For Night Will Come: রক্তপানের রূপকথা ও বাস্তব
........................
চলচ্চিত্র : En Attendant La Nuit (ফর নাইট উইল কাম) [২০২৩] পরিচালক : Celine Rouzet দেশ : ফ্রান্স
“এমন বাইসন নাথ কেন মারো, কীসে মারো,
যার রক্ত থেমেও থামে না?”
(গুহামানবীর চিঠি, রাকা দাশগুপ্ত)
১
খুব ছোট থেকেই আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা ছেলেটি। সে মনে করে রাতে তার ঘরে ভ্যাম্পায়াররা আসে। তার সঙ্গে কথা বলে। তাদের সঙ্গে একধরনের অদ্ভুত আত্মিক যোগাযোগও অনুভব করে সে।
এর ফলে, যা হওয়ার ছিল, তাই হয়। খুব সহজেই ছেলেটির গায়ে এঁটে যায় ‘অস্বাভাবিক’-এর তকমা। অথচ সেও তো আর সকলের মতোই হতে চেয়েছিল দিনের শেষে। কিন্তু ‘আর সকলে’ কি রাজি ছিল হাত বাড়িয়ে দিতে? চিনে নিতে চেয়েছিল তার মধ্যে থাকা সত্যিকারের মানুষটাকে?
যে বা যারা চিনতে চেয়েছিল, তাদের একজন ছিল তার বোন। দাদাকে ভালোবাসত বলেই সে বুঝতে পারে, ‘অস্বাভাবিকতা’র খোপে আটকা পড়ে যাওয়া কতখানি কষ্টের। চোখের সামনে দেখে কীভাবে একজন একলা, বিচ্ছিন্ন মানুষ বিষাদের অন্ধকারে ঢেকে যায়। রাগ হয় তার। সমাজ যেভাবে তার দাদাকে ঠেলে দিচ্ছে অবসাদের কিনারে, তা নিয়ে ক্ষোভ জমতে থাকে। ভেবে পায় না কীভাবে সবাইকে জানাবে তার অভিমানের আখ্যান।
২
না, ওপরের অংশটুকু কোনও সিনেমা ওয়েব-সিরিজের গল্প নয়। এ নিছক সত্যি ঘটনা। পরিচালক Celine Rouzet-এর নিজের জীবনচিত্রের টুকরো অংশ। ‘অস্বাভাবিক’ দাদার বোনটি নিজেকে মেলে ধরার ভাষা খুঁজে পেয়েছিল চলচ্চিত্রের পর্দায়। তাই তার প্রথম ফিকশন-ফিল্ম অনিবার্যভাবে হয়ে উঠল মানুষ নামধারী জীবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কাহিনি। প্রতিবাদ, কিন্তু উচ্চকিত নয়। বহু মানুষের সম্মিলিত নিষ্ঠুরতা যে বেদনার জন্ম দেয়, সেই যন্ত্রণার মন্তাজই ধারণ করে রইল ‘En Attendant La Nuit’।
৩
একদিকে রমরমিয়ে চলছে সন্দীপ রেড্ডির Animal। অন্যদিকে চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ হিসেবে প্রায় ফাঁকা হলে দেখানো হচ্ছে এই ফরাসি ছবি। মজার ব্যাপার, এর নামও ‘Animal’ হলে ব্যঞ্জনার ঘাটতি হত না। এ ছবির নায়কের জন্ম কিছু পশুসুলভ, বা বলা ভালো, ‘ভ্যাম্পায়ারসুলভ’ বৈশিষ্ট্য নিয়ে। বেঁচে থাকতে হলে তার নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন। রোদের প্রত্যক্ষ ছোঁয়া যে তার জন্য ক্ষতিকর, তা ছবির প্রথম দিক থেকেই খানিক আন্দাজ করা যায়। এই পর্যন্ত আন্দাজ করার পর, সংশয় হয়, এ ছবিও শেষপর্যন্ত ভ্যাম্পায়ার-থিম নিয়ে তৈরি অগণিত হরর ছবির ভিড়ে মিশে যাবে না তো? শেষ অবধি হতাশ করেন না পরিচালক।
এ ছবির সিনেমাটোগ্রাফি, ক্যামেরা, অসামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর গল্প বলার কৌশল যেন কাব্যময় রহস্যঘেরা এক গথিক সৌন্দর্যের আবহ তৈরি করে। খুব অল্প সংলাপ এখানে অনেক কথা বলে। নিখুঁত নৈপুণ্যে তুলে ধরে পরস্পরকে আগলে-রাখা এক পরিবারের ছবি। তার আলো-অন্ধকার। তার মায়া-যন্ত্রণা-ধৈর্যচ্যুতি-সংশয় – সবটুকু। ‘বুলি’ করার উৎকট উল্লাসে সিনেমাহলের মধ্যে প্রতিবেশী ‘বন্ধু’রা দাদার মাথায় পপকর্নের ঠোঙা উপুড় করে দেয়। আর উল্টো আঘাতের চেষ্টা না করে প্রাণপণে চোখের জল চাপতে থাকে ছেলেটি। এতক্ষণ ধরে হরর সিনেমা দেখার ভয়ে দাদার হাত ধরে সিঁটিয়ে থাকা বোনের ছোট্ট অপটু হাতই তখন তৎপর হয়ে ওঠে, দাদার মাথায় ছড়িয়ে পড়া পপকর্ন সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়। এমন একটা দুটো দৃশ্যই দাদা-বোনের মায়াবী সম্পর্ককে বুনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে হয়। পেশায় নার্স মায়ের স্নেহের তীব্রতা বোঝা যায় প্রতিদিন রক্ত সংগ্রহ করে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায়। বাবা-মা দুজনেই লড়ে যান সন্তানদের যথাসম্ভব সুস্থ-সুন্দর ‘স্বাভাবিক’ জীবন দেওয়ার তাগিদে। তবু ছেলের সম্পর্কে সন্দেহকেও এড়িয়ে থাকতে পারেন না। এদিকে ছেলেটি, নিজের অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ভাবে, নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষদের কাছেই বুঝি বোঝা হয়ে উঠছে সে। আবার নায়কের বান্ধবীটি যখন বলে ওঠে, নিজের চারপাশের সমস্ত কিছুই কৃত্রিম মনে হয় তার, মনে হয় এই ‘অদ্ভুত’ বন্ধুর পরিবারের মধ্যেই বোধহয় কিছু সত্যি লুকিয়ে আছে – তখন দুই ব্যতিক্রমী কৈশোরের নৈকট্য চমৎকার এক প্রেমের আখ্যানও তৈরি করে ফেলে।
৪
সার্থক ফ্যান্টাসি আমাদের বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে যায় না। বরং বাস্তবকেই নিজের মতো করে ছুঁয়ে থাকতে সাহায্য করে। এই ছবিতে ফ্যান্টাসি ঠিক ততটুকুই, যতটুকু দরকার বাস্তবকে বোঝার জন্য। সেই কারণেই হয়তো কোনও ভণিতা না রেখে ছবির শুরুতে জানিয়ে দেওয়া হয়, এ কাহিনি ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে।’ জানিয়ে দেওয়া হয় এই ছবির ঘটনাক্রমের শুরু ১৯৮০ সালে।
ছবির কেন্দ্রে থাকা পরিবারের প্রতিটি সদস্যই বারবার বলে তারা এই ছায়াঘেরা নতুন জায়গায় এসেছে, ‘মানুষ’-এর কাছাকাছি থাকার জন্য। ‘কমিউনিটি’ পাওয়ার জন্য। কিন্তু সত্যিকারের মানুষকে কি শেষপর্যন্ত পাশে পায় তারা? ছবির মূল চরিত্রের জান্তব প্রবৃত্তি তো তার সহজাত। কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই কি জান্তব অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় না কোনও না কোনও সময়ে? যুদ্ধ সহজ হয় অন্য মানুষকে পাশে পেলে। অথচ যার ক্ষেত্রে অন্ধকার আসে প্রকাশ্য ‘অস্বাভাবিকতা’ হয়ে, তাকে সমাজ ঠেলে দিতে চায় আরও অন্ধকারের দিকে। হিংসার দিকে। পশুপ্রবৃত্তির দিকে।
আর সেই সংবেদনহীন নিষ্ঠুরতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকে এই কাহিনির নায়ক। যার নাম Philemon. ফিলেমঁ শব্দের অর্থ ভালোবাসায় পূর্ণ, স্নেহময় অথবা চুম্বন। আলাদা হয়ে পড়ার নিয়তি নিয়ে এসেও সে ভালোবাসতেই চেয়েছিল। বেঁধে বেঁধে থাকতে চেয়েছিল অন্য মানুষের সঙ্গে। আঘাত পেয়েও চেষ্টা করেছিল আঘাত ফিরিয়ে না দিতে।
তার জন্ম দিয়ে ছবির শুরু, তার মৃত্যুতে ছবির সমাপ্তি। জন্মমুহূর্তে মায়ের প্রসবকালীন আর্তনাদকে ধারণ করে দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড অন্ধকার ছিল সিনেমার পর্দা। কিন্তু তার মৃত্যুসময়ে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে গোটা ফ্রেম। ফিলেমঁর অশ্রু আর কাছের মানুষদের সঙ্গে কাটানো মধুর মুহূর্তের ফ্ল্যাশব্যাক জানিয়ে দেয় অসময়ে বিদায় নিলেও খুব অল্প রসদ নিয়ে যাচ্ছে না সে।
দাঁত-নখের ভবিতব্য নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। তবু তারই মধ্যে বেঁচে থাকে ‘মানুষের ধর্ম’। মায়ায়, বন্ধনে, আত্মত্যাগে। ‘En Attendant La Nuit’ যেন তারই রূপকথা। নিজের মনুষ্যত্বের শেষ পরিচয়টুকু মৃত্যুতে রেখে যায় বলেই, ফিলেমঁর চলে যাওয়ার বেদনার অনুবাদে স্তব্ধতার দরকার হয়। সিনেমার প্রথম ফ্রেমে শব্দ থাকলেও দৃশ্য ছিল না। আর অন্তিম ফ্রেমে দৃশ্য থাকলেও শব্দ থাকে না। সেই নৈঃশব্দ্য আমাদের মধ্যেকার মনুষ্যত্বকেই প্রশ্ন করতে শেখায়, আরও একবার।
….………………………………..