নিম্নবর্গের জন্য কাজ করতে গিয়ে দীর্ঘ কারাবাস হয়েছিল বিদেশিনী ‘নকশাল’ মেরি টাইলারের
ইতিহাস কেবল সময়ের শুকনো ধারাবিবরণী নয়। তার হলুদ পাতার ভাঁজে ভাঁজে চাপা পড়ে থাকে কতশত অজানা গল্প। বিদেশি অনেক ভারতবন্ধুর কথা আমরা মনে রেখেছি। মেরি টাইলারকে সেভাবে মনে রাখিনি। ক্ষমতায়নের রাজনীতিতে দর পায়নি এই ব্রিটিশ তরুণীর গল্প। বাঙালি যুবক অমলেন্দু সেনের সঙ্গে স্কুলশিক্ষিকা মেরির আলাপ হয়েছিল জার্মানিতে। তারপর তাঁকে ভালোবেসে তাঁরই হাত ধরে ভারতে আসা। তার পরের পর্বটা সত্যিই গল্পের মতো।
পাশ্চাত্যের বৈভব আর নানা দেশ ঘুরে দেখার স্বপ্ন বুকে নিয়ে যে মেরি টাইলারের বেড়ে ওঠা, ১৯৭০-এ কলকাতায় এসে থিতু হওয়া মেরির সঙ্গে তার কতটা মিল ছিল জানা নেই। লন্ডনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মেরি ‘ক্যাম্পেন এগেইনস্ট রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন’-এর কাজে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময়েই জার্মানি বেড়াতে এসে তাঁর আলাপ হয় অমলেন্দুর সঙ্গে। জার্মানিতে ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত অমলেন্দু ছিলেন অতিবাম আদর্শে বিশ্বাসী। হয়তো মানসিকতার মিলই দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে দিয়েছিল। কলকাতার উত্তাল সময়ের আঁচ ওই সুদূর জার্মানিতে বসেও টের পাচ্ছিলেন অমলেন্দু। তাই বিদেশের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কলকাতা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ হলে হয়তো এখানেই ছেদ পড়ত মেরি আর অমলেন্দুর বন্ধুত্বে। কিন্তু অমলেন্দুর প্রতি মেরির ভালোলাগা, বন্ধুত্ব যে নিছক ক্ষণিকের মোহ ছিল না, তা বোঝা যায় অমলেন্দুর সঙ্গে তাঁরও কলকাতা চলে আসায়। এসে মেরি উপলব্ধি করেন কলকাতাসহ গোটা ভারতের ভগ্নপ্রায় চেহারাটা। অমলেন্দু তখন স্বেচ্ছায় বেকারত্ব গ্রহণ করা যুবক, দু-চোখে দিনবদলের স্বপ্ন। না, মেরিও আর ফেরেননি দেশে। বরং অমলেন্দুর বিবাহ প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর পাশে থেকে লড়ে গেছেন এ শহরের জন্য, দেশের জন্য। জড়িয়ে পড়েছেন নকশাল আন্দোলনে। বাংলা- বিহার সীমান্তের গ্রামগুলিতে আদিবাসীদের মধ্যে শ্রেণিচেতনা আর কৃষক সংগ্রামের গুরুত্ব প্রচারে তখন ব্যস্ত তাঁরা। ওখানেই মাসখানেকের মধ্যে গ্রেফতার হন দু-জনে।মেরির ওপর নেমে আসে পাঁচ বছরের বিভীষিকাময় কারাদণ্ডের পরোয়ানা। দু-জনকেই রাখা হয় বিহারের হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে।
খুব খারাপ সময়েও কিছু মানুষ হাসতে জানে, ভালবাসতে জানে। পুলিশ অফিসারদের জেরার উত্তরে নিজের যাপনবৃত্তান্ত শোনানোই যেন তখন তাঁর আনন্দের রসদ। সহজেই বন্ধু করে নিয়েছিলেন পাশের সেলে বন্দিনী কল্পনা, সাইবুন্নিসা ও রোহিণীদের। রজস্বলা মেরিকে কারাগারে পুলিশ এক টুকরো কাপড় অবধি দেয়নি। সেখানেই আবার আরেক বর্ষীয়ান বন্দিনী মোহিনী মাতৃস্নেহে শুশ্রূষা করেছেন তাঁকে। সেলের ভিতরেই নকশাল সহকর্মীদের পিটিয়ে বা গুলিবিদ্ধ করে হত্যার সাক্ষী থেকেছেন মেরি। জেলে নানারকম অত্যাচার হত। একদিন জোর করে খাওয়ানো হয়েছিল ইঁদুরের মাংস। পুরুষ সেলে তখন অমলেন্দুদের অবস্থা আরও খারাপ । বন্দীদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো। আলোহীন জলহীন সেলে প্রত্যেক বন্দীর সঙ্গে একজন করে পাগল বন্দী রেখে দেওয়া হত। কিন্তু দেশ গড়ার স্বপ্ন যাদের বুকে তাদের যে এত সহজে ভেঙে পড়তে নেই। মেরি টাইলার বা অমলেন্দুদের জীবনের সঙ্গে বারবার মিলে যায় কাজী নজরুলের সেই অমোঘ উক্তি... “ আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা আর পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।”
পাঁচ বছর পরে মেরি মুক্তি পান। তাও নিছক আন্তর্জাতিক সুবিধালাভের কুটিল রাজনৈতিক চালের ঘুঁটি হিসেবে। কারণ হিসেবে খাতায় কলমে দেখানো হয়েছিল ‘Inexpediency’। মেরি দেশে ফিরে যেতে চাননি, বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। দেশে ফিরে তিনি বন্দিজীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, যা ‘My Years in an Indian Prison’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত খারাপ-লাগাকে ছাপিয়ে সে অভিজ্ঞতালিপিতে দগদগে হয়ে আছে সামগ্রিকভাবে ভারতীয় জেলের ভয়ঙ্কর অব্যবস্থার ছবিটি। ভারতীয় সমাজের প্রতি তাঁর মূল্যায়ন একটি বাক্যেই স্পষ্ট, যাতে জড়িয়ে আছে অমলেন্দুর প্রতি তাঁর নিবিড় ভালোবাসাও : “Amalendu’s Crime… is the crime of all those who cannot remain unmoved and inactive in an India… where justice is the exception and injustice the rule.”
ব্রিটিশলাঞ্ছিত ভারতের ইতিহাস আজও যাদের মনে যন্ত্রণার স্মৃতি উসকে দেয়, তাদের বুকের ক্ষতে মেরি টাইলারের মতো মানুষেরা বোধহয় ক্ষণিক মলমের মতো।
[ পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#ফিচার