আড্ডার খোরাক
[রসিয়ে কষিয়ে : চতুর্দশ পর্ব]
সময়টা দশম শতক। খলিফা মুস্তাকফি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে জমজমাট আসর বসিয়েছেন। খাবারদাবারের দেদার আয়োজন। গল্পগুজবের মাঝে খলিফা অতিথিদের প্রস্তাব দিলেন খাবার নিয়ে কবিতা রচনা করতে। আড্ডায় নাকি মুখের কথা পড়তে পায় না। একজন দিব্যি মুখে মুখে বানিয়ে ফেললেন তেমনই এক কবিতা। সঙ্গে সঙ্গে পাচকদের নির্দেশ দিলেন খলিফা, কাব্যে বর্ণিত সবকটা পদ এক্ষুনি রান্না করা চাই। জো হুকুম বলে পাচকেরা ফিরে গেল পাকশালায়।
এ তো গেল বড়ো ঘরের আড্ডার খাওয়াদাওয়া। পাঠান মুলুকে আবার ধনী হোক কি গরিব, খাঁটি পাঠানের দাওয়াতে আড্ডাটাই মুখ্য, খাদ্যের বেলায় সে গোপালের মতো সুবোধ বালক, ‘যাহা পায় তাহাই খায়’। সে কেমন? বাঙালির আর কিছু না থাক, নিজের একখানা থালা থাকে। তাতে রান্নাঘরের সব জিনিসই অল্পবিস্তর পৌঁছয়। পাঠান অমন আত্মোদরপরায়ণ নয়। দস্তরখানের দুদিকে তারা মুখোমুখি সারি বেঁধে বসে, তারপর মাঝখানে সাজিয়ে দেওয়া হয় তিন থালা আলু-গোস্ত, তিন থালা শিক কাবাব, তিন থালা মুরগি রোস্ট, তিন থালা সিনা কলিজা, তিন থালা পোলাও, এইরকম ধারা সব জিনিস। যার সামনে যা পড়ল, সে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট। কাবুলে পৌঁছোনোর প্রথম দিনেই মুজতবা আলী গিয়ে পড়েছিলেন এমন এক আড্ডায়। তারপর দেখেন, “পাঠান আড্ডা জমাবার খাতিরে অনেক রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। গল্পের নেশায় বে-খেয়ালে অন্ততঃ আধ ডজন অতিথি সুদ্ধু শুকনো রুটি চিবিয়েই যাচ্ছে, চিবিয়েই যাচ্ছে। অবচেতন ভাবটা এই, পোলাও-মাংস বাছতে হয়, দেখতে হয়, বহুৎ বয়নাক্কা, তাহলে লোকের মুখের দিকে তাকাব কি করে, আর না তাকালে গল্প জমবেই বা কি করে।”
বাঙালির আড্ডা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুখে কিছু না পড়লে তার মুখ চলে না। পরশুরামের গল্পে রায়বাহাদুর বংশলোচনের বৈঠকখানার আড্ডার কথাই ধরা যাক। রায়বাহাদুরের তামাক ধ্বংস করতে করতে আড্ডার সভ্যরা মেপে নিতেন ভুটে নামক পাঁঠা ক-সের মাংসের জোগান দিতে পারবে। বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’ উপন্যাসে ফণি চক্কত্তির চণ্ডীমণ্ডপে যে আড্ডা জমত, তা বিখ্যাত ছিল চাল ছোলা ভাজা আর দেড় সের তামাকের দৈনিক বরাদ্দের দরুন। এসব যদিও সাহিত্যের উদাহরণ, কিন্তু বাঙালির বাস্তবের আড্ডাও আতিথেয়তায় পিছিয়ে নেই। সত্যজিৎ-ঘনিষ্ঠরা অনেক সময় বিজয়া রায়কে অনুযোগ করেছেন, ‘আপনি তো খাইয়ে খাইয়েই মানিকদাকে ফতুর করে দেবেন!’ কবিতা ভবনের আড্ডায় আতিথেয়তার ভার নিতেন প্রতিভা দেবী। এমন গল্পও শোনা যায় যে, চা নিয়ে এসে দেখেছেন একটা কাপ বেশি হচ্ছে, প্রতিভা মৃদু হেসে বলেছেন, ‘মুখচোরা জীবনানন্দ’। অর্থাৎ চা আসার আগেই জীবনানন্দ আড্ডা থেকে বিদায় নিয়েছেন। বাণী বসু অবশ্য ‘মেয়েলি আড্ডার হালচাল’ লিখতে গিয়ে বেশ একহাত নিয়েছেন এই আড্ডাদের, “ছেলেদের আড্ডায় শুনি খবরের কাগজে মুড়ি-পেঁয়াজ মাখা ঢালা থাকে, কাঁচালঙ্কা, বেগুনি এ সবও। আর গোদা গোদা কাপে রাম-কড়া