প্রথম এভারেস্টজয়ী মহিলা : জুনকো তাবেই
পাহাড় টপকানো সহজ নয়। আর সে পাহাড় যদি হয় বাধার, তবে তা ডিঙোনো আরোই কঠিন। এই বাধা অতিক্রম করতে লাগে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, তা সঞ্চয় করে ওঠা বড়ো সহজ নয়। তবে জুনকো তাবেই পেরেছিলেন। জুনকো তাবেইয়ের সামনে ছিল দুটো পাহাড়, একটা তৈরি প্রবল প্রতিবন্ধকতা দিয়ে, আর তার পরেরটা হল সাক্ষাৎ মাউন্ট এভারেস্ট। জুনকো তাবেইয়ের গল্প এক আশ্চর্য উত্থানের গল্প।
জাপানের জুনকো তাবেইয়ের ছোটো থেকেই খুব ইচ্ছা পাহাড়ে চড়ার। কিন্তু মেয়েদের চলার পথটা তো কখনোই খুব একটা সহজ ছিল না। পাহাড় চড়া, যুদ্ধে যাওয়া, উচ্চশিক্ষা পাওয়া, অভিযানে যাওয়া এই সবকিছু যে শুধুই 'পুরুষালি' কাজ নয়, মেয়েরাও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা রাখে, সেকথা মেনে নিতে বারেবারে নারাজ হয়েছে গোটা পৃথিবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জেরে কাহিল হয়ে পড়া দেশে, বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাত সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে মা-বাবা এমনিতেই নাজেহাল। দিন আনা দিন খাওয়া সেই পরিবারের মেয়ের পাহাড় চড়ার ইচ্ছা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি জুনকোর মা-বাবা। তাই জুনকোর ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে যাচ্ছিলো। কিন্তু ওই যে অদম্য ইচ্ছেশক্তি, সেটাই জুনকোর স্বপ্নকে আর শুধু স্বপ্ন হয়ে থাকতে দিলো না। ছোটবেলায় স্কুল থেকে একবার ট্রেকিংয়ে গিয়েছিল সে। পাহাড়ের প্রতি সেই যে প্রেমের জন্ম হল, দিনে দিনে তা আরও গভীর হলো। প্রতিদিনের অভাব দুঃখ কষ্টে ভরা পৃথিবীটা উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে দেখলে কেমন পালটে যায়, তা দেখার আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। টিউশন পড়িয়ে জোগাড় হত হাতখরচের টাকা, তার থেকে আবার টাকা জমিয়েই বারবার পাহাড়ে ছুটত জুনকো। কখনও বা ভাগ্য প্রসন্ন হলে কোনও অভিযাত্রী দলের সঙ্গে থাকার অনুমতি মিলে যেত। বলাই বাহুল্য, সে দলে সকলেই পুরুষ, তাঁদের কাছে জুনকোর স্থান প্রায় কাজের মেয়ের মতোই। ক্যাম্পে রান্নাবান্না-সহ যাবতীয় কাজকর্ম করে দেওয়ার বিনিময়েই অভিযানে শামিল হত জুনকো। যদিও এর ফলে পড়শিরা তাঁর চরিত্রে কালি লাগাতে কসুর করেননি। কিন্তু তাতেও তাকে পাহাড় থেকে দূরে রাখা যায়নি কখনোই।
এই পাহাড়ে যাতায়াতের সূত্রেই জুনকোর আলাপ হয় জাপানি পর্বতারোহী মাসানুবো তাবেইয়ের সঙ্গে। এরপর আলাপ থেকে প্রেম আর প্রেম থেকে বিয়ে। প্রকৃতার্থেই মাসানুবো হয়ে উঠেছিলেন জুনকোর জীবনসঙ্গী। একজন যথার্থ বন্ধুর মতোই তাঁর হাত ধরেন এই জাপানি পর্বতারোহী। স্ত্রীয়ের পাহাড়প্রেমকে আরও সাহস জোগালেন তিনি। যার ফলে বিয়ের দশ বছর পর, ১৯৭৫ সালের মার্চে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে এসে হাজির হলেন জুনকো তাবেই। এই সময়ে তাঁর তিন বছরের মেয়েকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী ও বোনেরা। অবশ্য তার আগেই ১৯৬৯ সালে 'লেডিস ক্লাইম্বিং ক্লাব' খুলেছিলেন জুনকো, যাতে তাঁর দেশের গরিব মেয়েদের পাহাড়ে চড়তে গিয়ে তাঁর মতো অপমানের, বঞ্চনার মুখোমুখি হতে না হয়। এই ক্লাবের সদস্যরা আত্মীয় বন্ধুদের থেকে ধার করে এভারেস্ট অভিযানের টাকা জোগাড় করতে শুরু করেছিলেন, আর এইভাবে কুড়িয়েবাড়িয়ে এভারেস্ট অভিযানে পা বাড়িয়েছিলেন জুনকো-সহ ওই ক্লাবের ১৫ জন সদস্য। আর্থিক সংগতি নেই, আধুনিক যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির সহায়তা নেই, এমনকি প্রকৃতির সমর্থনও মিলছিল না সেভাবে। একদিন তুষারধ্বসে চাপা পড়ে প্রায় মরতেই বসেছিলেন অভিযাত্রীরা। এই ঘটনায় মনোবল ভেঙে গেল দলের। ফেরার পথ ধরলেন জুনকো ছাড়া দলের বাকি ১৪ জন সদস্য। আর গোড়ালির চোট নিয়ে হিমালয় পর্বতের নির্জন তুষারসমুদ্রে একা রয়ে গেলেন জুনকো তাবেই। সঙ্গে কেবল একজনমাত্র শেরপা, আং শেরিং। এতদিনের পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতা থেকে জুনকো জানতেন, জীবন তাঁকে দ্বিতীয় সুযোগ দেবে না। তাই এই প্রথম সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করতে হবে, শীর্ষে পৌঁছাতে হবে তাঁকে। মেয়ে বলে, গরিব বলে সারা জীবন যে অপমানগুলো সয়ে এসেছেন, সেই অপমানের পালটা জবাবও তাঁকে দিতে হবে এভাবেই। সেই জবাবটা দিয়েছিলেন জুনকো তাবেই। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে এভারেস্টের চূড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একা।
সহায়-সম্বল কিছুই ছিলোনা। তবুও হার মানেননি গরিব পরিবারের এই মেয়েটি। পুরনো পর্দার কাপড় কেটে ট্রাউজার বানিয়ে নিয়েছিলেন, প্রতিবেশীর বাতিল গাড়ির সিট কভারের রেক্সিন দিয়ে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ আর গ্লাভস বানিয়েছিলেন নিজেই। আর এইসব নিয়েই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন জুনকো তাবেই। আর এই অদম্য জেদেরই বুঝি প্রতিদান দিয়েছিল পাহাড়ও। বিশ্বের প্রথম মেয়ে হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন তিনি। আর শুধু এভারেস্টই নয়, প্রথম নারী হিসেবে সেভেন সামিট অর্থাৎ সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়াও জয় করেছিলেন তিনি। আর সেইসঙ্গে মেয়েদের সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা বাধার পাহাড়টাকেও অনেকখানি চুরমার করে দিয়েছিলেন জুনকো তাবেই।
..................
সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#Junko Tabei #Japanese mountaineer #Mount Everest #silly পয়েন্ট #নারীপক্ষ