড় এক পেশে, বড় বদ্ধ। উন্মুক্ত এই পৃথিবীতে ঘুরে দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এই মহান মানবসভ্যতাকে নিয়ে কিছুই লিখতে পারলে না। ক্লাসিক মাত্রেই জীবন দেখার গল্প। তোমরা কি জীবন দেখেছ?
আরও পড়ুন : মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি কোনো দেবদাসীর নাম নয় / রোহন রায়
আর আমাদের সময়ের কবি সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
“কবিতা মানে আমার কাছে এই । নিজেকে রক্তাক্ত হতে দেখা ও একইসঙ্গে সেই রক্ত পান করা। নারী কবিতায় বস্তুত এ ছাড়া আর কিছু আছে কি? হ্যাঁ আছে প্রেম আছে বাৎসল্য, আরো আছে একসঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে যাওয়া । শেষ পরযন্ত বেঁচে থাকাও, বেঁচে থাকাই।
... একথা জেনেও যে, নারীকবিতা আজও একটি মার্জিনাল অবস্থানে রয়েছে। কত কী-ই যে লিখতে দেওয়া হয়নি মেয়েদের – সাফো বা অ্যাড্রিয়েন রিচ সত্ত্বেও নারী সমকামিতা কি জায়গা পেয়েছে তেমন করে কবিতায় ? কোথায় অন্তেবাসীর উচ্চারণ? কালো মেয়েদের ব্লুজ গানের সঙ্গে আমাদের ছাদপেটানো মেয়েদের গানকে কি তুল্যমূল্য করা হয়েছে? নারীর যৌনতা, পুরুষশরীরের প্রতি নারীর মুগ্ধতা কবিতায় কতটুকু?”
(সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কবিতা ভাবনা, কবিতা প্রতিমাসে, জুন ২০০৭)
সিলভিয়া প্লাথ বলেছিলেন তাঁর বড় সাধ যায় ট্রাকে চেপে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, কালো রাত্রির তারা দেখতে ট্রাকের খড়ের গাদায় শুয়ে। মেয়ে বলে পারলেন না। তাঁর বায়োলজি তাঁকে করতে দিল না এইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়।
কাঠের বাক্সে বরফ দিয়ে প্যাকিং-হওয়া মাছের বরফ-দেখাই একমাত্র ভবিতব্য, আকাশ-দেখা নয়। জেলখানার মানুষের চোখে ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশের তারা দেখার আগে গরাদের কালো কালো দাগগুলোই ভাসে।
..............................
ফিচারহেড ও সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র