জর্জ ইস্টম্যান : যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল বিখ্যাত কোডাক কোম্পানি
সময়ই আসল হিরো। ইউনিভার্সাল বস। মানুষকে রাজাও বানায় সময়, তাকেই আবার ভিখারিও বানায় সে-ই। যে যত দোর্দণ্ডপ্রতাপই হোক, এক্সপায়ারি ডেট সবার আসে। অমন সিপিয়েম কোনওদিন বাংলা থেকে বিদায় নেবে কেউ ভাবতে পেরেছিল? নাকি কেউ ভাবতে পেরেছিল বলিউডের কিং খানকে একটা ব্লকবাস্টারের জন্য বছরের পর বছর চাতকের মতো অপেক্ষা করতে হবে? তেমনই কেউ বোধহয় ভাবতে পারেনি, ফটোগ্রাফির বৃহত্তর জগতটা কার্যত যাঁদের হাতে শুরু সেই কোডাক কোম্পানি ধুঁকতে ধুঁকতে ২০১২ সালে অবশেষে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করবে।
ডিজিটাল ক্যামেরা আসার আগে ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় প্রায় একচ্ছত্র সাম্রাজ্য ছিল এই কোডাক কম্পানির। ‘হ্যাভ আ কোডাক মোমেন্ট’ ক্যাচলাইনটি দখল করে রেখেছিল সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়। আনন্দঘন প্রতিটি মুহূর্তের সমার্থক হয়ে গিয়েছিল কোডাক। আর এই বিখ্যাত সংস্থার জন্ম যাঁর হাত ধরে, তিনি এই কিছুদিন আগে পেরিয়ে গেলেন ১৬৬ তম জন্মদিন। তিনি জর্জ ইস্টম্যান। আমেরিকার সবচেয়ে সফল উদ্যোগপতিদের মধ্যে একজন।
ইস্টম্যানের জন্ম ১২ জুলাই, ১৮৫৪ সালে নিউ ইয়র্কের ওয়াটারভিলে। প্রথাগত শিক্ষায় হাইস্কুলের বেশি এগোতে পারেননি। একজন সাধারণ ব্যাঙ্ককর্মী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিয়তি তাঁর জন্য অন্যরকম ভেবে রেখেছিল। ১৮৮৪ সাল নাগাদ তিনি আবিষ্কার করেন ড্রাই প্লেট (dry plate) তৈরির ফর্মুলা। এই ড্রাই প্লেটই স্থিরচিত্রের মূল উপাদান। তারপর তিনি আবিষ্কার করেন সেলুলয়েড ফিল্ম এবং তার উপরের আস্তরণ (emulsion)। সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ তে হেনরি স্ট্রং- এর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক ‘ইস্টম্যান কোডাক’ কোম্পানি। প্রথমে বক্স - টাইপ ক্যামেরা, তার কিছুদিন পর ফোল্ডিং ক্যামেরা আর ১৮৯৫ সালে তাঁরা নিয়ে আসেন পকেট ক্যামেরা। কোডাকের ক্যামেরা খুব কম সময়ের মধ্যে বিপুল বাজার তৈরি করে ফেলে। তবে ক্যামেরা নয়, কোম্পানির লাভের সিংহভাগ আসত ফিল্ম বিক্রি থেকে।
১৮৯৮ সালে ইস্টম্যান প্রায় দশ লাখ ডলার দিয়ে লিও ব্যাকল্যান্ডের কাছ থেকে কিনে নেন ভেলক্স ফটোগ্রাফিক পেপারের পেটেন্ট। আর কোডাকের সেই স্বর্ণযুগে কোম্পানির মোট কর্মীসংখ্যা ছিল দেড় লাখের কাছাকাছি। ১৯০০ সালে তাঁরা বাজারে ছাড়েন কোডাক ব্রাউনি নামে খুব সস্তা কার্ডবোর্ড বক্সের একটি ক্যামেরা। মাত্র এক ডলার দামের এই মডেলটি অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পায়। এক -একটি ফিল্ম রোলের দাম ছিল ১৫ সেন্ট। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ব্রাউনি। বছর দুয়েক পর ইস্টম্যান টমাস আলভা এডিসনের জন্য পঁয়ত্রিশ মিলিমিটার মাপের ফিল্ম তৈরি করেন। তারপর কোডাক কোম্পানি স্থিরচিত্রের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের উপাদানেরও একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে দেয়। জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ফুজিফিল্ম’ বাজারে থাকলেও কোডাককে কখনোই তারা টেক্কা দিতে পারেনি।
ইস্টম্যানের শেষটা অবশ্য খুবই দুঃখজনক। মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাথাও ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠছিল। মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন ইস্টম্যান। ১৯৩২ সালের ১৪ মার্চ, তিনি গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তবে তাঁর মৃত্যুতে থেমে থাকেনি কোম্পানির জয়যাত্রা। ১৯৩৫ সালে কোডাক্রোম কালার ফিল্ম উদ্ভাবন করে নিজেদের একেবারে প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায় কোডাক। ক্যামেরায় ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে সনাতন রীতিকে প্রবল ধাক্কা দেবার আগে পর্যন্ত এই কোডাক্রোম নিয়ে কোডাক কোম্পানি দাপিয়ে রাজ করেছে ফটোগ্রাফির দুনিয়ায়। জর্জ ইস্টম্যানের স্বপ্নকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কোডাক কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে কোডাক আজ বিদায় নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীতে ক্যামেরা জিনিসটা যতদিন থাকবে, কে ভুলতে পারবে পাঁচ শব্দের এই ইংরিজি নামটাকে? তার সঙ্গে অমর হয়ে থাকবেন জর্জ ইস্টম্যানও।
#ইস্টম্যান কোডাক #কোডাক #জর্জ ইস্টম্যান