পনেরো বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ : বঙ্কিমকেও মুগ্ধ করেছিল গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কলম
উনবিংশ শতকের আগে বাংলা সাহিত্যে মহিলা লেখকের নাম খুব কমই পাওয়া গেছে। আঠেরো শতক পর্যন্ত পুরুষপ্রধান সাহিত্যক্ষেত্রে নারীর পদচারণার চিহ্ন প্রায় নেই। উনিশ শতকের বাংলা কয়েকজন মহিলা সাহিত্যিকের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে। তাঁদের মধ্যে প্রতিনিধিস্থানীয় ছিলেন গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী। তাঁর কাব্যপ্রচেষ্টা বা চর্চাও কিন্তু খুব অনায়াস ছিল না। সাহিত্যচর্চার অনুকূল পরিবেশ তিনি পাননি, যা লিখেছেন তা তাঁর তীব্র সংরাগের ফসল। তবে এক্ষেত্রে সর্বতোভাবে গিরীন্দ্রমোহিনীর পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী। মোট সাতটি কাব্যগ্রন্থ, ষোলোটি গদ্য এবং একটি ঐতিহাসিক নাট্যকাব্য রচনা করেছিলেন তিনি।
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর অধিকাংশ রচনাই ব্যক্তিগত জীবন-প্রভাবিত। সেকালের সিংহভাগ মহিলার মতো পরিচিত ছাঁচে ঢালা ছিল তাঁর জীবন। তবে ছোটোবেলায় বাপের বাড়িতে তিনি লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই লেখাপড়া খুব সামান্য হলেও যুগের নিরিখে এ ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। এরপর দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায় নরেশচন্দ্র দত্তের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়িতে পড়াশোনা এবং সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডল ছিলো। স্ত্রী-র পড়াশোনায় নরেশচন্দ্রের বেশ আগ্রহ ছিল, যদিও শ্বশুরবাড়ির অন্য পরিজনেরা ঘরের বউয়ের লেখাপড়ায় আপত্তিই করেছিলেন। তবুও গিরীন্দ্রমোহিনীর লেখাপড়ার চর্চা রয়ে গিয়েছিল।
গিরীন্দ্রমোহিনীর প্রথম প্রকাশিত রচনা ছদ্মনামে, 'জনৈক হিন্দু মহিলার পত্রাবলী' নামে পাঁচটি চিঠির একটি সংকলন। এর মধ্যে চারটি চিঠি প্রবাসী স্বামীকে লেখা। এরপর মূলত নরেশচন্দ্রের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় গিরীন্দ্রমোহিনীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কবিতা হার'। এই বইটি তাঁর নিজের নামে প্রকাশিত হয়নি, রচয়িতার জায়গায় লেখা ছিল 'জনৈক হিন্দু মহিলা'। এই বইয়ের কবিতার বিষয় ছিল তৎকালীন সমাজে নারীর দুরবস্থা। এই কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় কবি গিরীন্দ্রমোহিনী সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, "শ্রুত আছি পঞ্চদশ বর্ষীয়া বালিকার প্রণিত। ইহা পূর্ণবয়স্কা কোন স্ত্রীর লিখিত হইলেও প্রশংসনীয় হইত। পৌঢ়বয়ঃ কোন পুরুষ লিখিত হইলেও প্রশংসনীয় হইত।" এর নয় বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ভারতকুসুম'। এটিও প্রকাশিত হয়েছিল ছদ্মনামে। এই বইয়েরও বিষয় ছিল অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের দুর্দশা, বিশেষতব্ব যে মেয়েরা লেখাপড়া করতে চাইত বা নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলতে চাইত, তাদের জীবনসংগ্রামের কথা। বস্তুত, এই সবই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ।
নরেশচন্দ্রের যখন মৃত্যু হয় তখন গিরীন্দ্রমোহিনীর ছাব্বিশ বছর বয়েস। একাধিক সন্তান নিয়ে অল্পবয়সে বৈধব্য, তার ওপর শুরু হয় বৈধব্যের হাজারো নিয়ম-সংস্কার - এসবের বেড়াজালে তিনি বাঁধা পড়েছিলেন। তাঁর মনের কথা বলার মতো কোনো মানুষ তখন ছিল না। কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতি, অবদমিত বেদনাকে মুক্ত করার মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন কাগজ-কলম। স্বামীর মৃত্যুর যন্ত্রণা ধরা আছে তাঁর 'অশ্রুকণা' কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি ছত্রে। গিরিন্দ্রমোহিনীর স্বনামে প্রকাশ পাওয়া প্রথম এই বই প্রকাশিত হয়েছিল অক্ষয়কুমার বড়ালের সম্পাদনায়। এই বইটি পাঠক-সমালোচকের কাছে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। এর তিন বছর পর প্রকাশিত হয় ১৫১টি কবিতা নিয়ে তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ 'আভাষ'। এরপর 'অর্ঘ্য', 'সিন্ধুগাথা' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে অবশ্য কবির ব্যক্তিগত শোকের প্রভাব স্তিমিত হয়ে এসেছিল। পরিবর্তে প্রধান হয়ে উঠেছিল দার্শনিকসুলভ চিন্তাভাবনা।
আরও পড়ুন: বাজার করার বিপত্তি এড়াতে ‘লেখক’ হয়ে ওঠেন জগদীশ গুপ্ত/ সৃজিতা সান্যাল
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কাব্যগ্রন্থগুলির বিষয়ের মধ্যে ক্রমবিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম দিকের কবিতায় নারীচেতনার প্রকাশ, তারপর ব্যক্তিগত শোকবিহ্বলতা, তারপর যুক্তিপূর্ণ দার্শনিক মনোভাব সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর ক্রমপরিণতিরই সাক্ষ্য রাখে। তাঁর সমগ্র কাব্যচর্চা সম্পর্কে উল্লেখ্য যে, কোথাও তাঁর লিঙ্গপরিচয় প্রকট হয়ে ওঠেনি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে একজন মহিলা হয়ে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ সহজ ব্যাপার ছিলো না। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী এই কঠিন কাজটাই করেছিলেন সফলভাবে।
….……..