ঘন দুধ দেওয়া চা, কিংবা হাতে হাতে মুঠো মুঠো ছোলাসেদ্ধ উঠে যায়, বোতল বোতল দেশি বিদেশি থাকে। টং হয়ে সব আড্ডা দ্যান। এগুলো মেয়েদের সাহায্য না থাকলে। কারও বাড়ির বৈঠকখানায় বা লিভিংরুমে আড্ডা হলে অবশ্য আলাদা কথা, সেখানে গৃহিণীরা ককটেল থেকে কাঁকরোল ভাজা পর্যন্ত সবই দরকার মতো জোগান। তাকে স্ব-নির্ভর আড্ডা বলা যায় না।” তা যে মেয়েরা আড্ডায় মাংসের চপ থেকে ফিশ বলস ইন তো মিয়াম উইথ বেসিল লিভস কিছুই বাদ দেন না, যেখানে পানীয় হিসেবে থাকে বরফ দেওয়া জিরাপানি অথবা রানি এলিজাবেথের পছন্দের চা, তাঁরা এমন কথা বলতে পারেন বইকি।
আরও পড়ুন : মেনুকার্ডের তত্ত্বতালাশ / রণিতা চট্টোপাধ্যায়
নারীবিবর্জিত আড্ডার চমৎকার উদাহরণ ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে সাগরময় ঘোষের ঘরের আড্ডা, ‘সম্পাদকের বৈঠকে’-তে যার পূর্ণাঙ্গ ছবি পাওয়া যায়। বর্মন স্ট্রিটে ‘দেশ’-এর দপ্তরে প্রত্যেক শনিবার হাজিরা দিতেন সাহিত্যিকেরা। বিমল মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুশীল রায় প্রমুখ ছিলেন এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য। জোড়া দেওয়া টেবলের ওপর খবরের কাগজ পেতে সেরখানেক মুড়ি ঢেলে নারকেল বাতাসা ছোলা চিনাবাদাম সহযোগে আড্ডা বসত। আর মাঝে মাঝে বিমল মিত্রের বদান্যতায় জুটে যেত ‘অয়েল কেক’ অর্থাৎ তেলেভাজা। চা-সিগারেটের অনুপান জোগানো হত দপ্তর থেকেই।
আরও পড়ুন : ম্যাজিকাল মিল / শিলালিপি চক্রবর্তী
এহেন সাদামাটা খাওয়াদাওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবেই বোধহয় এইসব আড্ডায় বারবার উঠে আসে খাওয়ার গল্প। ‘পরিচয়’-এর আড্ডায় হুমায়ুন কবীর, হিরণ সান্যাল, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা মাঝে মাঝেই মেতে উঠতেন দেশবিদেশের খাদ্যাখাদ্য নিয়ে আলোচনায়। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদের গল্প জুড়ে থাকত লখনউয়ের খাদ্যবিলাসী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের সত্তর রকম পোলাও বা ‘দুধ কি পুরিয়া’-র বিবরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নজর অবশ্য বারবার ঘুরে যেত খাদ্য থেকে খাদ্যের নামকরণের উৎস সন্ধানে। ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ শোনা গেছে লালগোলার রাজবাড়িতে জলধর সেনের দীর্ঘ নৈশভোজের ফরমাশ করার কাহিনি। শান্তিনিকেতনে কবি নিশিকান্তের নেংটি ইঁদুর বা বাদুড়ের মাংস রান্না করে খাওয়া বা সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর বাঘের মাংস খেতে চেষ্টা করার গল্প শুনিয়েছেন প্রাক্তন শান্তিনিকেতনী সাগরময় ঘোষ। তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন বাটি কাঁকড়া খাওয়ার গল্প শোনার পর প্রভাত দেব সরকার বলেছিলেন, “আজ যদি বিভূতিবাবু বেঁচে থাকতেন এবং গল্প-উপন্যাস না লিখে একখানা প্রমাণ সাইজের গবেষণামূলক বই লিখে তার নাম দিতেন ‘বাংলার রান্না ও রাঁধুনী’ বা ‘পশ্চিমবঙ্গ রন্ধন সংস্কৃতি’, তাহলে আকাদেমি না পেলেও রবীন্দ্র পুরস্কারটা মারে কে!”
[ পোস্টার : অর্পণ দাস]